নিজেদের নিয়েই ‘দুর্ভাবনায়’ আওয়ামী লীগ

তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২২ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:১৬
গত বৃহস্পতিবার আজিমপুরে আ.লীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষের সময় মোটরসাইকেলে আগুন দেয়া হয়

‘এ বছর আমরা অনৈক্য অ্যাফোর্ড করতে পারব না। আওয়ামী লীগের জন্য সমর্থনের কোন কমতি নেই। কিন্তু দলের ভেতর কিছু সমস্যা আছে। সেগুলোকে সমাধান করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি’-দলের বিভেদ মেটানোর পরামর্শ দিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই সতর্কবার্তা দিয়েছেন গত ১৫ নভেম্বর।

পরদিন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দলের ভেতর বিশৃঙ্খলার কথা তুলে ধরেন- ‘এ ধরনের ঘটনা চলতে থাকলে আগামীতে সরকার আবার ক্ষমতায় আসতে পারবে না।’

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দল নানা সমীকরণের মধ্যেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভীষণভাবে চিন্তিত নিজ দলের বিশৃঙ্খলা নিয়ে। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দলের কোন্দল দূর করার চেষ্টা চললেও প্রায়ই দেখা দিচ্ছে এক নেতার বিরুদ্ধে আরেক নেতার বিরোধ। আর নেতাদের মধ্যে এই মতবিরোধ বিভিন্ন এলাকাতেই দলের মধ্যে বিভেদ বাড়িয়ে তুলছে।

গত বছরের অক্টোবরে দলের ২১ তম জাতীয় সম্মেলনের পর দল পুনর্গঠন শেষে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের কোন্দল দূর করতে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বিভিন্ন এলাকার নেতাদেরকে ডেকে নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে যে উদ্বেগ স্পষ্ট তা তাদের নানা সময়ের বক্তব্যেই স্পষ্ট যাচ্ছে।

সম্প্রতি রাজধানীর আজিমপুরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের বিভেদে দলীয় কর্মসূচি বানচাল করতে এক পক্ষ অনুষ্ঠানস্থলের সামনে কয়েক ট্রাক ময়লা ফেলে রাখে। এরপর বাইরে সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ। অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বিরক্ত খাদ্যমন্ত্রী নেতা-কর্মীদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, দলের মধ্যে এ রকম বিভেদ চলতে থাকলে আগামীতে আর সরকারে ফেরা হবে না আওয়ামী লীগের।

সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছরের শেষ দিকে অথবা ২০১৯ সালের শুরুতে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর নির্বাচনকে সামনে রেখেই অস্থিরতা বাড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। নেতাকর্মীরা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিভিন্ন সময় বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। অনেক ক্ষেত্রে তা রূপ নিচ্ছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দলের ভেতর নেতৃত্বে আসতে দ্বন্দ্ব প্রকাশিত হয়। নানা স্থানীয় নির্বাচনে এটা স্পষ্ট হয়। ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের মধ্যে কঠিন পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনেও ২০ টির বেশি আসনে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়েছেন নেতারা। তাদের বেশ কয়েকজন পাসও করে এসেছেন।

জাতীয় নির্বাচনে পর উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ আর পৌরসভা নির্বাচনে বহু আসনে দলের প্রার্থীদের হারিয়ে দিয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। বারবার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও এই প্রবণতা থামেনি। চলতি বছর কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এই বিভেদ স্পষ্ট হয়। আর দলের কোন্দলে নৌকার প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার পরাজয়ের বিষয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিবেদন গেছে। কিন্তু বিভেদ আরও উস্কে যেতে পারে আশঙ্কায় ব্যবস্থা নেয়নি ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্র।

আসন্ন রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী ছিলেন ১০ নেতা। এদের মধ্যে বর্তমান মেয়র শরফুদ্দিন আহমেদ ঝণ্টুকে মনোনয়ন দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। কিন্তু অন্য নয় নেতার বেশ কয়েকজন এই সিদ্ধান্ত মানতে পারছেন না। নানাভাবে তারা তাদের মনোভাব প্রকাশও করেছেন।

আওয়ামী লীগের দেশের বিভিন্ন জেলায় নানা ধরনের কোন্দল রয়েছে। প্রত্যেক পক্ষই তাদের পাল্লা ভারী করার চেষ্টা করছেন। আবার অনেক স্থানে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা বর্তমান সংসদ সদস্যের রোষাণলের শিকার হচ্ছেন।

বিভেদ বিব্রত, ক্ষতবিক্ষত করছে আওয়ামী লীগকে

এই বিভেদের কারণে দলকে বিব্রত হতে হচ্ছে প্রায়শই। গত ২৮ অক্টোবর ফেনীতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার জন্য ক্ষমতাসীন দল দায়ী করেছে বিএনপিকেই। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করেছেন, ‘বড় নিউজ’ তৈরির জন্যই এই কাজ করেছে বিএনপি।

অথচ দলের এ অবস্থানের মধ্যে ফেনী আওয়ামী লীগের এক নেতা আজহারুল হক ঘটনার প্রায় এক মাস পর রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন এই ঘটনাটি ফেনীতে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী ঘটিয়েছেন।

অন্যান্য বহু এলাকার মতো ফেনী আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব-বিভেদ স্পষ্ট। নিজাম হাজারী ও আজহারুল দুটি আলাদা বলয়ে অবস্থান করেন। এই বিভেদে আজহারুল বিএনপির হাতে একটি অস্ত্র তুলে দিয়েছেন এবং এ কারণে তার ওপর বিরক্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।

রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরোধী সাত মনোনয়ন-প্রত্যাশী একাট্টা হয়েছেন। তারা ওমর ফারুক বিরুদ্ধে দলে বিএনপি-জামায়াত থেকে নিয়ে আসা ‘হাইব্রিড’দের নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ ফারুকের বিরোধীরা। এ ছাড়াও তারা এমন সব অভিযোগ তুলছেন যা সরাসরি দলের বিরুদ্ধে যায়। তারা নিজ দলের সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক চোরাকারবারিদের সঙ্গে সখ্য রাখা, চাকরি দেয়ার নামে ঘুষ গ্রহণ, সরকারি খাদ্য সংগ্রহে সিন্ডিকেট তৈরির মতো অভিযোগ তুলেছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে কোন্দলের আরও চিত্র প্রকাশ হয়েছে গত ১০ নভেম্বর। সেদিন সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে হবিগঞ্জের বাহুবলে হামলার শিকার হন সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী।

এর আগে গত ৯ জুলাই বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের জের ধরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের দফায় দফায় সংঘর্ষে ফারুক সরদার নামে এক নেতা নিহত হন।

একই সময় মাগুরার শালিখায় প্রতিপক্ষের হামলায় আবদুল জলিল নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হয়।

৩০ মে পাবনার বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আলিম খাঁ নামের এক কর্মী নিহত হন। পৌর ঠিকাদারি কাজের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে স্থানীয় আলিম খাঁ ও শফি হোসেনের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল।

সমাধানের আশায় শীর্ষ নেতারা

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দলে দ্বিমত থাকবে। তবে আমাদের সবার লক্ষ্য রাখতে হবে এ দ্বিমত যেন বিশৃঙ্খল না হয়।’

তবে দলের এই বিভেদ জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না বলে আশাবাদী মহিবুল। তিনি বলেন, ‘এখন দলীয় নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার কারণে বিভিন্ন জায়গায় দ্বিমত দেখা যাচ্ছে। যা আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নয়। আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা যাকেই মনোনয়ন দেবেন আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতাকর্মী তাঁর বিজয়ের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফও আশাবাদী এসব কোন্দল মিটে যাবে নির্বাচনে আগেই। তিনি বলেন, ‘এসব কোন্দল থাকবে না। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন এলাকায় ছোটখাটো যেসব দ্বন্দ্ব রয়েছে তা আমরা উদ্যোগ নিয়েই দ্রুত সমাধান করব। নির্বাচনের সকল কোন্দল নিরসন করে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্ল্যাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে, কোন্দল থাকবে। এটা একদম চলে যাবে না। আওয়ামী লীগ অনেক বড় দল, এখানে অনেক নেতা আছেন। তাই কোন্দল মোকাবেলায় দলীয় হাইকমান্ড যেভাবে নির্দেশ দিবেন সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করব।’

ঢাকাটাইমস/২২নভেম্বর/টিএ/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :