‘প্রধানমন্ত্রীর সেই ধরা কি এই ধরা?’ কেন বাদ পড়লেন তিনি?

বছরজুড়ে মূল্যস্ফিতি তথা নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির নাভিশ্বাসে শান্তির ঘুম হারাম সাধারণ মানুষের। শুধু নিম্ন আয়ের মানুষেরাই নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলোও বাজারে চলা সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী গ্রুপের কারসাজির চাপে দিশেহারা হয়েছে। বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির দায় যতটা না বৈশ্বিক পরিস্থিতি তারচে বেশি দায় বাজার সিন্ডিকেটের। একাদশ জাতীয় সংসদে রংপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য টিপু মুনশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বগ্রহণের পর থেকেই প্রশ্ন উঠে একজন ব্যবসায়ী হয়ে নাগরিক স্বার্থ রক্ষায় তিনি কতটা আন্তরিক হবেন। কিংবা আদৌ তিনি বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন কি না।
পাঁচ বছর বাণিজ্য দপ্তরের দায়িত্ব পালনকালে এই প্রশ্ন তার পিছু ছাড়েনি কখনোই। ব্যবসায়ী মন্ত্রী হিসেবে শিল্প মালিকদের স্বার্থ রক্ষা কিংবা তাদের বাজার কারসাজিতে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে সমালোচক, বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজের অভিযোগে বরাবরই তিনি প্রশ্নবিদ্ধ ছিলেন। যদিও তিনি বারবার নিজের ওপর ওঠা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
নানা সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে অব্যাহতভাবে ব্যর্থতায় সংসদেও ব্যাপক তোপের মুখে পড়েন টিপু মুনশি। ব্যর্থতার দায় নিয়ে তার পদত্যাগেরও দাবি ওঠে সংসদে। সংসদের বিরোধী দলীয়, স্বতন্ত্র, এমনকি সরকার দলীয় একাধিক সংসদ সদস্যও বাণিজ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন। তার মন্ত্রণালয় সংসদের আলোচনায় উঠে এসেছে সরকারের সবচেয়ে ব্যর্থ মন্ত্রণালয় হিসেবে। কেউ কেউ তাকে সিন্ডিকেটের লিডার, কেউ কেউ যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযুক্ত করেছেন। তিনি নিজেও কখনো কখনো সিন্ডিকেট নিয়ে কথা বলেছেন। কখনো বলেছেন, সিন্ডিকেট ভাঙতে গেলে সমস্যা আরও বেড়ে যাবে। সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না। সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। আবার কখনো বলেছেন, বাজারে সিন্ডিকেট বলতে কিছুই নেই। কখনো বা বলেছেন, সিন্ডিকেট আছে, সিন্ডিকেট ভাঙব। কখনো বলেছেন, জনগণের সিন্ডিকেট সবচেয়ে শক্তিশালী। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে কোনো সিন্ডিকেট টিকতে পারবে না। জনগণকে প্রতিবাদী হতে হবে।
সিন্ডিকেট নিয়ে নানা সময়ে এলোমেলো কথা বললেও খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ যে কষ্টে আছে সেটা তিনি স্বীকার করেছেন। বছরের শেষদিকে নভেম্বরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন— ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ নিচ্ছে। এতে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ দেশের মানুষকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে হবে এবং আমরা সে চেষ্টাই করে যাচ্ছি।
তবে সিন্ডিকেট নিয়ে সংসদে দেওয়া এক বক্তব্যের জেরে তিনি সব থেকে বেশি ইমেজ সংকটে পড়েন গত আগস্টে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আফ্রিকা সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে আসেন গত ২৯ আগস্ট। প্রধানমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ের পর প্রশ্নোত্তর পর্বে দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম প্রধানমন্ত্রীকে সিন্ডিকেট নিয়ে প্রশ্ন করেন। সংসদে দেওয়া বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‘সিন্ডিকেটের কথা দায়িত্বশীল মন্ত্রীরাও বলেন। তারা বলেন, সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যায় না। সেখানে হাত দিতে গেলে বিপদ আছে। আমরা মনে করি, সরকার অত্যন্ত শক্তিশালী। সরকার দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে। এই নিত্যপণ্যের মৌসুমী ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে কী না’ সাইফুল আলমের এমন প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী পাল্ট প্রশ্ন করে বলেন, ‘বিপদ আছে কে বলেছে, আমি ঠিক জানি না। আমরা তো সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’ তখন সাইফুল আলম বলেন, দুজন মন্ত্রী বলেছেন, সিন্ডিকেট আছে, সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না। বাণিজ্যমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন? বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরব তো।’ তিনি বলেন, খাদ্যপণ্য নিয়ে কয়েকটা হাউস ব্যবসা করে। যখনই তারা দাম বাড়ায় আমরা আমদানি করি, বিকল্প ব্যবস্থা করি। যাতে তারা বাধ্য হয় দাম কমাতে। আমরা তো সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেই। কাজেই সিন্ডিকেট থাকলে তা ভাঙা যাবে না, এটা কোনো কথা না। কত শক্তিশালী সিন্ডিকেট আমি জানি না, আমি দেখব কী ব্যবস্থা করা যায়।’
এই ঘটনার পর পুরোপুরি ইউটার্ন নেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। পরের দিন সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সিন্ডিকেট আছে, সিন্ডিকেট ভাঙব এমন কথা আমি বলিনি। প্রধানমন্ত্রী তাকে কিছু বলেছেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর গতকাল তার সঙ্গে দুই ঘণ্টা ছিলাম, কিন্তু এ প্রসঙ্গে কথা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি তো বলিনি কিছু। এখন এই ব্যাপারে আমি কী বলব? উনি কী মিন করে বলেছন, সেইসময় কী সিচুয়েশনে বলেছেন, আমি ঠিক জানি না। সিন্ডিকেট আছে বা সিন্ডিকেট ভাঙ্গব, এই ধরনের কোনো কথা আমি বলিনি। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনাদের (সাংবাদিক) থেকে জানলাম, খবরে কাগজে দেখলাম।’
এরপরই মূলত আলোচনা ওঠে হয়ত প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্যমন্ত্রীকে সত্যিকারেই ধরবেন। ফলে সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরবেন তিনি। কিংবা তিনি পদত্যাগও করতে পারেন; এমন গুঞ্জণও ওঠে। কিন্তু বছর শেষে এসবের কিছুই হয়নি। বরং সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিদপ্তরের অসহায়ত্বের লড়াই দেখা গেছে বছরের শেষ সময় পর্যন্ত।
তবে টিপু মুনশিকে প্রধানমন্ত্রী ধরেছেন কি না সেটা জানা না গেলেও নতুন মন্ত্রীসভায় তার বাদ পড়াকে ব্যর্থতার ফল বলেই ধারণা সংশ্লিষ্ট মহল ও বিশ্লেষকদের।
এসব বিষয়ে কথা বলতে সাবেক এই মন্ত্রীকে ফোন করা হলে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। জানা যায়নি মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া। ‘ব্যর্থতার দায়ে বাদ পড়েছেন কি না, কিংবা প্রধানমন্ত্রীর সেই ধরা— এই ধরা কি না’ মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়ে ঢাকা টাইমসের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় তার কাছে।
সদ্য সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও সর্বশেষ এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে একাদশ সংসদে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তিনি বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএর সভাপতি ছিলেন। তিনি সিপাল গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও এসটিএস গ্রুপের পরিচালক।
(ঢাকাটাইমস/১২জানুয়ারি/এসআইএস)

মন্তব্য করুন