দেশের রিজার্ভ আসলে কত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ওঠানামা করা, আমদানির তুলনায় রপ্তানি ও রেমিটেন্স কমে যাওয়া, ডলারের অস্থির বাজারসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের রিজার্ভে চাপ পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ৩৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন যে রিজার্ভ আছে তা কোনোভাবেই পর্যাপ্ত বলা যাবে না। কারণ এরমধ্য থেকে আন্ত:আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিকারী সংস্থা এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া এই হিসাবের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সাত বিলিয়নসহ আরও বেশ কিছু প্রকল্পে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার ফান্ড গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ফান্ডের বেশিরভাগ অর্থই ফেরত আসেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনো সময় আছে। চেষ্টা করলে সংকট সমাধান হবে। রিজার্ভ সংকট বা অন্তরায়গুলো ধরে ধরে কাজ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য আজ থেকেই সব ধরণের অর্থ পাচার ঠেকাতে হবে। যেসব অর্থ দেশ থেকে চলে গেছে তা ফিরিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি রেমিটেন্স যোদ্ধারা যেন বৈধ উপায়ে দেশে টাকা পাঠায় সেদিকে আরও নজর দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী গত রবিবার ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আগামী ছয় মাসেও রিজার্ভ বাড়ার সম্ভাবনা নেই। আমাদের হাতে টাকা নেই। সামনে কি হবে জানি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আামাদের রিজার্ভের যে অবস্থা তাতে এলএনজি কেনার সিদ্ধান্তে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।’
তিনি আরও শংকার কথা জানান বিদ্যুত নিয়ে। বলেছেন, ‘বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে প্রয়োজনে দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে।’ এ জন্য তিনি সবাইকে শপথ পড়ান।
তার ওই বক্তব্যের পর রিজার্ভসহ দেশের জ্বালানি সংকট নিয়ে সত্যিই শংকায় পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে রেকর্ড আমদানি দায় ও বিদেশী ঋণ পরিশোধের জন্য প্রায় প্রতিদিনই রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসতে পারে।
পরিস্থিতি সামলাতে সরকার আগেভাগেই আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে। ইতোমধ্যে আইএমএফ ঋণ দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছে। ধারণা করা যাচ্ছে, আগামী বছরের শুরুতেই ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে।
রিজার্ভসহ দেশের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা টাইমস কথা বলে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা বলেন, ‘৩৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আমাদের মত আমদানি নির্ভর এবং রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতির জন্য পর্যাপ্ত বলা যাবে না। আর এখানে সম্পূর্ণ পরিমাণটা রিজার্ভে আছে তাও বলা যাবে না। এই ডলারের মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিকারী সংস্থা এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমবে। এছাড়া রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে দেওয়া ডলারও এই হিসেবের মধ্যে। ইডিএফ ফান্ডে দেওয়া রিজার্ভ ডলার আকারে ফেরত আসার সম্ভাবনা কম। এই ডলার টাকা হিসেবে আসার সম্ভাবনাই বেশি। আর টাকা এলেও রিজার্ভ হিসেবে কাউন্ট হবে না।’
বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের মূল রিজার্ভ এখন যা আছে, সে হিসেবে সে হিসেবে তিন বা সাড়ে তিন মাসের ব্যয় মেটানো যাবে। গত কয়েক মাসের পর্যবেক্ষণে আমদানি ব্যয় যে বেড়েছে তা বিশ্লেষণ করে এটা বলা যায়।’
তিনি বলেন, ‘মনে রাখতে হবে আমাদের অর্থনীতি নির্ভর করে রেমিটেন্স ও রপ্তানির ওপর। তবে আমাদের রপ্তানি আয় তেমন শক্ত না। তাই যা রিজার্ভে আছে তা পর্যাপ্ত বলে আমি মনে করি না।’
গত সাড়ে তিন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ৪৬০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে জানিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এভাবে ডলার বিক্রি অব্যাহত থাকলে রিজার্ভ কমতেই থাকবে। এছাড়া আগামী ১ বছরে বিশ্বের অবস্থা কি হবে তাও বলা মুশকিল। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে। বিশ্বের পরিস্থিতি উন্নত হওয়ার কোনো পূর্বাভাস কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি গ্যাস-ক্রুডঅয়েলের দাম কমে যায়, তাহলে একটু স্বস্তি ফিরে আসতো। তবে এখানেও একটা বিষয় আছে। সেটা হলো, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলে রেমিটেন্সে প্রভাব পড়তে পারে। কেননা আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধারা বেশিরভাগই তেল বিক্রি করা দেশগুলোতে চাকরি করেন। সর্বসাকূল্যে আগামী এক বছরে বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে পূর্বাভাস দেখছি না।’
সংকট সমাধানে কি পদক্ষেপ নেওয়া যায় এমন প্রশ্নে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ প্রথম বিষয় হলো- খাদ্য নিরাপত্তা, এরপর জ্বালানি নিরাপত্তা। দেশের মানুষ যদি ক্ষুধায় ভোগে তাহলে দেশে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা কঠিন হবে। আর জ্বালানির সংকট চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে যাবে। এই দুটোর জন্য আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রা।’
তিনি বলেন, ‘ধরেন আমি যদি দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করি তবুও বৈদেশিক মুদ্রা লাগবে। কেননা আমাকে সার কিনতে হবে, যন্ত্রপাতি কিনতে হবে, কীটনাশক কিনতে হবে। আর জ্বালানি নিরাপত্তার জন্যও বৈদেশিক মুদ্রা দরকার। কেননা এটা না থাকলে তেল কিনতে পারবো না, এলএনজি কিনতে পারবো না। আর এগুলো না থাকলে উৎপাদন করতে পারবো না।’
বৈদেশিক মুদ্রার যোগান বাড়ানোর ওপর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার চেষ্টা করছে চাহিদা কমাতে। এখানে সমস্যা হলো, চাহিদা কমালে কিন্তু অর্থনীতির চাকাতে প্রভাব পড়ে। আপনি যদি ডিজেল না আনেন তাহলে আপনার কিছুটা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে ঠিকই। কিন্তু জমিতে সেচ হল না, বিদ্যুৎ কেন্দ্র চললো না, গার্মেন্টস খাতে উৎপাদন কম হল- এভাবে ওখানে তো বৈদেশিক মুদ্রা হারিয়ে যাচ্ছে।’
যোগান বাড়াতে হলে কি করতে হবে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রথমেই বলবো আমরা এখন বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাবস্থাপনা যেভাবে করছি, সেটিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ধরুন, ডলারে আয় করলে আপনি পাবেন ৯৯ টাকা করে। কিন্তু আবার যদি কোনো কিছু আমদানি করতে চান তাহলে এলসি খুলতে হবে ১০৪ কিংবা ১০৫ টাকায়। তাহলে আমি আয় করলে ৯৯ টাকা পাবো, আবার কিনতে গেলে ১০৪ টাকায় কিনবো। এটাতো হয় না। এখানে রপ্তানিকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।’
একইভাবে রেমিটেন্স কর্মীরা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে গেলে হুন্ডিতে পাঠানোর চেয়ে ১০-১২ টাকা কম পায়। তাহলে স্বাবিকভাবেই তারা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠাবে।
‘এখানে হুন্ডির সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। আমাদের একীভূত ডলার রেটে যেতে হবে। আরও বড় একটি কাজ বন্ধ করতে হবে যেটি হল দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা টাকা পাচার’- যোগ করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক এই মুখ্য অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মাসে আমদানি ব্যয় প্রায় ১৭ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ২৬৯ কোটি (১২.৬৯ বিলিয়ন) ডলার হয়েছে। আর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে রফতানি আয় ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলার এসেছে। একই সময়ে প্রবাসী আয় মাত্র ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫৬৭ কোটি ডলার। প্রথম দুই মাসে রফতানি ও রেমিট্যান্স বাড়লেও সেপ্টেম্বরে কমেছে। চলতি অক্টোবর মাসেও রেমিট্যান্স প্রবাহে ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রিজার্ভের অবস্থা সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘রিজার্ভ যা আছে, তার পাশাপশি এখন রিজার্ভের প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে রিজার্ভ যত বেশি থাকে ততই ভালো। এখানে তিন মাস না হয়ে পাঁচ থেকে ছয় মাসের মূল রিজার্ভ থাকলেই স্বস্তিতে থাকা যাবে। আমাদের তো খাদ্যশস্য, ডিজেল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেটারিয়ালস আমদানি করতেই হবে।’
প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠাতে গেলে বহু সমস্যার সমুখীন হয় জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ধরেন কেউ বিদেশে চাকরি করে। এখন সে দেশে টাকা পাঠাতে গেলে বহু সমস্যার সম্মখীন হয়। সে অনেক সময় টাকা পাঠাতে গেলে ওখানে কাউকে টাকা দিয়ে দিল। আর এদিকে বাংলাদেশি মুদ্রায় তার পরিবার টাকা পেল। এখানে কিন্তু সরকার কোনো রেমিটেন্স পেলো না।’
বর্তমানে রপ্তানি আয় এবং রেমিটেন্সে যে প্রবাহ সেটি একটু হতাশাজনক বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের তো প্রধান দুইটা উৎস থেকে রিজার্ভ বাড়ে। প্রথমটি হলো রপ্তানি আয়, আর দ্বীতিয়টি হলো রেমিটেন্স। এদিকে নজর দিতে হবে। রপ্তানি করার মত সব শিল্পে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আমাদের অর্থ পাচার রোধ করতে হবে, হুন্ডির মাধ্যম ডলার লেনদেন বন্ধ করতে হবে। বিদেশে ট্যুরে সীমাবদ্ধতা আনতে হবে। জনগণের অর্থ বিভিন্নভাবে লোপাট হচ্ছে এগুলো কমাতে হবে- জোর দিয়ে বলেন আবু আহমেদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জিএম আবুল কালাম আজাদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘রিজার্ভ এখনো যথেষ্ট আছে। সব মিলিয়ে আমাদের রিজার্ভ এখন ৩৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার আছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং করোনা ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বই কিছুটা হিমশিম খাচ্ছে।’
ডলারের বাজার অস্থিতিশীল এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যে রেটে ডলার এস্টাব্লিস করার জন্য ৯৭ টাকা রেটে যখন দেওয়া হচ্ছে সেখানে দেখা গেছে ১০৬ টাকা, প্রণোদনা, আবার কার্ভ মার্কেটের ভিন্নতা, ফটকা কারবারিও আছে। এমতাবস্থায় এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিশেষজ্ঞ টিম কাজ করছে। সমন্বয় করার জন্য কাজ করছে।’
দেশে আসলে কত রিজার্ভ আছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘৩৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের মধ্যে পুরোটায় রিজার্ভে নেই। এখানে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা এক্সপো ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে দেওয়া ডলারও এই হিসেবের মধ্যে। তবে মূল কত বিলিয়ন ডলার আছে সেটি ওই কর্মকর্তা জানাতে রাজি হননি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরো বলেন, ‘রিজার্ভ কমেছে ঠিক। তবে ভবিষ্যতে আবার বাড়বে।’
(ঢাকাটাইমস/২৭অক্টোবর)

মন্তব্য করুন