মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়া থেকে মুক্তির উপায়

স্বাস্থ্য ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ৩১ মার্চ ২০২২, ১১:৪৩
অ- অ+

স্মার্টফোনের সেলফির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু সেলফ টক বা একা একা কথা বলার সঙ্গে হয়তো আমরা অনেকেই তেমন পরিচিত নই। একা একা কথা বলা বা নিজে নিজে কথা বলা মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়া বা মুড ডিসওর্ডারের লক্ষণ। এসব রোগীরা অনবরত একা একা কথা বলতে থাকেন। তাদের কথাগুলোর মধ্যে তেমন একটা সামঞ্জস্যতা নেই। কখনও বা কোন কারণ ছাড়া হাসতে থাকা। অদৃশ্য কোনো কিছুর সঙ্গে অনবরত কথা বলতে থাকা।

ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটির মতো সমস্যা গুলি ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যে গুরুত্ব পেলেও, আড়ালে থেকে যাচ্ছে সিজোফ্রেনিয়া নামক এই ভয়ানক মানসিক রোগ। সিজোফ্রেনিয়া একপ্রকার জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ব্যাধি। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর চিন্তাধারা এবং অনুভূতির প্রকাশের মধ্যে কোনো প্রকার সঙ্গতি থাকে না ৷ রোগী বাস্তবতার বোধ বা উপলব্ধি হারিয়ে ফেলে, প্রায়ই অলীক প্রত্যক্ষণ, ভ্রান্তবিশ্বাস ইত্যাদিতে ভোগে।

বর্তমানে সারা বিশ্বে কমপক্ষে দুই কোটি ৬০ লাখ লোক সিজোফ্রেনিয়া রোগে ভুগছেন। বাংলাদেশে এই রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। মনোবিজ্ঞানীরা নানা সমীক্ষা থেকে বলছেন, আমাদের দেশে দিন দিন সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের মতে, বাংলাদেশের প্রায় ০.২৪% লোক সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। সেই হিসেবে বাংলাদেশের প্রায় ১৩ লক্ষ লোক সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত। চলতি সময়ের অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে দিচ্ছে এই মনের অসুখের বিস্তার।

সবার আগে প্রয়োজন সিজোফ্রেনিয়া রোগটি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা। অনেক সময় নানা কুসংস্কারের কারণে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার বিপরীতে অপচিকিৎসা গ্রহণের কারণে মানসিক রোগ আরও জটিল হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে যে, মানসিক রোগ একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ, তাই দীর্ঘসময় এমনকি কখনও কখনও সারাজীবন ওষুধ খাওয়াতে হবে। রোগী ওষুধ না খেলে তাকে দোষারোপ করা যাবে না; বরং স্বজনদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।

সিজোফ্রেনিয়ার কারণ

এই রোগের সঠিক কারণ কি তা আজও জানা যায়নি। তবে, যে যে কারণগুলিকে এই রোগের জন্য দায়ী করা হয়, সেগুলি হল-

জিনেটিক: যদি কারও মা-বা বা তাদের উভয়েরই সিজোফ্রেনিয়া হয় তবে তাদের শিশুদেরও এটি হওয়ার ১০% সম্ভাবনা রয়েছে।

জৈব রাসায়নিক উপাদান : মস্তিষ্কে উপস্থিত কিছু জৈব রাসায়নিক পদার্থ বিশেষত ডোপামাইন (মস্তিষ্ক থেকে রাসায়নিক বহনকারী সংকেত) নামক নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতা সিজোফ্রেনিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এই রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা জেনেটিক, জন্মগত ত্রুটি বা গর্ভাবস্থায় কিছু ধরনের জটিলতার কারণেও হতে পারে।

স্ট্রেস : সিজোফ্রেনিয়ার কারণ হিসাবে স্ট্রেস জড়িত বলে বিশ্বাস করা হয়। সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায়শই যে কোনও জায়গায় মনোনিবেশ করতে সমস্যা হয়, যার ফলে তারা উদ্বেগযুক্ত এবং বিরক্তিকর হন। এগুলো ছাড়াও, এই পরিস্থিতিতে পরিবার এবং নিজের প্রতি মনোযোগের অভাব ও চাপ তৈরি করে। এখানে বলা কঠিন যে সিজোফ্রেনিয়া স্ট্রেসের কারণে ঘটছে।

ভাইরাস সংক্রমণ, মানসিকভাবে অত্যন্ত চাপগ্রস্থ পরিস্থিতি, কিংবা দীর্ঘকালীন অসুস্থতা ইত্যাদির কারণে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

জন্মকালীন কোনও জটিলতা থাকলেও এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

গর্ভাবস্থায় কোনও মা যদি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন এই রোগ হতে পারে।

কিছু উত্তেজক মাদকদ্রব্য এবং ওষুধ সেবন এই রোগের কারণ হতে পারে।

সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অডিটরি হ্যালুসিনেশন সবচেয়ে বেশি হয়। অডিটরি হ্যালুসিনেশন মানে হলো অবাস্তব কিছু শুনতে পাওয়া। অর্থাৎ অস্তিত্ব নেই এমন কিছুর আওয়াজ শোনা। ব্যাপারটা স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রেও হতে পারে।

মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে এই হ্যালুসিনেশন অনবরত হতে থাকে। তারা অনবরত শুনতে থাকেন, তাদের সঙ্গে কেউ কথা বলছে, কিংবা তাদের নিয়ে কেউ কথা বলছে। তাই তারা এসব কথার উত্তরও দিতে থাকেন। অগোছালো অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা সামঞ্জস্যতাপূর্ণ। যারা মদপান করেন বা যারা মাদকসেবী তাদেরও অনেক সময় হ্যালুসিনেশন হয়।

সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের আচরণ স্বাভাবিক থাকে না। কখনো একেবারে চুপচাপ, আবার কখনো অতিরিক্ত নড়াচড়া করেন বা কখনো কখনো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। পোশাক-আশাক এবং নিজেরাও অপরিষ্কার থাকেন। কোনো কাজেই উৎসাহ পান না। অনেকে অন্য কারো সাথে, বিশেষ করে বিপরীত লিঙ্গ এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে পারেন না। একা একা থাকতে চান।

মানসিক রোগ বা সিজোফ্রেনিয়াতে অনবরত হ্যালুসিনেশন হয় ব্রেইনের ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার মাত্রাতিরিক্ত হওয়াতে। এজন্যে ডোপামিন রিসেপ্টর ব্লকার ঔষধ দেওয়া হয়। এতে অবিশ্বাস্য রকমভাবে হ্যালুসিনেশন বন্ধ হয়ে যায়। রোগীদের একা একা কথা বলা কমে আসে। এক সময় সে সাধারণ মানুষের মতই সুস্থ হয়ে উঠে।

সিজোফ্রেনিয়া রোগের চিকিৎসা

সিজোফ্রেনিয়া রোগীর চিকিৎসা সফল হতে হলে প্রাথমিক পর্যায়েই রোগটিকে শনাক্ত করে চিকিৎসা দিতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক মনোভাব পরিবর্তন ও রোগীদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

সিজোফ্রেনিয়া রোগের বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক চিকিৎসার জন্য ওষুধ (অ্যান্টি-সাইকোটিক মেডিকেশন) একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ওষুধ ছাড়া এ রোগের উপসর্গের উপশম সম্ভব নয়। অনেক সময় রোগীরা ভালো হয়ে যাওয়ার পর ওষুধ বন্ধ করে দেওয়ায় ফের রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় এবং চিকিৎসা জটিলতা বৃদ্ধি পায়। এ জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরি। চিকিৎসার ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের ইতিবাচক ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘমেয়াদে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য মনোসামাজিক প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসার গুরুত্ব অপরিসীম।

সিজোফ্রেনিয়া রোগের চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা; মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা; আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগ ও পাবনা মানসিক হাসপাতালে। এছাড়া কিছু প্রাইভেট মেডিকেল লাইফ এন্ড লাইট হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালগুলো চিকিৎসা দিয়ে থাকে।

সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ এবং আপনজনের সান্নিধ্যে রোগী অনেক ক্ষেত্রেই সুস্থ হয়ে যান।

মনে রাখতে হবে, এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দিলেই চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। এই চিকিৎসার সাধারণত যে ওষুধ প্রয়োগ করা হয় তা হলো অ্যান্টিসাইকোটিক ড্রাগ। হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশন এবং সাইকোসিসের লক্ষণগুলো প্রশমিত করতে ওষুধের ব্যবহার করা হয়। এর পাশাপাশি সিজোফ্রেনিয়ার উপসর্গ বিভিন্ন থেরাপি ও মনোচিকিৎসাও গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন মানসিক চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর সামাজিক সহায়তাও ভীষণ ভাবে প্রয়োজন হয়।

সাইকোলজিক্যাল ইন্টারভেনশন থেরাপি-র মাধ্যমে রোগী স্ট্রেস এবং অন্যান্য মানসিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি লাভ করে।

ভোকেশনাল রিহ্যাবিলিটেশন এর মাধ্যমে রোগীকে কাজে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷

এছাড়াও, রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়া করে মাথায় ইলেকট্রোড লাগানো হয় এবং তারপর ছোটো কারেন্টের শক দেওয়া হয়। এতে রোগীর মানসিক অবস্থা এবং চিন্তাশক্তির উন্নতি হয়।

সিজোফ্রেনিয়া রোগ থেকে মুক্তি পেতে যেসব খাবার খেতে পারেন

সিজোফ্রেনিয়ার ঘরোয়া প্রতিকার হিসাবে আপনি এলাচ ব্যবহার করতে পারেন। এটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র সুস্থ রাখতে সহায়তা করে এবং সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ গুলো হ্রাস করতে পারে। এলাচের গুঁড়া এক চা চামচ, এক গ্লাস গরম পানির সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেতে পারেন।

সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির ভিটামিনের অনেক ঘাটতি থাকে। ভিটামিন ডি এর মতো অন্যান্য ভিটামিনগুলোর ঘাটতির কারণেও সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে, বিভিন্ন ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার বা পরিপূরক গ্রহণ সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ গুলো হ্রাস করতে পারে।

জিনসেং সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ গুলো থেকে মুক্তি দিতে পারে। এটি একটি কার্যকর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, যা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সহায়তা করতে পারে। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস মস্তিষ্কের কোষগুলো ধ্বংস করে, মস্তিষ্ক-সম্পর্কিত রোগ গুলোর ঝুঁকি বাড়ায়। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস করা সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসায় সহায়তা করতে পারে। জিনসেংয়ের নিউরো প্রোটেক্টিভ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা মস্তিষ্কের নিউরনগুলো রক্ষা করতে সহায়তা করে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করতে পারে। বিশেষত, এটি জ্ঞানীয় লক্ষণ প্রতিরোধে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এটি ভুক্তভোগীর আচরণে পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে থাকে।

গাজর সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে । নায়াসিন (ভিটামিন বি৩) পাওয়া যায় গাজরে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিয়াসিনের ঘাটতিও সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ গুলোর সাথে জড়িত। নিউরনের ঘাটতি তে হ্যালুসিনেশন বৃদ্ধিও হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, গাজরের মতো নিয়াসিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ গুলো হ্যালুসিনেশন এবং সাইকোটিক বৈশিষ্ট্যগুলো হ্রাস করতে সহায়তা করে ।

সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে মানসিক চাপ না দেওয়া, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা ও চিন্তামুক্ত রাখা খুব জরুরি। যদি তিনি ওষুধ সেবনের মধ্যে থাকেন তবে ঠিকমতো ওষুধ খাচ্ছেন কি না, চিকিৎসা নিচ্ছেন কি না খেয়াল রাখতে হবে। সামাজিকভাবে রোগীর ক্ষেত্রে সহেযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাকে পাগল বিবেচনা করা ঠিক নয়। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়।

(ঢাকাটাইমস/৩১ মার্চ/আরজেড)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
পদ্মা সেতুর তিন বছরপূর্তি আজ, টোল আদায়ের রেকর্ড ছাড়িয়েছে আড়াই হাজার কোটি
২০ মাসে ইরানসহ পাঁচ দেশে ৩৪ হাজারের বেশি হামলা ইসরায়েলের
ঘুষ-দুর্নীতির দায়ে ওসি থেকে এসআই হলেন মাসুদ
আগামী সপ্তাহে বৈঠকে বসবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান: ডোনাল্ড ট্রাম্প
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা