যানজটরোধে প্রয়োজন প্রশিক্ষিত চালক

রেজাউল করিম
 | প্রকাশিত : ০১ মে ২০২২, ১৭:২৯

কয়েক বছর আগের কথা। সম্ভবত ২০১৭ সাল। পত্রিকায় পড়েছিলাম যানজটের একটি হাস্যকার সংবাদ। ঢাকা থেকে উত্তরের পথের কোন এক জায়গায় ঈদের আগে তীব্র যানজট চলছিল। কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না মহাসড়কে কর্মরত পুলিশ। সমস্যা খুঁজতে দীর্ঘপথ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছিলেন একজন ট্রাকচালক স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে চালকের আসনে ঘুমিয়ে আছে। তার পেছন থেকে যানজট শুরু হয়েছিল। কোনো এক প্রশ্নের জবাবে চালক বলেছিলেন, যানজটের কবলে পড়ে তিনি চালকের আসনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সামনের জট খুলে গেলেও ওই চালকের আর ঘুম ভাঙেনি। ফলে ওই ট্রাকের পেছন থেকে শুরু হয়েছিল নতুন করে যানজট।

মহাসড়কে স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে একজন চালকের ঘুমিয়ে পড়ায় তখন না হয় জটের ওপর দিয়ে ঘটনার শেষ হলো। চলন্ত অবস্থায় চালক ঘুমিয়ে গেলে জটের পরিবর্তে প্রাণের ওপর দিয়েও যেতে পারত। পত্রিকায় এমন সংবাদও চোখে পড়ে চালক ঝিমিয়ে পড়ায় বাস খাদে।

ঈদ সামনে রেখে মানুষ ছুটছে বাড়ির পথে। ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ এমনকি জেলা পুলিশও মাঠে কাজ করছে। মহাসড়কেই ইফতার। মহাসড়কেই খাবার। পুলিশের এই ত্যাগ শুধু দেশের মানুষ যেন প্রিয়জনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে। নির্বেঘ্নে বাড়ি ফিরতে পারে। যানজটের খবর পৌঁছে দিতে সাংবাদিকরাও মাঠে কাজ করছে। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশের পর যানজট নিরসনে প্রশাসন কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে। তারপরেও কি যানজট নিরসন হচ্ছে? কখনো হয়, কখনো বা হয় না। সব সময় যানজটের ভয়।

আমরা সব সময় ট্রাফিক পুলিশকে দোষ দিয়ে থাকি। কর্মরত পুলিশদের দায়ী করে থাকি। সড়কের অবস্থাকে দায়ী করে থাকি। আসলেই কি তাই? যানজটের কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, যানজটের বড় কারণ চালকদের অসচেতনতা, প্রশিক্ষণহীনতা ও অদক্ষতা। একজন ট্রাফিক পুলিশ রোদের তাপে, বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে কাজ করছে। জট নিরসনে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশিক্ষিত ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিরসন করতে পারছে না। কারণ প্রশিক্ষিত ট্রাফিক পুলিশদেও নিয়মের ব্যাখা মানতে নারাজ অপ্রশিক্ষিত চালক। এ ব্যাখ্যা বুঝতে চালকদেরও প্রশিক্ষিত হতে হবে।

যানজট কিন্তু শুধু মহাসড়কে না। আপনার জেলা শহরেও যানজট। আপনার মফস্বল শহরেও যানজট। ছোট্ট একটি গ্রাম্য বাজারেও জট। দেশের অলিগলিতে এখন যানজট। যানজটরোধে জরুরি হয়ে পড়েছে চালকদের প্রশিক্ষিত করা। দেশের সড়কে প্রতিনিয়ত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ফলে যানজটের মাত্রাও বাড়ছে। ২০১০ সালে দেশে ১৪ লাখ ২৩ হাজার ৩৬৮টি রেজিস্ট্রেশন পাওয়া যানবাহন ছিল। এক যুগ পর ২০২২ সালে এসে ওই সংখ্যা ৫১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬টিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকার যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেয়া নিয়ে এখনো কোনো ধরনের সীমা নির্ধারণ করেনি। ফলে গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করলেই তা মিলছে। জনসংখ্যার সাথে তাল মিলিলে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন পাবে এটাও স্বাভাবিক। এমনকি চালক লাইসেন্স পাবে এটাও অস্বাভাবিক নয়।

আলোচনায় আসা যাক, লাইসেন্সের নামে চালক কী পাচ্ছেন? এূলত চালক লাইসেন্সের নামে একটি কাগজ পাচ্ছেন, যা মানুষ মারার সার্টিফিকেট! কেননা সার্টিফিকেট থাকলে তার যেকোনো আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার বেশি। লাইসেন্স না থাকলে রাস্তায় গাড়ি নামানোটাই বড় অপরাধ। লাইসেন্সধারী চালকের অনেক অপরাধ অনেক সময় সহনীয়ভাবে মাপা হয়।

ভাবা হোক ভিন্নভাবে। কীভাবে পাচ্ছেন লাইসেন্স? দেশে চালকদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা অতি দুর্বল। মোটর যান চালকেরা নিজে নিজেই বাইক চালানো শেখেন। কেউ কেউ বাজারের চটি বই কিনলেও অধিকাংশ চালক সড়কে চলাচলের নিয়ম সম্পর্কে অজ্ঞ। এরা আবার মোটরসাইকেলের পাশাপাশি হালকা যানের লাইসেন্স পেয়ে থাকে। বাস-ট্রাকের চালকদের কাছ থেকে দেখে দেখে ট্রাকের সহযোগরিাও এসব যান চালানো শেখে। এদের কোনো একাডেমিক প্রশিক্ষণ নেই। প্রশিক্ষণ ছাড়া এসব চালকরা দক্ষ হবে কীভাবে? সড়কের নিয়ম মাথায় ঢুুকবে কভিাবে? বলতে পারেন প্র্যাক্টিকালি। প্র্যকটিকালি শিক্ষায় লাভ যেমন আছে, অসুবিধাও তেমনি আছে। কারণ ওস্তাদের ভুল থাকলে শিষ্যেরও ভুলটা থেকে যায়। সেক্ষেত্রে একাডেমিক শিক্ষায় এর পূর্ণতা পায়।

বিআরটিএ লাইসেন্স পাওয়াটাকে এতোটা সহজ করেছে যা যাত্রীদের মৃত্যুর জন্য একজন চালকের জন্য লাইসেন্স পাওয়াটাই যথেষ্ট। একজন অপ্রশিক্ষিত চালক আবেদন করলেই সে লাইসেন্স পেতে পারে। প্রথমে প্রার্থীকে আবেদন করে লার্নার নিতে হয়। এরপর একটি নির্ধারিত ক্যাটাগরিতে লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। লিখিত পরীক্ষার পর ভাইবা। অতঃপর প্রার্থীর ব্যবহারিক (প্র্যাকটিকাল) দেখাতে হয়। এখানে দুটি প্রশ্ন থেকে যায়। এরা প্রশ্নের উত্তরে যাই লিখুক, তারা প্রশিক্ষণ পেলেন কোথা থেকে? দ্বিতীয় প্রশ্ন আসে, এদের কজন পরীক্ষায় পাস করে লাইসেন্স পায়? বিআরটিএ এর পাশের চায়ের দোকানদারও জানেন কীভাবে লাইসেন্স দেয়া হয়।

পরামর্শ এমন আসতে পারে, এ রকম প্রহসনমূলক লাইসেন্স বিতরণের চেয়ে বিআরটিএর উচিত দেশে শক্তিশালী চালক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা। যেখানে নির্ধারিত সময়ে একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর তার পরীক্ষা নেওয়া হবে। অতঃপর প্র্যাকটিকালি নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর তাকে সড়কে গাড়ি চালানোর জন্য নামতে দেওয়া হবে। এতে দেশে দক্ষ চালক সৃষ্টি হবে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল খাটো হবে। সড়কে যান চলাচলের নিয়ম সম্পর্কে চালকদের পূর্ণ ধারণা থাকবে। প্রশিক্ষিত হলে যানজটও নিরসন হবে।

যানজট এখন দেশের অলিগলিতে ছড়িয়েছে। দেশের মানুষের অন্যতম বিরক্তিকর সমস্যা হচ্ছে যানজট। জেলা শহরগুলোতে যেসব ছোট যান রিকশা, অটোরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, পিক-আপ চলে, এসব যানচলক হয় বিদেশফেরত, না হয় কোনো কাজ থেকে ছিটকে পড়া মানুষ। এরা বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স নিতে পারেনি। এসব যানের চালকদের লাইসেন্স নেওয়ার সুযোগও নেই। এদের সড়কে যান চালানোর কোনো ধারণা নেই। ছোট্ট যান কিনে রাস্তায় নেমেছে। এরপর থেকে ওরাই রাস্তার রাজা। এদের কারণে রাস্তার অলিগলিতে যানজট থামছে না।

যানজটরোধে দ্রুত সব চালককে প্রশিক্ষণ, অতঃপর তাদের বিআরটিএ লাইসেন্স দেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছে। সংবাদে পড়েছি, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গাড়ি বাড়ার তুলনায় দক্ষ চালক কম। এই কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনাও। আবার রাস্তায় বৈধ গাড়ির পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশনবিহীন অবৈধ গাড়িও বেড়েছে। তাতেও সড়ক, পরিবেশ ও জনজীবনে চাপ বাড়ছে।

অপ্রশিক্ষিত বা অসচেতন চালকদের ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। কোথায় থামা যাবে, কোথায় গাড়িটা ঘোরানো যাবে, কোথায় ওভারটেক করা যাবে এসব বিষয়ে কোনো ধারণা নেই অপ্রশিক্ষিত চালকদের। সড়কে লক্ষ করলে দেখা যায়, দুই লেনের সড়কে চালকরা চার লেনের গতিতে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করছে। কোথাও কোথাও সামনের গাড়িকে অতিক্রম করতে পেছনের গাড়ির কিছু অংশ ডানে বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবে দুই লেনের সড়কে চার লেনের সৃষ্টি হচ্ছে।

জেলা শহরে খেয়াল করলে দেখা যায়, ইচ্ছেমতো জায়গাতে গাড়ি টার্ন করছে। গাড়িটি ঘুরাতে পেছনে জট সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। অপ্রশিক্ষত চালকদের কারণেই এমন সমস্যা বাড়ছে। সড়কে চলতে একজন চালককে নানা ধরনের নিয়ম-কানুন জানতে হয়। অপ্রশিক্ষিত চালক হওয়ায় তারা এসব নিয়ম-কানুন জানেন না। এদের প্রশিক্ষিত করাটা সময়ে দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) জানায়, দেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বার্ষিক ৭০ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়, যা জিডিপির দুই শতাংশ। এ ছাড়া শুধু ঢাকায় যানজটের কারণে বছরে এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়, যা জিডিপির তিন শতাংশ। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজটের কারণে বছরে মোট ক্ষতি এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। দেশের এই বড় ক্ষতি প্রতিরোধ করতে যানজট নিরসন প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত চালক।

এই ভাবনাটা শুধু ঈদের আগে নয়, রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে যানজট নিয়ে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে।

লেখক: সংবাদকর্মী।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :