মুরাদনগর দখলের লড়াই! হচ্ছেটা কী

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া কি মুরাদনগরের রাজনৈতিক মাঠ দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন? বিএনপির, আর একটু গভীরে গিয়ে বলতে গেলে কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের দীর্ঘদিনের ঘাঁটি এই সংসদীয় আসন ছিনিয়ে নেয়ার লড়াইয়ে নেমেছেন? উপদেষ্টা ও তার অনুসারীদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে এমন প্রশ্ন উঠেছে কুমিল্লার সাধারণ মানুষের মনে।
তারা বলছেন, অকারণে কেন যেন এই লড়াইয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, পাঁচবারের সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদকে টার্গেট করা হচ্ছে। অনুগামীদের দিয়ে কায়কোবাদবিরোধী প্রচার খুব একটা পাত্তা না পাওয়ায় ঢাকা সিটি করপোরেশন নিয়ে ইশরাক ইস্যুতে কায়কোবাদকে নিশানা করে আক্রমণাত্মক বক্তব্যও দিয়েছেন উপদেষ্টা।
স্থানীয় মানুষের ধারণা, কূটকৌশলের অংশ হিসাবেই নারী ধর্ষণে অভিযুক্তকে বিএনপির কর্মী বলে প্রচার শুরু হয়েছিল আসিফ মাহমুদের অনুসারীদের পক্ষ থেকে। তবে অভিযুক্তের আসল পরিচয় আওয়ামী লীগ কর্মী- এ তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর নেয়া হয়েছে ভিন্ন কৌশল। এখন প্রচার চলছে, অভিযুক্ত ধর্ষককে প্রশ্রয় দিতেন বিএনপির এক নেতা।
এখন অবশ্য ফুঁসে উঠেছে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে আসিফ মাহমুদকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, নিজ স্বার্থে একজন উপদেষ্টা মুরাদনগরের ধর্ষণের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চক্রান্ত করছেন।
কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলা নিয়ে জাতীয় সংসদের কুমিল্লা-৩ আসন। ১৯৮৬ সাল থেকে আসনটি প্রায় নিজের করে নেন শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ। প্রথমবার জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচনে জিতে এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভায় জায়গা করে নিয়েছিলেন। তখন থেকেই সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে থেকেছেন। এলাকার উন্নয়নে রেখেছেন ব্যাপক অবদান। ১৯৯১ সালে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেও বিএনপি-আওয়ামী লীগের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেন।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিএনপির মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া এবং আওয়ামী লীগের ধনাঢ্য প্রার্থী ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনকে হারিয়ে আবার সংসদ সদস্য হন। সেবার কায়কোবাদ ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী।
এলাকায় কায়কোবাদের বিপুল জনপ্রিয়তা বিএনপির নজর এড়ায়নি। তাই ২০০১ সালের নির্বাচনের আগেই তাকে দলে টেনে নেয় বিএনপি। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ। জায়গা করে নেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে। এখন তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকার কায়কোবাদের এই জনপ্রিয়তা ধ্বংস করতে গ্রহণ করে নানা কূটকৌশল। ২০০৪ সালে গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলায় কায়কোবাদকে আসামি করে সরকার। সেটিও ছিল আওয়ামী লীগ আমলের সম্পূরক চার্জশিট। সেই মামলায় কায়কোবাদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল নিম্ন আদালত। তবে তিনি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এই মামলা থেকে বেকসুর খালাস পান।
আওয়ামী লীগ আমলের মামলার কারণে দীর্ঘদিন দেশে থাকতে পারেননি কায়কোবাদ। মামলা থেকে খালাস পাওয়ার পর দেশে ফেরেন গত বছর ডিসেম্বরে। তার আগেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হন মুরাদনগরের সন্তান আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। দায়িত্ব পান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নযন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের।
কেউ কেউ মনে করেন, কায়কোবাদের সাময়িক অনুপস্থিতিতে কুমিল্লা-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুরাদনগরে গড়ে ওঠে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সমর্থক গোষ্ঠী। আসিফ মাহমুদও ইচ্ছেমতো মুরাদনগরে সরকারি প্রকল্পের টাকা ঢালতে শুরু করে দেন। দেশের বিভিন্ন উপজেলার সাথে এই ক্ষেত্রে বৈষম্য হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে ইতিমধ্যে ।
স্থানীয়দের মতে, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ দেশে ফিরে এলে ধাক্কা খায় আসিফ মাহমুদের স্বপ্ন। কারণ কায়কোবাদের বিপুল জনপ্রিয়তার কথা তার জানা। তাই কায়কোবাদকে সহজে দুর্বল করা যাবে না জেনে বিরক্ত করতে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের হেনস্তা করা শুরু হয়। এই কাজে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন আর জাতীয় নাগরিক পার্টির মুরাদনগর উপজেলা শাখাকে ব্যবহার করেন আসিফ মাহমুদের স্বজনরা, এমন অভিযোগ রয়েছে।
অনেক বিএনপি নেতার নামে মামলাও হয়। তবে স্থানীয় মানুষ পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে আসিফ মাহমুদের সমর্থকরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। এরপর রাজধানীতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে শপথের জন্য ইশরাক হোসেনের আন্দোলনে কায়কোবাদের প্ররোচনা ও আর্থিক সহযোগিতা রয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন আসিফ মাহমুদ।
সবশেষ যোগ হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক নারীকে ধর্ষণকাণ্ড। বিএনপি ও কায়কোবাদকে বেকায়দায় ফেলতে প্রথমে প্রচার হয়েছে অভিযুক্ত ধর্ষক বিএনপির কর্মী। এই প্রচার মাঠে মারা গেছে, যখন অভিযুক্তের আসল পরিচয় বেরিয়ে আসে; সে আওয়ামী লীগ কর্মী। এবার আসিফ মাহমুদের অনুসারীদের প্রচার, এই আওয়ামী লীগ কর্মীর প্রশ্রয়দাতা বিএনপির এক নেতা।
অবশ্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ এরই মধ্যে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, অভিযুক্তের প্রশ্রয়দাতা যে দলেরই হোক তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। কায়কোবাদের এমন বিবৃতিতে খানিকটা থতমত খেয়ে গেছে আসিফ মাহমুদের সমর্থকরা।
এভাবে টার্গেট করে কি জনপ্রিয় নেতা কায়কোবাদকে দুর্বল করা যাবে? যার শেকড় মুরাদনগরের প্রায় সর্বত্র, সেই কায়কোবাদ কি পিছু হটবেন? নাকি তাকে নিয়ে যারা ষড়যন্ত্র করছেন, তারা পর্যুদস্ত হবেন?
(ঢাকাটাইমস/২৯জুন/মোআ)

মন্তব্য করুন