নির্বাচনী সহিংসতা

প্রাণ হারানো দুই কর্মীর পরিবারের পাশে নেই আ.লীগ

সিরাজুম সালেকীন
| আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:৪৭ | প্রকাশিত : ১৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:৩৫
ডিসেম্বরের শুরুতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আ.লীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষের সময় গাড়িচাপায় মারা যায় দুই জন-ফাইল ছবি

রাজধানী ঢাকায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় গাড়িচাপায় দুজনের প্রাণহানির মামলার তদন্ত থমকে আছে। পুলিশের দাবি, নিহত এক কিশোরের বাবা মামলা করেছেন। আর যাকে বাদী বলা হচ্ছে, তিনি বলছেন, মামলা করেননি। তাকে ভয়ভীতিও দেখানো হয়েছে মামলা না করতে।

যে মামলা হয়েছে, সেটির তদন্ত গত দুই মাসেও এগোয়নি বলার মতো। গ্রেপ্তার একমাত্র আসামি বের হয়ে গেছেন জামিনে।

ওই কিশোরের মৃত্যুর পর তার বাবার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিল ক্ষমতাসীন দল। তবে সে ঘোষণারও বাস্তবায়ন নেই। উল্টো ছেলে আহতের খবর পেয়ে নিজের রিকশা অন্য একজনের কাছে জমা দিয়ে ঘটনাস্থলে আসার পর ফিরে গিয়ে মেলেনি নিজের আয়ের অবলম্বনটিও।

গত ১০ নভেম্বর মোহাম্মদপুরের শ্যামলীতে ওই সংঘর্ষ হয় দুই পক্ষে, যাদের এক পক্ষ ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের এবং অপর পক্ষ বর্তমান সংসদ সদস্য সাদেক খানের অনুসারী। দুই কিশোরের নাম সুজন ও আরিফ। তারা দুজনই ছিল সাদেকের সমর্থক।

নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনে জয়ী নানক এবার মনোনয়ন পাননি, সাদেক খান মনোনয়ন পেয়ে সহজেই হারিয়েছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আবদুস সালামকে।

কে ক্ষমতায় এল, কে সংসদ সদস্য হলো, এ নিয়ে নিহত দুই পরিবারের মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। তারা কেবল ভাবছে, তাদের আদরের সন্তানের মৃত্যুর দায় কার, সেটা নিয়েই।

আরিফের বাবার অভিযোগ, ছেলের মৃত্যুর পর তাকে সূচনা কমিউনিটি সেটারে স্থানীয় কমিশনার ও তার অনুসারীরা আটকে রেখে রাতে মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরে তিনি ভোলায় নিজের বাড়িতে চলে যান। ঢাকায় আসেন সপ্তাহখানেক পর।

ওমর ফারুক পেশায় একজন রিকশাচালক। ঘটনার দিন রিকশা নিয়ে বিজিবির ৩ নম্বর গেটে ছিলেন। হঠাৎ বড় ছেলে হারুনের কাছ থেকে জানতে পারেন আরিফ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। রাস্তায় যানজট হবে ভেবে আজিমপুর নিউ পল্টন মাঠের পাশে এক নিরাপত্তাকর্মীর কাছে রিকশা জমা দিয়ে আসেন। এসে ছেলেকে আর জীবিত পাননি। পরে স্থানীয় দুজনকে পাঠালেও আর রিকশা ফিরে পাননি। ফারুক জানান, মোহাম্মদপুরে এসে তিনি জানতে পারেন, ছেলে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি। কিন্তু তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে আটকে থাকার সময় রাত ১২টার দিকে জানতে পারেন ছেলে মারা গেছে।

এ সময় ছেলের বিচার চেয়ে থানায় মামলা করবেন বললে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা তাকে ভয়ভীতি দেখান। পরে ছেলের দাফনের জন্য ৪০ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয়। মরদেহ নিয়ে ভোলার লালমোহন উপজেলার হরানগঞ্জে যান দাফন করতে।

বর্তমানে ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা উদ্যান এলাকার নবীনগরে থাকেন। নিজের রিকশা হারিয়ে যাওয়ার পর ভাড়ায় রিকশা চালান। আরিফ একটি অ্যামব্রয়ডারির কারখানায় কাজ করত। এখন খুবই অভাবে তাদের দিন কাটছে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য বা ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সাহায্য বা খোঁজ নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‘অনেকে সেই সময় আশ্বস্ত করেছিল সাহায্যের কিন্তু এখন তাদের কাছে গেলেও দেখা করে না।’ ঘটনার পরের দিন ১১ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশ গণমাধ্যমে জানিয়েছিল, নিহত আরিফের বাবা বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ২০-২৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন। এই ঘটনায় মামলা দেখিয়ে সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের অনুসারী স্থানীয় যুবলীগের নেতা আরিফুর রহমান তুহিন পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হন। পরে আদালতে পাঠানো হলে সেদিনই তিনি জামিন পান।

কতজনকে আসামি করেছিলেন, এমন প্রশ্নে ওমর ফারুক বলেন, ‘আমি কোনো মামলা করিনি। কখনো থানায়ও যাইনি। আর আমি নিজের সই নিজেই করতে পারি না।’

পুলিশ বলছে মামলার বাদী আপনি জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‘ঘটনার দিন লাশ বুঝে পাওয়ার পর আমি গ্রামে ছেলের লাশ দাফন করতে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে বাদী হলাম কীভাবে? আমি কোনো দিন মোহাম্মদপুর থানায়ই যাইনি।’

মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মুকুল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নির্বাচনে ব্যস্ত থাকার কারণে তদন্তে সময় দিতে পারিনি বলে তদন্ত কাজ আটকে আছে।’

নিহত আরেক কিশোর সুজনের মা সুলতানা ঢাকা টাইমসকে জানান, ছেলের মৃত্যুর পর তাদের ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল দাফনের জন্য। আর এই টাকা দিয়েছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। পরে ২৫ হাজার টাকা দেন স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার রাজিব। আরও সাহায্যের কথা থাকলেও তারা দেননি। মামলা করলেন না কেন জানতে চাইলে সুজনের মা বলেন, ‘ভাবলাম মামলা করলে খারাপ কিছু হতে পারে, তাই আর মামলা করিনি।’

মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দিন মীর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘হত্যার ঘটনার পর নিহত আরিফের বাবা ওমর ফারুক বাদী হয়ে একটা মামলা করেছিল। সেই মামলায় আরিফ নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই ঘটনার সঙ্গে আর কারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করতে পুলিশ কাজ করছে।’

আরিফের বাবা দাবি করছেন তিনি মামলা করেননিÑএমন মন্তব্যের পর পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কেন সে অস্বীকার করছে আমি জানি না। তবে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে কে মামলা করল।’

পরক্ষণে আবার বলেন, ‘তার দোষ দিয়ে লাভ নেই। গ্রামের মানুষ বোঝে না কোন স্বাক্ষরে মামলা হয়। কোন সই দিলে কী হয়?’

ঢাকা-১৩ আসনের এমপি সাদেক খান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি নিহত দুজনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছি। পরিবার দুটির খোঁজ নিয়েছি। তাদের সাহায্য করব। আরিফের ভাইয়ের স্থায়ী একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। দ্রুতই তারা সেটা পাবে।’

নিহত আরিফের বাবা ফারুক বাদী হয়ে থানায় মামলা করেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাদেক খান বলেন, ‘এটা থানা পুলিশ বলতে পারবে। আমি জানি না।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :