মা যখন কর্মজীবী

রুকসানা পারভীন
  প্রকাশিত : ১১ জুন ২০১৭, ১২:৫১
অ- অ+

আমাদের সমাজে সবসময় মেয়েদেরকে শারীরিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বা মানসিক দিক থেকে একটু দুর্বল ভাবা হয়। আগে একটা সময় ছিল যখন মনে করা হত মেয়েরা শুধু বাসায় থাকবে, ঘরের কাজ করবে, বাচ্চা লালন পালন করবে। এখানে লিঙ্গগত ভূমিকা শিক্ষণ (Gender role learning)একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়। এটা আমাদের সামাজিক শিক্ষণের একটি অংশ। ছোটবেলা থেকেই আমাদেরকে শেখানো হয় কোনটা ছেলেদের কাজ আর কোনটা মেয়েদের কাজ।

কিন্তু এখন সময়ের সাথে সাথে মেয়েরা তাদের যোগ্যতা ঘরের বাইরেও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। ছেলেরাই শুধু অর্থ উপার্জনকারী এই চিরায়ত প্রথাকে ভেঙে তারাও অর্থ উপার্জন করছে, প্রয়োজনে ঘরের বাইরে কাজ করছে। এতে করে মেয়েদের দায়িত্ব অনেকাংশে বেড়ে গেছে। বাস্তবতা হল কর্মজীবী মেয়েদের এখন ঘরের এবং বাইরের (অফিসের) সব কাজই সমানভাবে সামলাতে হচ্ছে। আর মেয়েটা যখন একজন মা তখন তো তার দায়িত্ব আরও অনেক বেশি।

অর্থ উপার্জন নারীকে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, স্বাধীনতা এবং স্বাবলম্বীতা দিয়েছে। কর্মজীবী মায়েরা তাদের সন্তান এবং পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা সহজেই করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মজীবী মায়ের মেয়েরা তুলানামুলক বেশি বুদ্ধিমতি, উচ্চশিক্ষিত এবং ক্যারিয়ারের প্রতি বেশি সচেতন হয়। ইদানীং কর্মজীবী মায়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রচলিত লিঙ্গভিত্তিক আচরণ কমে যাচ্ছে, ছেলেরাও গৃহস্থালী কাজে মেয়েদের সাহায্য করছে।

অনেক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও একজন কর্মজীবী মাকে প্রতিনিয়ত অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন:

১। শারীরিক এবং মানসিক চাপ: একজন কর্মজীবী মাকে প্রতিনিয়ত শারীরিক এবং মানসিক চাপ মোকাবেলা করতে হয়। যেহেতু তাকে বাসার এবং অফিসের কাজ দুটোই সামলাতে হয়। মা যখন অফিসে থাকেন তখনও সন্তানের চিন্তা তাঁকে ভাবায়। এতে করে মা সবসময় একটা মানসিক চাপ বোধ করেন।

২। সময় বন্টন: একজন কর্মজীবী মা সবসময় সময় বন্টন নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হন। অফিসের কাজ এবং বাসার কাজ কোনটা কখন এবং কীভাবে করবেন। অবশ্যই একজন শুধু গৃহিনী বা একজন শুধু কর্মজীবী নারী, যার ছোট বাচ্চা নেই তার থেকে একজন কর্মজীবী মায়ের কাজ এবং দায়িত্ব অনেক বেশি।

৩। অপরাধবোধ: আমরা সবাই জানি সন্তানের জন্য মায়ের সান্নিধ্য এবং যত্ন কতটা গূরুত্বপূর্ণ। একজন কর্মজীবী মা কাজের প্রয়োজনে অনেকটা সময় বাইরে থাকেন, সন্তানকে কম সময় দিতে পারেন। এ কারণে তিনি অনেক সময় অপরাধবোধে ভুগতে পারেন। আর এই অপরাধবোধে ভোগার কারণেই অনেক মা চাকরি ছেড়ে দেন।

৪। মানসিক দ্বন্দ্ব এবং হতাশা: বাসায় বাচ্চার দেখাশোনা করার জন্য যদি পর্যাপ্ত মানুষ না থাকে মা সব সময় দ্বন্দ্বে ভোগেন। যেমন, চাকরি করবেন নাকি করবেন না, ডে-কেয়ার সেন্টারে দেবেন নাকি দেবেন না; এরকম আরো অনেক। এই দ্বন্দ্ব বেশিরভাগ সময় হতাশায় রূপ নেয়।

৫। সন্তানের শারিরীক এবং মানসিক বিকাশ: যৌথ পরিবারে মা-বাবা ছাড়াও বাচ্চার অনেক আপনজন থাকে। সেক্ষেত্রে মা বাইরে কাজ করলেও পরিবারের অন্য সদস্যরা বাচ্চার দেখাশোনা করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে একক পরিবারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কাজের মেয়ে বা ডে-কেয়ার সেন্টারই কর্মজীবী মায়েদের ভরসা। যদিও এদের সেবার মান প্রশ্নবিদ্ধ। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘসময় আপনজন ছেড়ে থাকা শিশুর শারিরীক ও মানসিক বিকাশে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

৬। অন্যের মন্তব্য: কারও প্রশংসা বা উৎসাহ সূচক কথা যেমন আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, তেমনি কারও নেতিবাচক মন্তব্য অনেক সময় আমাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়। কর্মজীবী মায়েদের প্রতিনিয়ত অনেক নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয়।

৭। বাচ্চার অসুস্থতা: ‘হাভার্ড উমেনস হেলথ স্টাডি’র বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্মজীবী মায়েরা অন্য যেসব মায়েরা বাসায় থাকে তাদের তুলনায় ঘন ঘন অসুস্থ হয়। তাদের মানসিক চাপ, উদ্বিগ্নতা এবং হৃদরোগে ভোগার ঝুঁকি বেশি। সন্তান জন্মদানের পর শরীরে পুষ্টির ঘাটতি, অতিরিক্ত কাজের চাপ পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব এর কারণ হতে পারে। এছাড়াও নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মজীবী মায়ের বাচ্চারা তুলনামুলকভাবে দুর্ঘটনা ও অ্যাজমাসহ অন্যান্য রোগে বেশি ভোগে।

অতিরিক্ত কাজের চাপ, দ্বন্দ্ব, হতাশা যেকোন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর। এর প্রভাবে সাধারনত মনোযোগের অভাব, খিটখিটে মেজাজ, অন্যের সাথে খারাপ ব্যবহার ইত্যাদি নেতিবাচক আচরণ দেখা যায়। আর এগুলো মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করে। অনেকসময় ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, সম্পর্কে ফাটল ধরে।

সমস্যা তো আছেই, এগুলোকে সমাধান করতে পারা, তাল মিলিয়ে চলতে পারাই তো জীবন। আর তাই কর্মজীবী মায়েদের জন্য কিছু পরামর্শ:

১। মেনে নিন আপনাকে একজন সাধারণ গৃহিণীর চেয়ে বেশি কাজের চাপ নিতে হবে। এই ধরনের মানসিকতা আপনাকে মানসিক শক্তি যোগাবে।

২।কাজের চাপ কমাতে আগে থেকেই কর্মপরিকল্পনা তৈরি করুন। প্রয়োজনে কাজগুলোকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিন।

৩। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, নিয়মিত ঘুমানোর অভ্যাস করুন; ঘুম শরীরের ক্লান্তি দূর করে নতুন শক্তি যোগায়। অফিসেও কাজের ফাঁকে কিছুটা বিশ্রাম/বিরতি নিন।

৪। নিয়মিত এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন। সময়ের অভাব- এই অজুহাতে কম বা অপুষ্টিকর খাবার খাবেন না। মনে রাখবেন, বাচ্চা জন্মদানের পর শরীরে পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেয়। আর বাচ্চা যতদিন বুকের দুধ খায় আপনার শরীরে প্রচুর পুষ্টির যোগান দরকার। তাই প্রচুর শাকসবজি, ফলমূ্ল, তরল খাবার (যেমনঃ শরবত, স্যুপ) এবং শস্যজাতীয় খাবার খান।

৫। ডাক্তারের পরামর্শমত হাল্কা ব্যায়াম করতে পারেন। এই যেমন সকাল বিকাল কিছুক্ষণ হাঁটা, ইয়োগা; মেডিটেশনও করতে পারেন। সাইকিয়াট্রি রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মায়েরা আট সপ্তাহ ধরে দিনে অন্তত ৩০ মিনিট করে মেডিটেশন করেছে তাদের মানসিক চাপ এবং উদ্বিগ্নতা কমেছে। ইন্টারনেটে মেডিটেশনের নির্দেশনা পাবেন।

৬। অফিসে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আপনার অবস্থার কথা জানিয়ে রাখুন এবং সহকর্মীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন। প্রয়োজনে তাদের সাহায্য নিন।

৭। যার কাছে বাচ্চার দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন তাকে সবকিছু ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়ে যান। যেমন: বাচ্চার খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, কোন বিশেষ সতর্কতা থাকলে সেটা, ওষুধ ইত্যাদি। প্রয়োজনে প্রতিদিনই মনে করিয়ে দিন।

৮। কাজের ফাঁকে সময় করে বাচ্চার খোঁজখবর নিন, এতে আপনার মাতৃ্মন শান্ত থাকবে। বাচ্চার পরিচর্যাকারীর সাথে যোগাযোগের ব্যাবস্থা রাখুন।

৯। পরিবারের সদস্য ভিন্ন অন্য কারো কাছে বাচ্চা থাকলে তাকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করবেন না। সে আপনার বাচ্চার ঠিকমত যত্ন নিচ্ছে কি না- তা যাচাই করুন। মাঝে মাঝে সময়ের আগে বাসায় ফিরতে পারেন। তবে তার সাথে কখনও খারাপ আচরণ করবেন না। তাকে আপনার সন্তানের বন্ধু হতে সাহায্য করুন।

১০। অতিরিক্ত কাজের চাপ কমাতে বাসার কাজে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাহায্য নিন। প্রয়োজনে একেকজন একেকটা কাজের দায়িত্ব ভাগ করে নিন।

১১। অফিস থেকে বাসায় ফিরেই কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবেন না। বাচ্চাকে সময় দিন তার সাথে খেলুন, গল্প করুন, সারাদিন কী কী করলো, মন দিয়ে শুনুন। এতে করে আপনি যেমন জানতে পারবেন সারাদিন সে কি কি করল; সেও তেমনি আনন্দ পাবে, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাববে।

১২। অফিসে যাওয়ার সময় বাচ্চার কান্না দেখে যাওয়া যেকোন মায়ের জন্যেই কষ্টকর। বাচ্চার ছোট বয়স থেকেই প্রতিদিন বাইরে যাওয়ার সময় ওর কাছ থেকে বিদায় নিন, ওকে Good bye বলুন। ওকে বলুন আপনি কেন বাইরে যাচ্ছেন এবং কাজ শেষ হলেই দ্রুত ফিরে আসবেন। এতে ও আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হবে।

সর্বোপরি নিজের যত্ন নিন, নিজেকে কিছুটা সময় দিন। বাচ্চা এবং পরিবারের সাথে যে সময়টুকু থাকবেন সেটুকু গুনগত সময় কাটান। গল্প, আড্ডা, গান গাওয়া/শুনা, সবাই একসাথে ভালো কোন মুভি দেখা, ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যাওয়া এগুলো একঘেয়েমি দূ্র করতে সাহায্য করবে এবং নতুন শক্তি যোগাবে। মনে রাখবেন আপনি ভাল থাকলেই বাচ্চার এবং অন্যদের যত্ন নিতে পারবেন, সব কাজ ঠিক মত করতে পারবেন। তাই নিজের যত্ন নিন এবং ভাল থাকুন।

প্রভাষক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, আইইউবিএটি ইউনিভার্সিটি, উত্তরা, ঢাকা।

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বিজয় দিবসে ঢাকা মহানগর ছাড়া সারা দেশে বিএনপির র‌্যালি
১৬ বছরের দুঃশাসন শেষ হতে ১৬ দিন লাগেনি: অসীম
মঈন খানের বাসভবনে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের মধ্যাহ্ন ভোজ
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর করা হবে: তারেক রহমান
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা