ধোঁয়াশার চোরাপথে আচ্ছন্ন আওয়ামী লীগের অজানা ভবিষ্যৎ

গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার এক মিলিত অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্মরণকালের ভয়াবহ নৈরাজ্য, সহিংসতা ও বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে এক অন্যরকম বিপর্যস্তপূর্ণ বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করলো দেশের মানুষ। এখন ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। প্রায় ষোলো বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের সাথে সাথে দলটিও হয়ে পড়েছে ছিন্নভিন্ন। মন্ত্রী-এমপিসহ দলের নেতারা গা-ঢাকা দিয়েছেন। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ অবস্থায় সকলের মনে একটাই প্রশ্ন- কে ধরবে চরমভাবে বিধ্বস্ত বর্তমান আওয়ামী লীগের হাল? টানা প্রায় ষোলো বছর ক্ষমতায় থেকে গণরোষের মুখে এক সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে দলের অস্তিত্ব মুখথুবড়ে পড়েছে সেই দলের হাল ধরার দায়িত্ব কে নেবে? এমন প্রশ্নই এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে সকলের মুখে মুখে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের এক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন রাজনৈতিক দল। এই দলের রয়েছে এক দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। একাত্তরে এই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীনতালাভ করেছে। পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর এই রাজনৈতিক দলে যে নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দেয় তা দূর করতে দলটির অনেক সময় লেগে গিয়েছিল। বেগম জহুরা তাজউদ্দিন, মুহাম্মদ জিল্লুর রহমান, আব্দুল মালেক উকিল প্রমুখ প্রবীণ রাজনীতিকের হাত ধরে অবশেষে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এসে থিতু হয় এই ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্ব। ২০২৪-এর ৫ই আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত শেখ হাসিনার একক হাতেই ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের চাবি।
গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ এখন সম্পূর্ণরূপেই নেতৃত্বশূন্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার দুই সপ্তাহ যেতে-না-যেতেই সকলের মুখে একটিই প্রশ্ন- এখন কার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়াবে আওয়ামী লীগ? যিনিই নেতৃত্বে থাকুন না কেন তিনি কি দেশে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেবেন, না কি বিদেশে থেকে? কোনো রাজনৈতিক নেতা বিদেশে থেকে দলকে পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিলে দলের সাংগঠনিক কাঠামো কি শক্ত হওয়া সম্ভব? যদি তা না হয়- তাহলে দেশের ভিতর থেকে প্রত্যক্ষভাবে কে নেতৃত্ব দেবে এই মুহূর্তে পালিয়ে থাকা হাজার হাজার নেতা-কর্মীসহ বর্তমানে নিষ্ক্রিয় হয়েপড়া আওয়ামী লীগকে? এমনই অসংখ্য প্রশ্ন হাতড়ে বেড়াচ্ছেন দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষজন।
পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত হাসিনা-পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বিদেশি সংবাদমাধ্যমে যেসব কথা বলেছেন সেখানে তার বক্তব্যের পরস্পরবিরোধিতা স্পষ্ট ধরা পড়েছে। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার অব্যবহিত পরেই জয় তার প্রথম বার্তায় বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনার পর আপনাদের কী হবে, সেটা আমার চিন্তার বিষয় না, আমার পরিবারেরও বিষয় না- আপনারা বুঝবেন।’ পরদিন ৬ই আগস্ট বিবিসিকে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা রাজনীতিতে ফিরবেন না। আমার মনে হয় এখানেই শেষ। আমার পরিবার এবং আমাদের যথেষ্ট হয়েছে।’ ৭ই আগস্ট আগের বক্তব্য থেকে পুরো ঘুরে গিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা একা না। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। বঙ্গবন্ধুর পরিবার কোথাও যায়নি। নেতাকর্মী ও আওয়ামী লীগকে রক্ষার জন্য যা করা প্রয়োজন আমরা করতে প্রস্তুত।’ এমনকি জয় এও বলেছেন দল চাইলে তিনি দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন এবং দলকে আবার ক্ষমতায় আনবেন।
সজীব ওয়াজেদ জয়ের এসব কথায় দলের সংশ্লিষ্ট নেতারা কোনোভাবেই আস্থা আনতে পারছেন না। এর কারণও অবাস্তব নয়। আওয়ামী লীগ টানা প্রায় ষোলো বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন তাঁর মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে রাজনৈতিক কোনো পদে আসীন করেননি। তিনিও সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিতে আগ্রহী- এমন ইঙ্গিতও দেখা যায়নি। এখন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও তাঁর মা শেখ হাসিনা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে ছিটকে পড়াতে সজীব ওয়াজেদ জয়ের হঠাৎ এই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বগ্রহণের ইচ্ছেকে সহজে গ্রহণ করছেন না কেউ। এদিকে তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমুসহ প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাদেরও কেউ এই মুহূর্তে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকা দলটিকে নিয়ে কোনো টুঁ শব্দও করছেন না। দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়া, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া এবং দেশের ভিতরে আত্মোগোপন করে থাকা এই সময়ে কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকেই আর প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। এ মুহূর্তে তাই ঘুরে-ফিরে একটাই প্রশ্ন- কে নেতৃত্ব দিয়ে জাগিয়ে তুলবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে?
বর্তমানে ভারতে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণ করা শেখ হাসিনা অন্য কোনো দেশে যাবেন কি না এখনো তা নিশ্চিত নয়। তবে তিনি তৃতীয় কোনো দেশে না যাওয়া পর্যন্ত ভারতেই তার থাকার ব্যবস্থা করেছে দেশটির সরকার। ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই পলাতক দলের সব গুরুত্বপূর্ণ নেতা। দলের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় কোনো নেতারই কোনো হদিস নেই কোথাও। কেউ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। কেউবা দেশেই আত্মগোপন করে আছেন। কয়েকজন নেতা পালাতে গিয়ে বিমানবন্দরে আটক হয়েছেন। কেউবা নিজ বাড়ি এবং আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হচ্ছেন। তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার অনেকেই আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছেন; সেখানে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের কেউ নেই। বলা যায়- সাংগঠনিকভাবে ভয়াবহ নাজুক আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীরা এখন পুরোপুরিই অভিভাবকহীন। দলের এই নেতৃত্বশূন্যতা ’৭৫-এর পরেও এতটা প্রকট হয়ে ওঠেনি।
সেসময় দলের নেতৃত্বে যারা এসেছিলেন তারা প্রথম সারির কেউ তো ছিলেন-ই না, তারা কোনো আলোচনায়ও ছিলেন না। বরং তাঁরা ছিলেন অনেকটা অবহেলার শিকার। এর মধ্যে উল্লেখ করা যায় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দিন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দিনের কথা। ’৭৫-পরবর্তী ভয়াবহ বিপর্যয়ের সময় দলের হাল ধরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দিন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দিন। অথচ বঙ্গবন্ধুর অবহেলার শিকার হয়ে মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তাজউদ্দিন। তাঁর স্ত্রী রাজনীতিতে অনেকটাই অনভিজ্ঞ বেগম জোহরা তাজউদ্দিন ১৯৭৭ সালে এক সংকটময় মুহূর্তে আওয়ামী লীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। তখন তিনি দলকে পুনর্গঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করেন। দলের দিগ্ভ্রান্ত নেতা-কর্মীদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে সফর করেন সারা দেশ। সেবার দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। তবে সেটার যে প্রেক্ষাপট ছিল এবারের প্রেক্ষাপট তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০২৪-এর সংকট অতীতের যেকোনো সংকটকেই ম্লান করে দিয়েছে।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দল পুনর্গঠনের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০৭ সালে যখন এক-এগারোর সেনাসমর্থিত সরকার গঠিত হয়; তখন বহুল আলোচিত মাইনাস টু ফর্মুলার একজন হিসেবে শিকার হতে যাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। তাকে তখন সেনাসমর্থিত সরকার জেলে পুরে। ঐ বছরের ১৬ই জুলাই আওয়ামী লীগের উপস্থিত সংকটময় মুহূর্তে দলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন প্রায় অবসরে যাওয়া প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান। রাজনীতিতে তাঁর অভিজ্ঞতা কষ্টিপাথরে প্রমাণিত বলা যায়। তিনি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে দলীয় প্রধান বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। সামরিক সরকারের নানা ভয়-ভীতি আর প্রলোভনে যখন অনেক শীর্ষ নেতা দিগ্ভ্রান্ত, তখন দলকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি।
দীর্ঘ ১৭ বছর পর আবার এক মহাসংকটের ঘন অমানিশায় নিপতিত হলো আওয়ামী লীগ। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে- এবারের সংকট অন্য যেকোনো সময়ের চেয়েও ভয়াবহ। গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা তার পরিচালিত সরকার থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পাঁচদিন পরে যে বার্তা দিয়েছেন সেখানে তিনি নেতাকর্মীদের মনোবল অটুট রাখার নির্দেশনা দিয়ে শিগগিরই দেশে ফেরার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। এটা তাঁর তাৎক্ষণিক অভিপ্রায় থাকতেই পারে কিন্তু দেশের সার্বিক রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন; এটা মানতেই হবে। তিনি নিজেও খুব ভালো করেই জানেন যে- তাঁর দলের পাতি নেতা থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের সব নেতাই আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেকেই বিদেশে পালাতে গিয়েও ধরা পড়েছেন। এমন একটি নাজুক পরিস্থিতিতে তাঁর দেশে ফেরার অভিপ্রায় মিথ্যা কুহক ছাড়া আর কিছুই না। যেখানে দলের সাধারণ মানের নেতারাই গা-ঢাকা দিয়েছেন সেখানে দলের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতা খুঁজে বের করাও এই মুহূর্তে রীতিমতো দুঃসাধ্য বইকি।
হাসিনা-পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আওয়ামী লীগের মতো একটি রাশভারী দলের নেতৃত্ব গ্রহণের যে ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন সেটাও অনেকটাই বালখিল্যের মতো। গত ৫ই আগস্ট তাঁর মা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে কয়েকদিন ধরে তিনি পরস্পরবিরোধী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা তাঁর রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। একবার তিনি বলেছেন- তাঁর মা শেখ হাসিনা আর রাজনীতি করবেন না। একবার বলেছেন- শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি; তিনি দেশে ফিরে আসবেন। আবার বলেছেন- আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবে এবং তারা পুনরায় ক্ষমতায় আসবে। এমন বিপরীতধর্মী কথা বলে জয় প্রমাণ করেছেন যে- তিনি সুস্থির নন এবং তিনি কী করতে চান সেটাও পরিষ্কার নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড়ো হওয়া ও বিদেশি জীবনে অভ্যস্ত জয় বাংলাদেশের মতো একটি দেশের রাজনীতির চ্যালেঞ্জ গ্রহণে এগিয়ে আসবেন, এটা দেশের কেউ আস্থায় নিতে পারছেন না। কেননা, বিগত প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা রাজনীতিতে জয়কে প্রত্যক্ষভাবে কখনো সম্পৃক্তই করেননি।
এখন নতুন করে দেশের মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে? শেখ হাসিনার দেশে ফেরা কি আদৌ সম্ভব? এই মুহূর্তে দলের নেতৃত্ব কে গ্রহণ করবে? বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ও দলের নেতাকর্মীদের কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সবই ধোঁয়াশার এক কানাগলিতে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে। কে জানে এই ধোঁয়াশা কাটবে কবে।আলী হাসান: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

মন্তব্য করুন