ঝড়ের সময় বড় জাহাজগুলো কেন সমুদ্রের মাঝে পাঠিয়ে দেওয়া হয়?

ভয় ধরাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’। সন্ধ্যা নাগাদ এই ঝড় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল অতিক্রম করে বিভিন্ন জেলায় আঘাত হানতে পারে। ইতোমধ্যে উপকূলবাসীদের নিরাপত্তায় কাজ শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। চট্টগ্রাম স্থলবন্দরে অবস্থিত বড় বড় জাহাজগুলোকে সাগরের মাঝে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু কেন? ঝড়ের সময় কেন জাহাজগুলোকে এভাবে সমুদ্রের মাঝে পাঠিয়ে দেওয়া হয়?
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ‘Cyclone Disaster Preparedness and post Cyclone Rehabilitation Plan-1992‘ অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল- ৫ এ গেলেই জেটি এবং চ্যানেলের সুরক্ষার্থে জেটির ভেতরের জাহাজগুলোকে বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।স সেখানে আজ ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র জন্য ৭ নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত জারি করা হয়েছে।
এ সময় কেন জাহাজগুলো সাগরের মাঝে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, সে সম্পর্কে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বড় জাহাজগুলো জেটিতে থাকলে ঢেউয়ের কারণে জেটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে সাগরে জাহাজগুলো ইঞ্জিন চালু রেখে ঢেউ বা ঝড়ের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে ভাসতে পারে। এ জন্য সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে বড় জাহাজগুলো সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের মতে, জাহাজ সাগরে নিরাপদ থাকে। সুপার সাইক্লোন বা হেভিং টো হলে সাগরে জাহাজ ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারবে, ঢেউ চলে যাওয়ার পর পানিতে আছড়ে পড়বে কিন্তু ডুবে যাবে না। এতে জাহাজে থাকা মালামালও সুরক্ষিত থাকবে।
এসময় জাহাজগুলোকে সমুদ্রে পাঠিয়ে না দিলে বিপদ বাড়ে। কেননা বর্হিনোঙরে সাধারণ গভীরতা ১০ মিন্টার বা তার আশপাশে। জোয়ারের পানিতে জলোচ্ছ্বাসের ফলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে তখন ঢেউয়ের ধাক্কায় জাহাজ উপরে উঠে যায়। পরবর্তীতে জাহাজ যখন নিচে নামে সেসময় জাহাজের তলা ফেটে যেতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়ের সময় জাহাজগুলোকে সমুদ্রে পাঠানোর এটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তাই এ আশঙ্কা এড়াতে সাধারণত বন্দর থেকে জাহাজগুলোকে সমুদ্রে দুই হাজার মিটার বা তার বেশি গভীরতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ঘূর্ণিঝড়ের সময় বন্দরের সুরক্ষার জন্যও জাহাজগুলোকে সমুদ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যা চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুকের কথাতেই স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞদের মতে, জাহাজ বন্দরে থাকলে তীব্র ঝড়ের ফলে সৃষ্ট ঢেউয়ে জাহাজগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে প্রচণ্ড ধাক্কা লেগে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এতে বন্দরে রাখা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্ষতি হতে পারে।
এছাড়া এতে বন্দরের জ্বালানি রাখার স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হলে বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়। এতে বহুমানুষের প্রাণনাশের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে জাহাজগুলো সমুদ্রে পাঠানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, ঢেউ বা তীব্র গতির ঝড়ের ফলে বড় জাহাজ বন্দর চ্যানেলে ডুবে গেলে সেই জাহাজ না সরানো পর্যন্ত নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া পরবর্তীতে ডুবে যাওয়া জাহাজ সরানো বেশ ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
২০১৭ সালে চট্রগ্রামের আনোয়ারা সৈকতে ক্রিস্টাল গোল্ড নামে একটি জাহাজ আটকা পড়ে। পরবর্তীতে সেটিকে আর সমুদ্রে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯২ মিটার দৈর্ঘ্যের বিশালাকৃতির জাহাজটি দীর্ঘদিন আটকে থাকায় প্রায় ৫০০ মিটার জায়গায় পলি জমে যায়৷ পরবর্তীতে ২০২১ সালে জাহাজটি কেটে ফেলা হয়।
পাশাপাশি বিভিন্ন স্থাপনার সুরক্ষার জন্য ঘূর্ণিঝড়ের সময় জাহাজগুলোকে সমুদ্রে পাঠানো হয়। সেটা না করলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের সময় কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতুর মাঝখানের একটি বড় অংশ ভেঙে যায়। সেসময় একটি জাহাজের ধাক্কায় সেতুর মাঝখানের অংশ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ওই ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশে সমুদ্রে জাহাজ পাঠানোর নিয়মটি কঠোরভাবে পালন করা হয়।
(ঢাকা টাইমস/১৭নভেম্বর/এজে)

মন্তব্য করুন