দেনার দায়ে পলাতক পোলট্রি খামারিরা
মহা বিপর্যয়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরব ও কুলিয়ারচর উপজেলার পোলট্রি খামারগুলো। এলাকার প্রায় ৯৫ ভাগ খামারই এখন বন্ধ। দেউলিয়া হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বন্ধ হয়ে যাওয়া খামার মালিকরা। অনেককেই বিক্রি করতে হয়েছে তাদের ভিটেমাটি।
খামারিদের দাবি, এক দিন বয়সী একটি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দাম ২০১২ সালের দিকে ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। কিন্তু সেই বাচ্চাই গত বছর থেকে কিনতে হচ্ছে প্রায় ৭০ টাকায়। এ ছাড়া ৪০ কেজি ওজনের এক বস্তা মুরগির খাবার ২০১২ সালের দিকে ছিল ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা। সেই বস্তাই এখন কিনতে হচ্ছে এক হাজার ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়। শুধু তাই নয়, গত পাঁচ বছরে খামারে মুরগির ওষুদের দাম বেড়েছে প্রায় ২০ ভাগ। কিন্তু সেই তুলনায় ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়েনি। যাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন খামারিরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভৈরব ও কুলিয়ারচরে লাভজনক ব্যবসা হিসেবে আশির দশকের মাঝামাঝিতে শুরু হয় পোলট্রি খামার। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ আকারে প্রায় এক হাজার ৪০০-৫০০ ব্রয়লার ও লেয়ার পোলট্রি খামার গড়ে ওঠে সেখানে। ওই সব খামারে উৎপাদিত মাংস ও ডিম স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেত। এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সেখানে অন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে। সেখানে কর্মসংস্থান হয় অনেকের।
স্থানীয়দের দাবি, গত চার-পাঁচ বছর ধরে ব্রয়লার ব্যবসায় অনেকটা ধস নেমেছে। মুরগির বাচ্চা, খাবার, ওষুধের দাম যে হারে বাড়ছে, সেই তুলনায় মুরগির দাম বাড়েনি। অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বাচ্চা, খাবার ও ওষুধ কিনে সেই অনুযায়ী মুরগি বিক্রি করতে না পারায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন খামারিরা। এতে করে ওই এলাকার প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ খামারই এখন বন্ধ। আর তাতেই পুঁজি হারিয়ে ও ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন খামার মালিকরা।
ভৈরব শহরের চণ্ডিবরের মধ্যপাড়া এলাকার আল আমিন মিয়া ব্রয়লার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ২০ বছর ধরে। তিনি বলেন, প্রথম অবস্থায় লাভজনক হওয়ায় বেশ মুনাফাও করেছেন তিনি। ওই সময় তিনি চারটি খামার গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে অনেক শ্রমিকও কাজ করত।
রসুলপুর গ্রামের খামারি এমা। গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহত লোকসানের কারণে একে একে তাঁর সব খামার বন্ধ হয়ে যায়। মুনাফার বদলে এখন তিনি ঋণগ্রস্ত। সেই ঋণের চাপে তিনি এখন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
একই এলাকার উত্তরপাড়ার আবদুর রহিম জানান, তিনি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে থাকতেন। কয়েক বছর বিদেশে থেকে যে অর্থ উপার্জন করেছিলেন, তা দিয়ে গড়ে তোলেন ব্রয়লার মুরগির খামার। লোকসানের কারণে ব্রয়লার ব্যবসা বন্ধ করে এখন তিনি বেকার। মাথায় ঋণের বোঝা, বুঝে উঠতে পারছেন না এখন তিনি কী করবেন।
কুলিয়ারচরের উসমানপুর এলাকার নয়ন মিয়ার বিশাল দুটি খামার এখন বন্ধ। বাড়ি ছেড়ে তিনিও ঋণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁর বড় ভাই জানান, নয়ন ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা লোকসানে পড়েছে। তাই ঋণের দায়ে বেশ কয়েক মাস আগেই বাড়ি ছেড়েছে।
একই এলাকার দুবাই ফেরত মামুন মিয়া জানান, তিনি দুই বছর আগে দেশে ফিরে ১২ লাখ টাকা দিয়ে ব্রয়লার মুরগির খামার গড়ে তোলেন। এই দুই বছরে সব টাকা খুইয়ে এখন তিনি নিঃস্ব। তাই মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।
এসব বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা পোলট্রি মালিক অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মো. দেলোয়ার হোসেন লিটন বলেন, ব্রয়লারের বাচ্চা ও খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মালিকরা অতি মুনাফা নিচ্ছেন। তাই এ অঞ্চলের পোলট্রি খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ শিল্প রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
ভৈরব উপজেলার ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, মুরগির রোগ মোকাবিলায় ওষুধ কিনতে একটা বড় অর্থ খরচ হচ্ছে। এই খরচ শেষে বাজারে সেই অনুপাতে মুরগি বিক্রি হচ্ছে না। এতে এলাকায় এখন মাত্র পাঁচ শতাংশ খামার অবশিষ্ট আছে। এই সংকট থেকে উত্তরণে বাচ্চা ও খাদ্যের পাশাপাশি ওষুধের দাম কমানোসহ বাজার দেখাশোনার পরামর্শ দেন তিনি।
এ বিষয়ে ভৈরব উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, লোকসানের মুখে খামারিরা ব্রয়লার ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন। এ সংকট কেটে গেলে এখানকার পোলট্রি শিল্প আবার চাঙ্গা হবে।
তবে কুলিয়ারচর উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মো. হাবিবুননবী বলেন, একদিন বয়সী একটি বাচ্চার দাম সর্বোচ্চ ৪০ টাকা হলে মুরগির বর্তমান বাজারে খামারিরা লাভবান হবেন। আর যদি বাচ্চার দাম এমনই থাকে, তবে মুরগির বাজার দর বাড়াতে হবে।
(ঢাকাটাইমস/০২মে/প্রতিনিধি/এএইচ)
মন্তব্য করুন