ইসলামে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ
প্রকৃতির ধর্ম ইসলাম স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে। স্বাধীনতা মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে উৎপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষ যেমন স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে তেমনি বেঁচে থাকতে চায় স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করে। মানুষের স্বাধীনচেতা প্রকৃতিতে বাধা পড়লেই বিঘ্নিত হয় তার সহজাত জীবনধারা। এজন্য ইসলাম মানুষের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রেরণা যুগিয়েছে। ‘স্বদেশকে ভালোবাসা ইমানের অঙ্গ’-এই বাণী থেকেই অনুধাবন করা যায় দেশের প্রতি আত্মিক প্রেরণা ও ভালোবাসাকে ইসলাম কতটা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে।
দেশপ্রেম একটি বহুমাত্রিক অনুভূতির প্রকাশের নাম। দেশের প্রতি যার অন্তরে ভালোবাসা বিদ্যমান দেশের মঙ্গল কামনা ও মঙ্গল সাধন তার সহজাত বিষয়। নিজের অন্তরের আকুতি যে কোনোভাবে দেশের জন্য বিলিয়ে নিজের দেশপ্রেমের প্রমাণ পেশ করে। দেশের প্রতি নিজের প্রেমটাকে যেকোনোভাবে বাঙময় করে তোলা নাগরিকের পক্ষে সম্ভব। দেশ তার একজন সন্তান ও নাগরিকের কাছে এই মঙ্গল কামনা, এই কল্যাণ সাধন ও ত্যাগের মহিমা প্রত্যাশা করে।
দশ বছর পর যখন প্রায় বিনা যুদ্ধে তিনি বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করেন তখনও তার মহানুভব হৃদয়ে ছিল স্বদেশে ফিরে আসার কোমল ও পবিত্রতাপূর্ণ এক আকুতি। নিজের দেশের মাটিতে বিজয়ীর বেশে ফিরে এসে প্রতিশোধহীনতার এক আকাশ উঁচু চেতনার ফরমান তিনি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেছিলেন-লা তাছরিবা আলাইকুমুল ইয়াত্তম ‘তোমাদের প্রতি আজ কোনো প্রতিশোধ নেই।’ দীর্ঘ তের বছর শত জুলুমে, উৎপীড়নে বিদ্ধ হওয়ার পরও দেশটি ফিরে পাওয়ার পর স্বদেশবাসীর প্রতি এই অভিব্যক্তি ও সর্বোচ্চ সদাচার ছিল একজন মহান দেশপ্রেমিকের। দেশ ফিরে পাওয়ার আনন্দে তিনি নিজের ব্যক্তিগত সব আবেগ-ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলেছিলেন।
ইসলামে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধকে সবকছিুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়ার কথা বলা হয়েছে। নববী আদর্শে গড়া সাহাবায়ে কেরামও স্বদেশকে খুব ভালোবাসতেন। হিজরতের পর মদিনায় হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় তাদের মনে-প্রাণে স্বদেশ মক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠেছিল। তারা জন্মভূমি মক্কার দৃশ্যাবলি স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। এমতাবস্থায় নবী করিম (সা.) সাহাবিদের মনের এ দুরবস্থা দেখে প্রাণভরে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি তার চেয়েও বেশি মদিনার ভালোবাসা আমাদের অন্তরে দান করুন। (বুখারি) দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম রক্ষায় রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আহবান করেছেন সাহাবায়ে কেরাম সর্বোতভাবে এ ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তারা জানতেন, নিজেদের বিশ্বাস, আদর্শ ও ধর্মমতের প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য ইসলাম প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তারা যেমন আন্তরিক ছিলেন তেমনি নিবেদিত ছিলেন দেশপ্রেম ও দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষায়।
ইসলামের আলোকে দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ মানুষকে স্বদেশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম রক্ষায় দেশপ্রেমিক নাগরিক নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। যুগে যুগে দেশপ্রেমিক নাগরিকেরা নিজের সর্বস্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন ও সুরক্ষার আন্দোলন করে গেছেন। বিশেষত যাদের ধর্ম ইসলাম, বিশ্বাসে যারা শেষ নবীর অনুসারী তাদের কাছে দেশ ও জাতির জন্য আত্মত্যাগ ও বিসর্জনের দৃষ্টান্তে ইতিহাসের পাতা ভরপুর। নিজ দেশের ওপর আঘাত এলে আদর্শ ও বিশ্বাসের ধারকেরাই সর্বপ্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। ইসলামের প্রেরণা যাদের ভেতরে কাজ করে তারা দেশ ও জাতির যে কোনো দুর্দিনে সর্বাত্মক বিসর্জনের মানসিকতা পোষণ করেন।
দীর্ঘ সংগ্রাম ও চড়ামূল্যে অর্জিত আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স ৪৬ বছর পূর্ণ হলো। একটি ভূখণ্ডের অধিকার লাভ করা অনেক গৌরবের বিষয়। শুধু পরাধীনতাই বলে দেয় স্বাধীনতা যে কত মূল্যবান সম্পদ। স্বাধীনতা আল্লাহর বিশেষ নেয়ামতও বটে। আল্লাহর দেয়া এই নেয়ামত আমাদের প্রিয় স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের। শুধু ভূখণ্ডের পরিসীমা বাহ্যত রক্ষিত থাকলেই স্বাধীনতা টিকে থাকে না। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সবদিক থেকেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হয়। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে নিজের ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটাতে না পারলে স্বাধীনতা অর্থহীন। সবদিক বিবেচনায় আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম আজও অর্থবহ হয়ে উঠেনি। এখনও ভিনদেশী পরাধীনতার নখর থাবা মাঝে মাঝেই আমাদেরকে ক্ষত-বিক্ষত করে। দেশপ্রেমিক প্রতিটি নাগরিকের উচিত অর্থবহ স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রামে আন্তরিকভাবে যুক্ত হওয়া।
মন্তব্য করুন