শীতে বাড়তে পারে ডায়াবেটিস, নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল
প্রকৃতিতে চলছে শীতের মৌসুম। বিশেষ করে ঘন কুয়াশা আর হিমেল বাতাসে উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে জেঁকে বসেছে শীত। লেপ-কম্বল ছেড়ে ঘুম উঠতে ইচ্ছে করে না একেবারেই। প্রতিদিনের যাবতীয় কাজে ভাটা পড়ে। ফলে তেমন হাঁটাচলা করা হয় না। শীতকালে এই কম চলাফেরার কারণে বিভিন্ন রোগের বাড়বাড়ন্ত হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো বহুমূত্র রোগ বা ডায়াবেটিস। এই রোগে বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এর মধ্যে ওজন বেড়ে যাওয়া খুব সাধারণ একটি সমস্যা।
অনেকে চলাফেরার পরিশ্রম কমাতে শীতে খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দেন। এতে ওজন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। যদিও এতে বিপদ কমে না। অনিয়মিত বা কম খাওয়াদাওয়ার ফলে রক্তে শর্করার ভারসাম্য হেরফের হয়। যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মোটেই ভালো নয়।
সকালে উঠে শরীরচর্চা করতে যেমন ইচ্ছা করে না, তেমন আবার বিভিন্ন রকম খাবার দেখলে লোভ সামলানো দায় হয়। বিশেষ করে শীতে পিঠাপুলি, খেজুরের রসের পায়েস, বিভিন্ন মিষ্টান্নসহ উপাদেয় সব খাবারের ধুম পড়ে যায়। আর এ ধরনের খাবার অন্য খাবারের তুলনায় রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায়। এ সময়টায় মানুষের সর্দি-কাশি, টনসিলাইটিস, নিউমোনিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ, অ্যাজমা বা শ্বাস-কষ্ট, আর্থ্রাইটিস বা বাতব্যথা, হার্টের সমস্যার প্রকোপ বেড়ে যায়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে এসব রোগের জটিলতা বেড়ে গিয়ে ভোগান্তির পালা শুরু হয়। তাই এ সময় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বেশি সচেতন হওয়া উচিত।
একটি মেডিসিন জার্নাল অনুসারে, ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে গ্লুকোজ উল্লেখযোগ্যভাবে ঋতু দ্বারা প্রভাবিত হয়, শীতকালে চিনির মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং গ্রীষ্মকালে হ্রাস পায়। যদিও সুস্থ ব্যক্তি এবং ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে শীতকালে চিনির মাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে, তবে বেশ কয়েকটি উপায় রয়েছে যা গ্লুকোজের বৃদ্ধি রোধ করতে এবং এই ঋতুতে আপনাকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করতে পারে।
নিয়মিত শরীরচর্চা করুন
যতই ঠান্ডা লাগুক, ঘুম থেকে সকালে উঠতে চেষ্টা করুন। সারা দিনের কাজের মাঝে শরীরচর্চা করার সময় না পেলে কিন্তু বিপদ বাড়বে। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে প্রথমেই বিপাকীয় হারে পরিবর্তন আনতে হবে। রক্ত সঞ্চালন ভাল রাখতে, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে শীতকালেও হালকা যোগাসন, হাঁটাহাঁটি করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে শরীরচর্চা এবং খাওয়াদাওয়ার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস হল মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা। মানসিক চাপ বা উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রক্তে শর্করার মাত্রাও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
পায়ের পাতা গরম রাখুন
শীতের মরসুমে গরমের পোশাক পরলেও হাত-পায়ের পাতা গরম রাখতে আলাদা করে যত্ন নেওয়া হয় না। কিন্তু যাঁদের ডায়াবিটিস আছে, শীতকালে তাঁদের হাত-পায়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য বিশেষ ভাবে সচেতন থাকার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন
অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। কিডনি এবং লিভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোরও ক্ষতি করতে পারে যা ইনসুলিন উৎপাদন এবং পরিচালনার সাথে জড়িত।
নিয়মিত শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করতে হবে
আবহাওয়ার বিন্দুমাত্র পরিবর্তনেই বদলে যায় রক্তে শর্করার মাত্রা। খাওয়াদাওয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার পাশাপাশি নিয়মিত রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করাও দরকার।
ডায়েট মেনে খাওয়াদাওয়া করুন
শীতের মিষ্টি পায়েস, পিঠাপুলি বা মিষ্টান্ন যদি একান্তই খেতে মন চায় তবে চিনি বা গুড়ের বদলে কৃত্রিম মিষ্টকারক যেমন সুক্রোলোজ, এসপার্টেম প্রভৃতি ব্যবহার করুন। কোনো উৎসব বা দাওয়াতে অংশগ্রহণ করলে ডেজার্ট, কোল্ড ড্রিংকস বাদ দিন। বেছে নিন সালাদ, সবজি, রোস্ট, গ্রিলডজাতীয় খাবার। মনে রাখবেন আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা মানে আপনার লাভ। এ সময়টায় বাজারে নানা রকমের সুস্বাদু ও খাদ্য উপাদানে ভরপুর শাকসবজি পাওয়া যায়। বেশি করে শাকসবজি ও ফল খান। এগুলোর মধ্যে উপস্থিত ফাইবার ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শরীরের সজীবতা বজায় রাখে, খাদ্য হজমে সাহায্য করে, শরীরের নিস্তেজ ভাব কাটায়। টাটকা ফল ও সবজিতে রয়েছে বায়োটিন, যা ত্বক ও চুল ভালো রাখে। পান করুন পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি।
শীতের সন্ধ্যায় গরম ধোঁয়া ওঠা হট চকোলেট বা ক্যাপুচিনো খেতে ভাল লাগলেও শরীরের কথা ভেবে চিনি ছাড়া গ্রিন টি বা সব্জির স্যুপ খেতেই পারেন। এ ছাড়াও নরম পানীয়, ভাজাভুজি বা প্রক্রিয়াজাত খাবার বাদ দিতে পারলেই ভাল।
শীতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে যা যা খাবেন জেনে নিন-
গাজর: কাঁচা খাওয়া ছাড়াও গাজর রান্না করেও খেতে পারেন। গাজরের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম, তাই এগুলো ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আদর্শ খাবার। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। এছাড়া গাজরে বিটা ক্যারোটিন ও ভিটামিন এ পাওয়া যায়। যা চোখের তীক্ষ্ণতা বাড়াতে ও ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথির ঝুঁকিও কমাতে অবদান রাখে।
কমলালেবু: কমলালেবু একটি সাইট্রাস ফল। এতে পটাসিয়াম, ফাইবার ও ভিটামিন সি থাকে। যেহেতু এর গ্লাইসেমিক সূচক কম থাকে, তাই এটি খাওয়ার পর রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়ে না।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য, ভিটামিন সি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমায়। গবেষণা অনুসারে, টাইপ-২ ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের মধ্যে যারা প্রতিদিন ১০০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি খান তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা কম থাকে।
সবুজ শাকসবজি: শীতে শরীরের যত্ন নেয় সবুজ শাকসবজি। ডায়াবেটিস রোগীদের সবুজ শাকসবজি বেশি করে খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। সবজিতে থাতে মিনারেলস, ভিটামিন, ফাইবারের মতো উপকারী উপাদান। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও ডায়াবেটিসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে শাকসবজি খেতে হবে বেশি করে।
বাদাম: বাদাম ও বিভিন্ন ধরনের শস্য রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। আখরোট, কাঠবাদাম ও চিয়া বীজে আছে অনেক পরিমাণে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও প্রোটিন।
মসলা: কিছু মসলা আছে যা ডায়াবেটিকদের জন্য ওষুধের মতো কাজ করে। যেমন- দারুচিনি ও হলুদ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত। এগুলোতে আছে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান। যা প্রদাহজনিত যেকোনো সমস্যা সমাধান করে। একই সঙ্গে সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও এই মসলাগুলো দারুণ কার্যকরী।
(ঢাকাটাইমস/২৫ নভেম্বর/আরজেড)
মন্তব্য করুন