জলজট রঙ্গ

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
| আপডেট : ২৬ জুলাই ২০১৭, ২১:৫৭ | প্রকাশিত : ২৬ জুলাই ২০১৭, ২১:২৮

চেরাগ আলী নতুন বিয়ে করেছেন। খুব নতুনও নয়। মাস ছয় হয়েছে। ছয় মাস ধরেই পরিকল্পনা করছেন মধুচন্দ্রিমায় যাবেন। সবকিছু গুছিয়ে আনেন ঠিক। শেষে গিয়ে দেখা যায় ‘পরি’ উড়ে গেছে। কল্পনা আছে। এবার ঠিক করলেন বউকে নিয়ে যাবেন কক্সবাজার। সমুদ্র দেখাতে। তিনি নিজেও কোনোদিন সাগরপারে যাননি। লোকে বলে সমুদ্রের দিকে চাইলে নাকি মন বড় হয়।

চেরাগ আলী স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে নামলেন খুব ভোরে। বাস থেকে নেমেই চোখ বড় বড় করে ফেললেন। এ তিনি কোথায় এলেন! তিনি তো চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার যাবেন ঠিক করেছিলেন। বাস কি তবে ভুল করে কক্সবাজারেই চলে এসেছেন? শহরের রাস্তাঘাট, অলিগলিতে পানি আর পানি। পানিতে নৌকা ভাসছে। তিনি মনে মনে একরকম খুশিই হলেন। যাক ভালোই হয়েছে। পয়সা খরচ করে পানি দেখতে আর কক্সবাজার যেতে হবে না। চট্টগ্রাম শহরেই একটুকরো সাগর পেয়ে তিনি মহাখুশিতে বউকে বললেন, ‘দেখলে বউ! একেই বলে সাগর। কী পানি! কী ¯্রােত! যাক কষ্ট করে আর কক্সবাজার যেতে হবে না। সাগরই চলে এসেছে চট্টগ্রাম শহরে।’ বউ গ্রামের মেয়ে। স্বামীর কথায় বিশ^াস রেখে বলে, ‘চলেন, আমরা নৌকায় উঠি।’

চট্টগ্রাম শহর নিয়ে এমন হাস্যরসের কমতি নেই। পানিতে তলিয়ে যাওয়া শহর নিয়ে যে যার মতো গল্প ফাঁদছেন। লিখছেন। ছবি আঁকছেন। সেই লেখা উঠে যাচ্ছে ফেসবুকে। ছবিও লটকে দেয়া হচ্ছে। লাইকের পর লাইক। কমেন্টের পর কমেন্ট। অনেকে ঠাট্টা করে বলছেন, তোমরা যারা ইতালির ভেনিস শহর দেখতে চাও, কম খরচে একবার চট্টগ্রাম ঘুরে যাও।

চট্টগ্রাম ইংরেজিতে লিখতে গেলে পাল্টে যায়। লিখতে হয়, চিটাগং। লোকে এখন ঠাট্টা করে বলে, ব্রিটিশেরা আগেই বুঝেছিল, এই শহর একদিন ‘গাং’ হবে। তাই তারা আগেভাগেই নাম রেখে গেছে। একেই বলে দূরে দেখা ব্রিটিশ।

টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামই তলিয়ে গেছে? তা নয়। ঢাকাও পিছিয়ে থাকেনি। বুধবার সকালে যারা মতিঝিল এলাকায় কাজে গিয়েছেন, তারা মতিঝিল নামের সার্থকতা দেখেছেন। এত দিন যারা সময়-সুযোগ পেলেই জানতে চাইতেন, আচ্ছা ভাই মতিঝিলের নাম মতিঝিল কেন? এখানে তো বিল/ঝিলের বালাই নাই! আমি নিশ্চিত আজকের পর থেকে তারা আর এই প্রশ্ন করবেন না। কারণ, মতিঝিলে ঝিল নেই কথাটা মোটেও ঠিক না। পানিতে টইটুম্বুর মতিঝিল দেখার পর ‘এখানে ঝিল কোথায়’ বলে গলা শুকানোর দিন শেষ।

ফেসবুক খুলে বসলে হাসতে হাসতে পেটে খিল লাগার দশা। গা ঝাঁকিয়ে হাসা যাদের অভ্যাস তাদের কাছ থেকে দূরে থাকাই ভালো। এই দেশের মানুষ যে কতটা সৃজনশীল ফেসবুকে মাঝেমধ্যে তার সামান্য নমুনাই পাওয়া যায়। বাস্তব ছবির সঙ্গে সংলাপ জুড়ে দিয়ে যে ফটোটুন করা হয় তা হাতে আঁকা কার্টুনের চেয়ে কম না। এক বিদেশি ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চট্টগ্রাম শহরের টইটুম্বুর অবস্থা দেখে বিস্মিত হয়ে বললেন, হাউ ফানি! হেসে জবাব দিচ্ছেন এক রিকশাচালক। বললেন, কোমর ফানি স্যার...। এই ফটোটুনের উপরে লম্বা করে লেখা- আইয়োনা আইয়োনা আঁরার দেশত।

২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাতারে স্বর্ণ জেতা মার্কিন মাইকেল ফেলপসকেও দেখা গেছে চট্টগ্রামের রাস্তায় সাঁতার কাটতে। অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। ফেলপসের এই ছবি ফেসবুকে এখন ভাইরাল। লাইক, শেয়ার কমেন্টে ফেলপসের নিজের কোনো পোস্ট এতটা ভাইরাল হয়েছে কি না কে জানে। ফেলপস দেখলে নিশ্চিত খুশি হতেন। অবশ্য অফিস যেতে যাদের তাড়া বেশি তারা ফেলপসকে গুরু মেনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। রিকশা কিংবা বাসের আগে যেতে পারবেন, এটা নিশ্চিত।

বৃষ্টি নিয়ে গানও লিখে ফেলেছেন কোনো কোনো ভাবুক। পাগলা খাবি কি ঝাঁজেই মরে যাবি-গ্রুপ ‘টুনির মা’ বৃষ্টি ভার্সন (২.০) নামে ওই গানটিও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ‘ও বৃষ্টির মা তোমার বৃষ্টি কথা শোনে না/ ২ দিন ধরে পড়েই যাচ্ছে, একটু থামে না।’

রাস্তায় হাঁটু পানিতে নৌকা নামিয়ে যারা পার হয়ে যাচ্ছেন তাদের জন্য ভয়ের কারণ ‘হাঙর’। চমকে গেলেন? করার কিছু নেই। হাঙর যখন পিঠ উঁচিয়ে রাস্তার পানিতে ভেসে বেড়ায় তখন চমকে যাওয়া ছাড়া কী বা করার আছে! তবে ভয় পাবেন না। এটা সত্যি বলে মনে হচ্ছে না। ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা ছবিটিতে কারসাজি করা হয়েছে। তবে বাকিটুকু সত্যিই।

জলজট উপভোগ করতে সড়কে চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে পড়েছে একটি পরিবার। সবার হাতে চায়ের কাপ। পানিতে বসে তাদের এই জলযাপন খারাপ না, কী বলেন? সুযোগ থাকলে আপনিও বাড়ির সামনের রাস্তায় গোল টেবিল বৈঠক করুন। তারপর ছবি তুলে দেখিয়ে দিতে পারেন ফেসবুক বন্ধুদের। যা-ই বলুন, জাতি হিসেবে আমরা কিন্তু দারুণ আইডিয়াবাজ। তা না হলে এমন পানিপথে বৈঠক কীভাবে হতো?

চট্টগ্রাম ওয়াসার একটা সাইনবোর্ড নিয়ে হুলুস্থুল কারবার। হলুদ বোর্ডে লাল মোটা হরফে লেখা, সাবধান। তারপর নিচের অংশটুকু পড়লে না পেটে খিল পড়তে পারে। ‘সামনে চট্টগ্রাম।’ পানিতে অর্ধেক ডুবে থাকা এই সাইনবোর্ডটি দেখে কেউ যদি চট্টগ্রামের পথে পা না বাড়ায় তাতে করার কিছু নেই। ‘সাবধান’ করার পর কে চাইবে বিপদে...।

তাই বলে সব সাইনবোর্ডকে ফান ভাবার সুযোগ নেই। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় ডিএমপির ট্রাফিক উত্তর বিভাগের একটা নির্দেশনায় বলা হয়েছে- ‘পানির নীচে রাস্তা ভালো’। জনবান্ধব সিদ্ধান্ত। পানির নিচে কী আছে তা চালক কীভাবে জানবেন? খানাখন্দ আর কম নেই ঢাকার রাস্তায়! ট্রাফিক বিভাগের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে হয়। জলজট রঙ্গের আড়ালে বাস্তবতাও তো আছে। কঠিন কথা সব সময় কঠিন করে বলা ঠিক না। রঙ্গ করে বললেও যদি কর্তৃপক্ষের বোধদয় হয়। তাহলে রঙ্গই হোক। খারাপ কী?

লেখক: সাংবাদিক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :