সংস্কৃতি নিয়ে হাহাকার ও কিছু কথা

সংস্কৃতি নিয়ে অনেককে হাহাকার করতে দেখি। তাদের বলবার কথা একটাই- আমাদের সংস্কৃতি যা ছিল সব রসাতলে গেল, বিদেশি সংস্কৃতি এসে আমাদের সব কিছু দখল করে নিল। এই হাহাকার তুলে তারা বর্ণনা করতে বসেন আমাদের সংস্কৃতি কেমন ছিল এবং কত সুন্দর ছিল, বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে এখন কত বাজে হয়ে পড়েছে, এইসব।
প্রকৃত প্রস্তাবে এইসব লোকদের সংস্কৃতি সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। এরা বোঝেন নিজেদের ভালো এবং মন্দের ধারণা দিয়ে। যা তাদের মতের সংগে মেলে না, তাই মন্দ সংস্কৃতি। কিন্তু সংস্কৃতি কারো ব্যক্তিগত ভালো কিংবা মন্দের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে না। এটা ব্যক্তি কিংবা সমাজের ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে গড়ে ওঠে। একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের কোটি কোটি মানুষ একে অপরের সংগে হাজারো সম্পর্কে জড়িত। এই সম্পর্কের মুলে রয়েছে উৎপাদন ব্যবস্থার প্রকৃতি। সবাই বাধ্য এই সম্পর্কে জড়িত হতে।
উৎপাদন ব্যবস্থা যদি এখানে রাজা হয়, মানুষ তার দাস। দাস সমাজে সংস্কৃতির রুপ ছিল একরকম, সামন্ত সমাজে এসে তা বদলে গেছে। কেউ যদি বলে দাস সমাজের সংস্কৃতিই ছিল সেরা, সামন্ত সংস্কৃতি সব শেষ করে দিল, তাহলে বলতে হবে তার ভাবনা পশ্চাৎমুখী এবং বর্জনীয়। সমাজ এগিয়ে চলে, উৎপাদন ব্যবস্থার চরিত্র বদলে যেতে থাকে মানুষের আকাংখাও বদলে যেতে থাকে।
এই বদল ঘটে দুভাবে, স্বতঃস্ফূর্ত এবং সংগ্রাম দ্বারা। একটি বিদ্যমান সমাজের ভেতর যে উৎপাদন ব্যবস্থা চলতে থাকে তার ভেতরেই জন্ম নেয় অগ্রগামী উৎপাদন ব্যবস্থার বীজ। নেবেই, এর কোনো ব্যতিক্রম হতে পারে না। এক সময় সংঘাত বাঁধে, লড়াই হয়, অগ্রগামী অর্থনীতি জিতে যায়। ধীরে ধীরে সমগ্র সমাজ সেই ব্যবস্থার অধীন হয়ে পড়ে। এই ব্যবস্থা বদলে যাওয়ার সংগে সংগে মানুষের সংস্কৃতিও বদলে যায়। অর্থাৎ সংস্কৃতি আর কিছুই নয় একটি নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের সম্পর্কের রুপ।
এখন আমরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীন, বিজ্ঞান প্রযুক্তি এই ব্যবস্থার প্রধান চালিকা শক্তি । পণ্য উৎপাদন এবং বাজার এর প্রাণ ভোমরা। সে পৃথিবীর সবকিছুকে পণ্য বানাতে চায়। তাই এর হাত থেকে প্রকৃতির কিছুই রক্ষা পায় না। বন, নদী, পাহাড় সবকিছুকে সে গ্রাস করতে চায়। এই চাওয়া শুধু যে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন নয়, তাই নয়, এটা ব্যবস্থার দুর্দমনীয় বৈশিষ্ট্য। রাজনৈতিক আদর্শ কেবল এর গতিকে সীবাবদ্ধ করতে পারে ।
আকাশ সংস্কৃতি পণ্য সংস্কৃতির একটি বৈশ্বিক রুপ। এখন পৃথিবী একটি বাটনের চাপে উদ্ভাসিত। পৃথিবীর কে কোথায় কি করছে, সব দেখা যায়। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি এখন এক ঘাটে জল খাচ্ছে। এর অর্থ এই যে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি একটি মাত্র রূপে এসে মিলছে এবং গতিপ্রাপ্ত হয়ে উঠছে। সংস্কৃতিও তার ছাঁচে গড়ে উঠছে। এই ছাঁচ আগের চেয়ে আলাদা, সম্পূর্ণ আলাদা। এই আলাদা রূপটাকে কেউ সহসা মেনে নিতে পারে না, তখন হাহাকার করে বলে ওঠে 'আমাদের সব গেল' ! আসলে কিছুই যায়নি, সব আছে, শুধু এর রুপান্তর ঘটেছে।
একটি সমাজ তার উদ্ভাবন নিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। প্রতিনিয়ত বদলে বদলে যায়। সংস্কৃতিও তার পরিবর্তিত রুপ নিয়ে হাজির হয়। আমরা তার মধ্যেই বাস করতে থাকি। আমরাও বদলে যাই...
লেখক: চিত্রশিল্পী ও লেখক
ঢাকাটাইমস/৩০মার্চ/এসকেএস

মন্তব্য করুন