এসএসসিতে ফলে পিছুটান এবং শিক্ষার মান

সৈয়দ শিশির
| আপডেট : ২৫ মে ২০১৭, ১৩:০৮ | প্রকাশিত : ২৫ মে ২০১৭, ০৮:৫৫

পরীক্ষার প্রশ্নে ভুল কিংবা প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, পরীক্ষার খাতায় নম্বর দেওয়া হয়নি কিংবা ভুল নম্বর দেওয়া হয়েছে- এসব যেন এখন সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। অবাক হতে হয় যখন শুনি কোনো বিষয়ে কয়েক শ ছাত্রছাত্রীর ফল প্রকাশে ভুল হয়ে যায়। আর এই নিয়ে যখন শোরগোল হয় তখন তড়িঘড়ি সংশোধনের ব্যবস্থা করে পরীক্ষার গোটা ফলেই পরিবর্তন ঘটানো হয়। এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরও সারা দেশে একটি সাড়া পড়ে গেল- ‘ফল ভালো হয়নি, বিপর্যয়।’ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের সদস্যরা নানাভাবে ফল বিপর্যয়ের কারণ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলছে, উত্তরপত্র মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে বলে এবারের ফল এমন হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত বছর শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৭৩৪টি। এবার শতভাগ উত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠান কমেছে ২ হাজার ৪৬৮টি। অন্যদিকে ৯৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে এবার কোনো শিক্ষার্থী পাস করেনি, গত বছর যা ছিল ৫৩টি। অর্থাৎ এবার শূন্য পাসের প্রতিষ্ঠান বেড়েছে ৪০টি।

নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন, প্রশ্নফাঁস রোধ ও পরীক্ষাকেন্দ্রে কড়াকড়ির কারণে এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তবে গত বছরের তুলনায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়াকে বিপর্যয় মানতে নারাজ নাহিদ। তিনি বলেন, ফলাফল বিপর্যয় মনে হলেও আসলে এটি বিপর্যয় নয়, এ বছর সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে। মূল্যায়নের বিষয়গুলো তুলে ধরে নাহিদ বলেন, এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে অবমূল্যায়ন বা অতিমূল্যায়ন রোধে বোর্ডগুলো বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রধান পরীক্ষকদের উত্তরমালা প্রণয়নের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রণীত নমুনা উত্তরমালার আলোকে উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়। পরীক্ষকদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের গুণগতমান যাচাইয়ের জন্য একটি প্রশ্নমালা সব প্রধান পরীক্ষককে সরবরাহ করা হয়েছে। এ কারণে এবার সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে। তিনি বলেন, এবার নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি স্ট্যান্ডার্ড নিয়ম ফলো করা হয়েছে। এসব কারণে এবার খাতা দেখার ক্ষেত্রে সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে। এক-দুই নম্বরের পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু সেই রকম কোনো পার্থক্য এবার হয়নি।

শিক্ষামন্ত্রীর ব্যাখ্যা আমার একেবারে অযৌক্তিক মনে হয়নি। কেননা, পাঠ্যবই কিংবা সিলেবাসের বাইরে তো প্রশ্ন হয়নি। তাই বলা যায়, শিক্ষক যদি পাঠ্যবই ভালো করে পড়াতেন আর শিক্ষার্থীরাও পড়ত তাহলে বইয়ের যেখান থেকে যেভাবেই প্রশ্ন আসুক না কেন, শিক্ষার্থীরা উত্তর দিতে পারত। কিন্তু শুধু তা না হওয়ার কারণেই কি ফল বিপর্যয়? না, আরও কারণ আছে বলে মনে করি। যেমন শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টারের ওপর ভরসা, গাইড বই ফলো করা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষকদের কেন যথাসময়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি? শিক্ষকদের খাতা দেখার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার আগে নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীদের উত্তর লেখার প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন ছিল। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়গুলোতে কি যথাসময়ে প্রশ্ন ও উত্তরের একাধিক নমুনা সরবরাহ করা যেত না?

মানছি, নতুন পদ্ধতির মডেল উত্তরপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষক ধারণা পান একজন শিক্ষার্থী কী কী এবং কতটুকু লিখলে কত নম্বর পাবে। ফলে সারা দেশে উত্তরপত্র মূল্যায়নে সমতা থাকে। অনেক দেশে দীর্ঘদিন ধরেই পরীক্ষকরা মডেল উত্তরের সঙ্গে মিলিয়ে মার্কিং করছেন। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে আমাদের দেশে এ পদ্ধতি ঠিক মনে হলেও এর প্রয়োগে গলদ রয়ে গেছে। তাছাড়া উত্তরপত্র মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের আগে থেকে না জানানো মানে শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও বাড়িতে পড়াশোনা কিংবা পরীক্ষার প্রস্তুতিতেই গলদ ছিল। তাহলে কি বলা যায় না যে, শিক্ষা কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং শিক্ষা ও পরীক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ইচ্ছামতো পরীক্ষা-নিরীক্ষার শিকার হয়েছে এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীরা।

বিষয়টি নিয়ে এত হইচই হওয়ার কারণ হচ্ছে, গত দেড় দশকে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রম ঊর্ধ্বগতির পর হঠাৎ করেই এবার পতন ঘটেছে। অকৃতকার্য হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী। বলা যায়, প্রতি ৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে একজন অকৃতকার্য হয়েছে। এদিকে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের ৪ মে প্রকাশিত এসএসসির ফল বিপর্যয়ের বিষয়ে জানতে চেয়ে এ বোর্ডের অধীন ৬ জেলার মোট ৯৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের নিকট কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রেরণ করা হয়েছে। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে ১৬ মে এ তথ্য জানা গেছে। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল খালেক গণমাধ্যমকে বলেন, হঠাৎ কুমিল্লা বোর্ডের ফল পতিত হওয়ায় আমরা অনেকটা হতাশ। এর কারণ ও করণীয় সম্পর্কে জানতে বিদ্যালয়গুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জবাব আসার পর মাঠ পর্যায়ে গিয়ে তা সমাধানের চেষ্টা করা হবে। তবে সমাধানটা কী ধরনের হতে পারে সেই বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। সমস্যা চিহ্নিত হলে ভবিষ্যতে হয়ত সুফল মিলতে পারে। কিন্তু এবার যারা অন্যের ভুল কিংবা গাফিলতিতে অকৃতকার্য হলো, তাদের কী হবে?

৪ মে প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০ বোর্ডে গড় পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা গতবারের চেয়ে ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ কম। এবার ১০ বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬১, যা গতবারের চেয়ে ৫ হাজার কম। আর ৮টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসিতে পাসের হার গতবারের চেয়ে ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ কমেছে। এবার পাসের হার ৮১ দশমিক ২১ শতাংশ। তবে এসএসসিতে জিপিএ-৫ বেড়েছে ১ হাজার ১৯৫। এসএসসিতে মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯৭ হাজার ৯৬৪ জন। এক্ষেত্রে জিপিএ-৫ বাড়িয়েছে মূলত বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা। মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় জিপিএ-৫ গতবারের চেয়ে কমেছে। শুধু বিজ্ঞান শাখায় জিপিএ-৫ বেড়েছে ২ হাজার ৬৫৪। আর মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দাখিল পরীক্ষায় এবার অংশ নিয়েছিল ২ লাখ ৫৩ হাজার ৩৪৪ শিক্ষার্থী, যা গত বছর ছিল ২ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৬ জন। দাখিলে এবার পাস করেছে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৫১ জন, গত বছর এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল ২ লাখ ১৭ হাজার ৩১৪ জন। এবার মাদ্রাসায় গড় পাসের হার ৭৬ দশমিক ২০ শতাংশ, গত বছর যা ছিল ৮৮ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ মাদ্রাসায় এবার পাসের হার কমেছে ১২ দশমিক ০২ শতাংশ। এছাড়া মাদ্রাসা বোর্ডে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে মোট ২ হাজার ৬১০ জন, যা গত বছর পেয়েছিল পাঁচ হাজার ৮৯৫ জন। এক বছরে দাখিলে জিপিএ-৫ কমেছে ৩ হাজার ২৮৫টি।

প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ ছিল যে উদারভাবে খাতা মূল্যায়নের নির্দেশ দিয়েই পাসের হার বাড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করে সরকার। যদিও সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই অভিযোগ কখনো স্বীকার করেনি। কিন্তু এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ার বদলে ৭.৯৪ শতাংশ কমে ৮০.৩৫ শতাংশে নেমে আসলে শিক্ষামন্ত্রী স্বীকার করলেন, আগে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে পরীক্ষকদের গাফিলতি ছিল! শুধু কি তাই? ফল বিপর্যয় সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, এবার নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়েছে, যাতে পরীক্ষার্থীরা আগের মতো ‘ঢালাও’ নম্বর পায়নি। যদি তাই হয় তাহলে যে দেশের শিক্ষার মান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে। তাছাড়া বিগত বছরগুলোতে কৃতকার্যদের কি তাহলে কোনোভাবে খাটো করা হলো না?

এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, বাংলাদেশ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে পেছনের দিকে যাচ্ছে! সংশ্লিষ্টরা কি এর কারণ ভেবেছেন? আমার বক্তব্যের সমর্থনে বলছি, এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন একটু ব্যতিক্রম হওয়ায় ফল নিয়ে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। তাহলে কি বলা যায় না যে, নতুন প্রবর্তিত মূল্যায়ন পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জন্য সুফল না হয়ে কুফল হয়ে দাঁড়িয়েছে? এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কে? শিক্ষার্থীরা যে বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে সে বিদ্যালয় কি দায়ী নয়? কারণ শিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার মানোন্নয়ন ও দেশে সঠিক মেধাসম্পন্ন লোক তৈরির জন্য বিদ্যালয়গুলো তদারকি করে থাকে, বিভিন্ন কারিকুলাম তৈরি করে থাকে এবং বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার কাজ করেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তারা কি শতভাগ দায়িত্ব পালন করছেন? অভিযোগ শোনা যায়, দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে চলছে শিক্ষার নামে কোচিং বাণিজ্য। শিক্ষকরা ক্লাসের পড়ার চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে কোচিং কিংবা প্রাইভেট নামের শিক্ষা বাণিজ্য নিয়ে। টাকা রোজগার করাটাই তাদের অনেকের লক্ষ্য; শিক্ষার্থীরা কী শিখল সেটা যেন বড় কথা নয়। অবাক হতে হয় যখন শুনি, সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক শিক্ষকের স্পষ্ট কোনো ধারণাই নেই।

প্রকৃত অর্থে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী শিক্ষানীতি গ্রহণ করতে হবে। বলতে চাচ্ছি, এমন নীতি, যে নীতি গ্রহণ করলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সহজে বুঝতে পারবে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের বইয়ের বোঝাও কমাতে হবে। ঘন ঘন শিক্ষানীতি ও সিলেবাস পরিবর্তন করা যাবে না। শুনেছি, আমাদের শিক্ষা কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিদেশে শিক্ষা প্রশিক্ষণে যান। সেখানে গিয়ে তাদের শিক্ষা পদ্ধতি দেখে ফিরে এসে তা দেশে চালু করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর তাতেই বিপত্তি ঘটে। কারণ সেই পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের দেশের শিক্ষকদের যে প্রাথমিক কোনো ধারণাও থাকে না। এবারের এসএসসির ফল বিপর্যয় তেমন কোনো বাস্তবতা বলেই ধরে নেওয়া যায়।

সৈয়দ শিশির: কবি ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :