ভেষজ আমলকী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর
স্বাস্থ্য রক্ষা ও পরিচর্যায় ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহারের ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতোই সুপ্রাচীন। সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ভেষজ ওষুধ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। প্রাচীনকাল থেকে আমলকী অত্যন্ত কার্যকরী ভেষজ ফল হিসেবে পরিচিত। শতাব্দী প্রাচীন আয়ুর্বেদ অনুযায়ী আমলকি হল মহাঔষধি। এর ফল ও পাতা দুটিই ওষুধরূপে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন অসুখ সারানো ছাড়াও আমলকী রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে দারুণ সাহায্য করে। আমলকীর গুণাগুণের জন্য আয়ুর্বেদিক ওষুধেও এখন আমলকির নির্যাস ব্যবহার করা হয়।
সকালবেলা খালি পেটে একটু আমলকির রস বা নাশতা খাওয়ার পর এক টুকরো আমলকীর গুণে অনেক রোগ নিরাময় হয়ে যায়। বাইরে থেকে ওষুধ খেলে সাময়িক লাভ হয় ঠিকই। কিন্তু আমলকী ভিতর থেকে শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। আয়ুর্বেদে ভোজনের আরম্ভে, মধ্যভাগে এবং শেষে নিয়মিত আমলকী খেতে বলা হয়েছে। এই ফলের গুণ অমৃত সমান-সেই জন্য একে অমৃতফলও বলা হয়।
আমলকি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ফাইলান্থাস অ্যামব্লিকা। ছোট বা মাঝারি আকারের পাতাঝরা বৃক্ষ। এ গাছ ১০-২০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। গাছের বাকল স্তরবিশিষ্ট। শীতকালে আমলকির পাতা ঝরে যায়।
আমলকীর জন্মস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। পাহাড়ের প্রায় এক হাজার ৫০০ মিটার উচ্চতায়ও এ গাছ জন্মে থাকে। পাতা পক্ষল ও যৌগিক। বোঁটার দুই পাশে চিরুনির দাঁতের মতো সাজানো থাকে। আমলকী ফুল একলৈঙ্গিক। পুরুষ ফুল বোঁটাযুক্ত। এ ফুল ডালের ওপরের দিকে ধরে, আগে আসে এবং সংখ্যায় অনেক বেশি। স্ত্রী ফুল বোঁটাহীন ও ডালের নিচের দিকে ধরে। ফুল আকারে খুবই ছোট, খালি চোখে দেখা কষ্টসাধ্য। স্ত্রী ও পুরুষ ফুল একই শাখায় প্রস্ফুটিত হয়। আমলকী বায়ুপরাগায়িত।
আমলকী ফল মৃদু শিরাবিশিষ্ট, গোলাকৃতি, মাংসল ও রসাল। ফলের রং হালকা সবুজ বা হলুদ। ভেতরে ছয়টি বীজের সমষ্টির একটি কঠিন আঁটি থাকে। এ উপমহাদেশে আমলকীর বেনারসি জাতটি সবচেয়ে ভালো। ফল পাকে শীতকালে। আমলকী ফলের প্রতি ১০০ গ্রামে ৮১ গ্রাম পানি, ০.৫ গ্রাম আমিষ, ১৪ গ্রাম শ্বেতসার, ০.১ গ্রাম স্নেহ, ০.৭ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ৩.৫ গ্রাম আঁশ, ০.০৫ গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.০২ গ্রাম ফসফরাস, ১.৫ গ্রাম আয়রন, ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি এবং ১৪০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি আছে। প্রতি ১০০ গ্রামে ৫৯ কিলোক্যালরি তাপশক্তি বিদ্যমান।
১০০ গ্রাম আমলকীতে ভিটামিন সি আছে ৪৬৩ মিলিগ্রাম। আমলকীতে পেয়ারার তিন গুণ ও কাগজি লেবুর চেয়ে ১০ গুণ বেশি ভিটামিন সি রয়েছে। এ ছাড়া কমলার চেয়ে ১৫, আপেলের চেয়ে ১২০, আমের চেয়ে ২৪ ও কলার চেয়ে ৬০ গুণ বেশি ভিটামিন সি রয়েছে এতে।
আমলকী প্রক্রিয়াজাত করলে ভিটামিন সি-এর পরিমাণ কমে যায়, তবে আমলকির অ্যাসকরবিক এসিড স্থায়ী। কেননা, এটা ট্যানিন ও অ্যান্থোসায়ানিন দিয়ে আবৃত থাকায় সহজে অক্সিডেশন হয় না। নিষ্কাশিত ফলের রসের ভিটামিন এক সপ্তাহ পর্যন্ত অবিকৃত থাকে। একটু সচেতন হলে প্রতিটি বাড়িতে একটি আমলকী গাছ রোপণ করলে ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্য ভিটামিন সি-এর ভালো উৎস আমরা রেখে যেতে পারি। আমলকীর জেলি, মোরব্বা বেশ সুস্বাদু। ফল ফালি করে কেটে রোদে শুকিয়ে লবণ, জোয়ান ইত্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে মুখশুদ্ধি হিসেবে ব্যবহার হয়।
প্রতিদিন দুটো করে আমলকী খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ভেষজ যত ফল রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে উপরেই আছে এই ছোট্ট ফলটি। চুলের জেল্লা বৃদ্ধি, রুক্ষতা কমানো, ত্বকের উজ্জ্বলতা, পেটের গোলযোগ দূর, শরীর চাঙ্গা এমন হাজারও সমস্যার সমাধান করে আমলকি। সকালে কাঁচা আমলকী, বা ভাতে সিদ্ধ করে আমলকি খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। জেনে নিন ভেষজ আমলকীর স্বাস্থ্য উপকারিতা-
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। আমলকী কেটে কাঁচা খেতে পারলে খুবই ভাল। তবে এখন আমলকির রসও পাওয়া যায়। ভাল মানের আমলকীর রস খেতে পারলেও একই কাজ হবে। সাধারণ ঠান্ডা লাগা, সর্দি-কাশি, সংক্রমণ ছাড়াও ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, ক্যানসারের মতো রোগও ঠেকিয়ে রাখা যায় নিয়মিত আমলকীর ব্যবহারে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আমলকী খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। আমলকি এমনই একটি ভেষজ, যা খেলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। বেশিরভাগ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করতে আমলকি খাওয়ার পরামর্শ দেন। আমলকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি অন্যতম সেরা ভেষজ।
ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড মেডিকেল সেন্টারের মতে, আমলা খাওয়া অগ্ন্যাশয়ের উপর কার্যকর প্রভাব দেখায়। ইনসুলিন, যা অগ্ন্যাশয়ে উৎপাদিত হয়, রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ। আমলায় ক্রোমিয়াম উপাদান পাওয়া যায় যা একটি খনিজ এবং কার্বোহাইড্রেট বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে। এটি ইনসুলিন হরমোনকে শক্তিশালী করে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী। এতে উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়, এটি রক্তে শর্করার পরিমাণও নিয়ন্ত্রণে রাখে। আমলার উপকারিতা সম্পর্কে বলতে গেলে, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ আমলা একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। আর্কাইভস অফ ইন্টারনাল মেডিসিনে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে ভিটামিন সি স্তর এবং ডায়াবেটিসের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক রয়েছে।
ক্যানসার থেকে দূরে থাকতে আমলকী খান প্রতিদিন। আমলকিতে পলিফেনল থাকায় তা ক্যানসারের কোষের বৃদ্ধিতেও বাধা দেয়।
কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করে। গরম থেকে ঠান্ডা এবং ঠান্ডা থেকে গরম পড়ার মুখে অনেকেই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভোগেন। ইসবগুল, ওষুধ খেয়েও অনেক সময়ে উপকার হয় না। সেই সময়ে আমলকী কিন্তু বিশেষ ভাবে কাজে আসে। হজম সংক্রান্ত সমস্যা দূর করে কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখে আমলকি।
নিয়মিত আমলকি খেলে ত্বক সুস্থ থাকে। নানা রকমের চর্মরোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়াও এটি ত্বকের উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
প্রতিদিন সকালে আমলকীর রসের সঙ্গে মধু মিশে খাওয়া যেতে পারে। এতে ত্বকের কালো দাগ দূর হবে ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়বে।
দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে আমলকী খুবই উপকারী। এছাড়া চোখ লাল হওয়া, চুলকানো ও চোখ দিয়ে পানি পড়া রোধেও আমলকী বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
আমলকী শরীরের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে ব্যাথা বেদনা কমিয়ে দেয়। এক গ্লাস পানিতে দু চামচ আমলকি বেটে, দু’চামচ মধু দিয়ে খেলে সর্দি কাশিতে খুব আরাম হয়। এছাড়া দেহের অতিরিক্ত মেদ দূর করতে আমলকী বেশ কার্যকরী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমলকির ব্যবহারেই চুলের অনেক সমস্যা মিটে যেতে পারে। আমলকি দিয়ে তেল বানিয়ে মাথায় লাগালে বা ছেঁচে রস বার করে মাথায় মাখলে অনেক বেশি উপকার। চিকিৎসকেরা বলছেন, শুধু চুল ঝরে পরা নয়, নতুন চুল গজাতেও সাহায্য করে আমলকী। আর কোন কোন কাজে লাগে?
বিভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজে ভরপুর আমলকিতে রয়েছে অজস্র ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস। তা মাথায় রক্ত সঞ্চালনের মাত্রা বৃদ্ধি করে। ফলে চুল বাড়েও তাড়াতাড়ি।
আমলকীতে রয়েছে ট্যানিন এবং ক্যালশিয়াম। তা অতিরিক্ত তাপ থেকে চুলের ক্ষতি রুখে দিতে পারে। তাই চুল ঝরে পড়া অনেকটাই কমে যায়।
আমলকীর রস কয়েক দিন নিয়মিত মাথায় মাখলে চুল ঝরে পড়া অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। বিশেষ করে হরমোনের মাত্রা কম-বেশি হলে যে ধরনের চুল পড়ে, তা প্রতিরোধ করতে পারে আমলকী।
আমলকী ভিটামিন ই-র পরিমাণও বেশি। তাই শ্যাম্পু করার পর চুলে কন্ডিশনার হিসাবেও কাজ করে আমলকী। অতিরিক্ত রুক্ষ এবং পাকা চুলের জন্য আমলকীর তেল বিশেষভাবে উপকারী।
শীতে মাথায় খুশকির সমস্যা বেড়ে যায়। কারণ, মাথার ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে পড়ে। আমলকিতে রয়েছে কোলাজেন। যা চুলের ফলিকলে পুষ্টি জোগায়। মাথার ত্বকের আর্দ্রতাও বজায় থাকে।
(ঢাকাটাইমস/২৮ নভেম্বর/আরজেড)
মন্তব্য করুন