রাতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকর লেজার লাইট, থামাবে কে?

নিষিদ্ধ লেজার লাইট এখন যত্রতত্র ব্যবহার করছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। এতে বিড়ম্বনায় পড়ছেন চালকেরা। এমনকি ছোটখাটো দুর্ঘটনার কথাও চালকদের কাছ থেকে জানা গেছে।
দেখা যাচ্ছে, রাস্তার কোনো এক স্থানে দাঁড়িয়ে লেজার লাইটের মাধ্যমে সড়কে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছে ট্রাফিক পুলিশ। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ক্ষতিকর এই লাইটের ব্যবহার।
গত রবিবার রাতে সরেজমিনে রাজধানীর ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, রামপুরা, মালিবাগ, মগবাজার, রাজারবাগ, সায়দাবাদ, শাহবাগ, কল্যাণপুর গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকা ঘুরে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ মোড়েই ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের যানবাহন নিয়ন্ত্রণে নিষিদ্ধ লেজার লাইটের ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, লেজার লাইটের কারণে ক্ষতি হতে পারে চোখের রেটিনার। এমনকি চোখ নষ্টও হয়ে যেতে পারে। তাদের পরামর্শ পুলিশকে এর বিকল্প কিছু ভাবা উচিত।
দিনের চেয়ে রাতের বেলা সড়কে বড় গাড়ির চলাচল বেশি। এতে করে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশের ডিউটি করা ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময় লেজার লাইটের ব্যবহার চালকের চোখে পড়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি করে।
সড়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে অধিকাংশ শহরে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশকে ডিউটি করতে দেখা যায় না। ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সিগন্যাল বাতি কেউ মানে না। সেজন্য পুলিশকে আরও কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশকে লেজার লাইটের বদলে স্বল্প আলোর টর্চলাইট বা অন্য কোনো বিকল্প ব্যবহার বাড়াতে হবে।
লেজার লাইটের ব্যবহার নিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন ট্রাফিক সার্জেন্টের সঙ্গে। তারা ঢাকা টাইমসকে বলেন, দিনের বেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তারপরেও গাড়ির চালকরা সিগন্যাল মানতে চায় না। আর রাতের বেলা রাস্তায় বড় গাড়ি চলাচল করে। কে কার আগে যাবে সেই প্রতিযোগিতা করে। লাইট ছাড়া সশরীরে ডিউটি করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
কিন্তু এই নিষিদ্ধ লেজার লাইট ব্যবহারের কোনো অনুমতি নেই। বাধ্য হয়ে ব্যবহার করতে হয় বলে জানান সার্জেন্টরা।
ভারী গাড়ির বেশ কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা বললে তারাও একই অভিযোগ করেন। তারা বলেন, গাড়ি চালানোর সময় হঠাৎ এই উত্তেজিত আলো চোখে পড়লে মনে হয় সামনের সব অন্ধকার। এতে করে মাঝেমধ্যে বিপদেও পড়তে হয়। চৌরাস্তায় গাড়ির গতি কম থাকে, এই জন্য প্রাণে বাঁচতে পারলেও ধাক্কা লাগে সামনের গাড়িতে।
ফকিরাপুল মোড়ে কথা হয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্গো চালক আবদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি কমলাপুর থেকে নিয়মিত মাল নিয়ে যান সাভার।
আবদুর রহমান বলেন, `রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক পুলিশের লেজার লাইট চোখে পড়লে আর কিছু দেখি না। কদিন আগে ফকিরাপুল মোড়ে লেজার লাইট চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনের বাসে ধাক্কা লেগে যায়। এতে বাসের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে।’
এর আগে বাংলামোটর মোড়ে মালবাহী পিকআপের ধাক্কায় একটি সবজিবাহী ভ্যানের চালক গুরুতর আহত হন। দুর্ঘটনার কারণ জানতে চাইলে পিকআপের চালক পারভেজ হোসেন জানান, `ট্রাফিক পুলিশের ব্যবহার করা লেজার লাইট চোখে পড়ায় সামনের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ ভ্যানটি সামনে চলে এলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। এতে সামনের ভ্যানের সঙ্গে ধাক্কা লাগে।’
ট্রাফিক পুলিশের লেজার লাইট চোখে পড়লে মাথা ঘুরে যায়, অন্তত ১০ মিনিট সামনের সবকিছু ঘোলা দেখেন বলে জানান আরেক চালক। একজন মোটরসাইকেল চালকও চোখে লেজার লাইট পড়ার যন্ত্রণার কথা জানান।
সম্প্রতি রাতে কারওয়ান বাজার সিগন্যালে দেখা যায়, সার্জেন্ট ও ট্রাফিক পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য ডিউটিতে রয়েছেন। তাদের মধ্যে সার্ক ফোয়ারার ওপরে দাঁড়িয়ে একজন লেজার লাইট দিয়ে চারপাশের রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করছেন। একই চিত্র দেখা যায় রামপুরা ট্রাফিক বক্সে, ওপর থেকে লেজার লাইটের মাধ্যমে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছেন পুলিশ সদস্যরা।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি মার্কেটের কসমেটিক্স শিশুদের খেলনার দোকান ঘুরে দেখা গেছে, হরহামশায় বিক্রি হচ্ছে এই নিষিধ লেজার লাইট। বিক্রি করা নিয়ে কোনো শর্ত আছে কি না জানতে চাইলে পল্টন সিটিহাটের এক কসমেটিক্স দোকানি বলেন, এটা বিক্রি করতে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এটা সাধারণ মানুষ এসে কিনে নিয়ে যায়।
খোলা বাজারে পাওয়া যায় দুই ধরনের লেজার লাইট। উভয় লাইটের ওপরে বড় অক্ষরে লালকালি দিয়ে লেখা- বিপজ্জনক (ডেঞ্জার)। এছাড়া আরও লেখা আছে- এক্সপোজার এড়িয়ে চলুন, এই লাইট থেকে লেজারের আলো বের হয়। লেজার বিকিরণ সরাসরি চোখে যাতে না পড়ে সেই জন্য এক্সপোজার এড়িয়ে চলুন। এটার সর্বোচ্চ আউটপুট শক্তি ১০ হাজার মেগাওয়াট। আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৫৩২ এনএম। এটি ক্লাস ৩য় লেজার পণ্য। এই পণ্যটি ২১ কোড অব ফেডারেল রেগুলেশনস (সিআরএফ) মেনে চলে।
ওই মাকের্টের আরেক দোকানি বলেন, এই লাইটের আলো আকাশে উঠে যাবে। এটা খুব শক্তিশালী লেজার লাইট। দাম জানতে চাইলে বলেন, ৮০০ টাকা। আর ছোট লাইটার দাম ১৫০-২০০ টাকা। এই লাইট বেশির ভাগ নিয়ে আসা হয় চায়না থেকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সফিকুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, যত্রতত্র লেজার লাইটের আলো পড়লে চোখের অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। রাস্তায় ও জন সমাগমের মধ্যে পুলিশের এটা ব্যবহার করা উচিত নয়। সরাসরি কোনো ব্যক্তির চোখে লেজার লাইটের আলো পড়লে দীর্ঘ মেয়াদি সমস্যা ছাড়াও অন্ধ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।
প্রায় প্রতিদিনই এমন সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকদের কাছে যাচ্ছেন রোগীরা। লেজার লাইটের কারণে অনেকে তাদের দৃষ্টিশক্তি পর্যন্ত হারিয়েছেন বলে জানান আরেক চিকিৎসক। তিনি বলেন, লেজার রশ্মি সরাসরি মানুষের চোখে পড়লে এতে চোখের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। এটি চোখের রেটিনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ম্যাকুলাতে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে। ফলে রোগী ওই চোখে আর দেখতে পান না।
খেলনা হিসেবে না বুঝেই এটি অনেকে শিশুদের ব্যবহার করতে দিচ্ছেন, যা মোটেও উচিত নয় বলে জানান ওই চিকিৎসক।
লালবাগ ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার মেহদী হাসান বলেন, ‘লেজার লাইট তো নিষিদ্ধ। এটা বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করছি। রাতে ডিউটি করতে সমস্যা হচ্ছে, তারপরেও বন্ধ করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অনেকে এখন ব্যবহার করছে। তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। কোনোভাবেই লেজার লাইট ব্যবহার করার সুযোগ নেই।’
লেজার লাইট ব্যবহার যাতে না করে সেজন্য ট্রাফিক সদস্যদের বিকন ও সোল্ডার লাইট ব্যবহার করার জন্য বলা হয়েছে বলে জানান উপ-কমিশনার।
মতিঝিল ট্রাফিক বিভাগের এক সার্জেন্ট বলেন, রাতে ডিউটি করার জন্য লাল-সবুজ আলোর ফ্লিকার লাইট দেয়া হয়। একটা লম্বা লাঠির মতো, যেটা হাতে থাকে। আরেকটা ছোট ফ্লিকার লাইট থাকে কাঁধে। এর বাইরে লেজার লাইট ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। তারপরেও কিছু সদস্য ব্যবহার করছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বলেন, লেজার লাইটের কারণে চোখের ক্ষতি হয়। যে কারণে এটি ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। লেজার লাইট এখন আর কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। সরকারিভাবে ট্রাফিক পুলিশের কোনো সদস্যকে লেজার লাইট সরবরাহও করা হয়নি।
(ঢাকাটাইমস/৩১আগস্ট/মোআ)

মন্তব্য করুন