নির্ভীক মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল

আবদুল্লাহ আল মোহন
  প্রকাশিত : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১৩:২২| আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১৩:৩১
অ- অ+

আমাদের একজন জনপ্রিয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী এবং নির্ভীক মানবাধিকার কর্মী, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। আজন্ম প্রতিনিয়ত মানুষের কল্যাণে, দেশ ও সমাজের সেবায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। মানবকল্যাণই তাঁর পরম ধর্ম বলেই তার জীবনাচরণে তা প্রতিফলিত হতে দেখি। মানুষের জন্য সক্রিয় এই ব্যক্তিত্বের আজন্মের জীবনাদর্শ ‘মানুষ মানুষের জন্য’। তাঁর জীবনের জলছবি পাওয়া যায় জীবনকথা ‘ছিলাম কোথায় যেন নীলিমার নিচে’ গ্রন্থে। পেছন ফিরে দেখা জীবনেরই ঝাঁপি খুলে বসে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল লিখেছেন, বলেছেন অনেকের কথা, অনেক প্রসঙ্গ, বহু স্মৃতি, বহু ঘটনা। তাঁকে সঠিকভাবে জানতে, তাঁর আলোকিত পরিবার ও পরিবেশেকে বুঝতে, আমাদের সমৃদ্ধ রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-ইতিহাসকে বুঝতে তার আত্মজৈবনিক বয়ান, নিজের রচনা থেকে পাঠ করা জরুরি বিবেচনা করি। অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়তে তিনি আজো নিরলস যোদ্ধা হিসেবে সরব ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। আমাদের কাছে তিনি সুবিবেচক হিসেবে পরম শ্রদ্ধায় সম্মানিত স্বজন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণায় আবেগপ্রবণ হয়ে স্মরণ করেন সকলকেই। স্মরণ করতে ভোলেন না মুক্তিযুদ্ধের প্রণোদনাদাতা তাঁর মা-বাবার উৎসাহের কথা, একাত্তরে দেশ ছেড়ে চলে যাবার প্রাক্কালে তাঁদের দু’বোনকে তাঁরা বলেছিলেন- ‘তোমরা শুধু প্রাণ বাঁচানোর জন্য সীমান্ত পার হয়ো না, মুক্তিযুদ্ধের জন্য যাও। দেশের জন্য, সকলের জন্য কাজ করো।’ আমাদের সুপ্রিয় স্বজন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ১৯৫০ সালের ২২শে জানুয়ারি ঢাকার তারাবাগে জন্মগ্রহণ করেন।

সুলতানা কামাল আমাদের আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’-এর শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে সবসময় অনুপ্রাণিত করেন সুপরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে। চিন্তাচর্চা, লেখালিখির কারণে তার সাথে তাদের পরিবারসহ নানা বিষয়ে অনেকবার আলোচনার বিশেষ সুযোগ হয়েছে আমার। তিনি অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকেন অকপটে, বলেছেন অতীতের অনেক অজানা কথাও। আমার পরিকল্পিত ‘পরিবারই যাদের প্রতিষ্ঠান’ জীবনী সিরিজের ‘সুফিয়া কামাল পরিবার’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরিতে তার এবং তার জীবনসঙ্গী প্রয়াত সুপ্রিয় (চক্রবর্তী) দাদার সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার না করলেই নয়। তার জীবন নিয়ে আলাপনে জানতে পারি, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও শৈশবের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, সহপাঠী, সর্তীথ ছিলেন তিনি। তাঁরা একই স্কুলে পড়তেন, শিশুকালে একই সঙ্গে ছায়ানটে এসরাজ ও বেহালার সুর সাধনাও করেছেন। নারীশিক্ষা মন্দিরে তাদের যে গভীর বন্ধুত্বের সূচনা, সেই সম্পর্ক আজো নিবিড়ভাবে বিদ্যমান- তবে রাষ্ট্রীয়, শাসনগত নানা নীতিগত বিষয়ে নিজস্ব সঠিক বক্তব্যটি সরাসরি উপস্থাপনে সংশয়ী নন মোটেও সুশাসনে সত্যান্বেষী সুলতানা কামাল। এভাবেই তিনি তাঁর মা কবি বেগম সুফিয়া কামাল এবং বাবা কামালউদ্দীন আহমদ খানের মানসিক দৃঢ়চেতার অস্তিত্ব বহন করছেন প্রবল আত্মসম্মানের সাথে। আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরের নাট্যজীবনের প্রথম নায়িকা ছিলেন সুলতানা কামাল। রাজনৈতিক গভীর সচেতনতায় নাট্যদল নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে যেমন একাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন তেমনি আবৃত্তি, গানসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নানা আঙ্গিকেই সক্রিয় ছিলেন। টিভি ব্যক্তিত্ব শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের পরিচালনায় টিভিতে ‘ইডিপাস’ নাটকেও অভিনয় করেছেন।

সমাজ-রাজনীতি বিশ্লেষক আফসান চৌধুরীর ভাষায়- ‘সুলতানা কামাল একটি প্রতীকী ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। তিনি কেবল মানবাধিকার নিয়েই কাজ করছেন তা নয়, তাঁর কণ্ঠস্বর আজকের দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে প্রতিবাদের ভাষা রাজনৈতিক দলভিত্তিক হয়ে থাকে। কিন্তু সুলতানা কামাল দলীয় রাজনীতি করেন না। তিনি হচ্ছেন এ দেশের বিবেকবান মুক্তচিন্তার যে স্রোতধারা, তার অংশ।’ কারণ তাঁর মা বেগম সুফিয়া কামাল আর বাবা কামালউদ্দিন আহমদ খান ছিলেন এক আলোকদ্যুতিময় জীবনের উৎসভূমি। সঙ্গে ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর, পটুয়া কামরুল হাসান, জয়নুল আবেদীন, মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন, নূরজাহান বেগম, নূরজাহান মুর্শিদ প্রমুখ উজ্জ্বল সব মানুষের আনন্দ উৎসারিত সান্নিধ্য। শৈশব-কৈশোরের সেই স্বপ্নঘেরা, ঘন আনন্দের জীবন কাটিয়ে দেখা মেলে তিলে তিলে গড়ে ওঠা স্বাধীকার লড়াইয়ের। নিজেও হয়ে ওঠেন তারই অংশ। বড়ো জান্তব বাস্তবতায় হাজির হয় মুক্তিযুদ্ধ। প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন তাতে, সহকর্মী বান্ধবদের সঙ্গে। ওলটপালট হয়ে যায় জীবনের গতিপথ। মৃত্যু, হত্যা, স্বজন হারানোর বেদনা নিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশে এক অন্যজীবনের খোঁজে হাঁটতে থাকেন তিনি। সুফিয়া কামালের দেখানো পথেই মানবাধিকারের লড়াই অংশ হয়ে ওঠে তার জীবনের। সেই জীবনের কত কথাই তো অব্যক্ত। কত প্রিয়মুখ, প্রিয় সঙ্গ, কত শত ঘটনা! কত সুখ-অসুখ, ভালোলাগা-যন্ত্রণা-দুঃখ-আনন্দ আর নিরন্তর পথ চলা। পিতার অনুপ্রেরণাময় উপদেশের কথা তিনি তাই ভুলতে পারেন না। লিখেছেন, ‘আমার অটোগ্রাফ বইয়ে বাবার দু’টি উপদেশমূলক কথা আছে। কেন দুবার লিখেছিলেন তিনি জানি না- হয়তো প্রথমবারের কথার পরে আরও কিছু কথা তিনি বলতে চেয়েছিলেন আমাকে- তাই আবার কলম ধরা। প্রথমবার লিখেছিলেন- ‘ভালো হও, সত্যনিষ্ঠ হও, মানুষ হও’। দ্বিতীয়বারের বার্তা পেলাম, ‘তোমার নাম দিলাম সাহসিকা, বিমল ভালে জ্বলুক জয়টীকা।’ জয়টীকা যদি জ্বলেই সেটা হতে হবে ‘বিমল ভালে’ এ কথাটাই মূল ছিল আমাদের প্রতি তাঁর সকল নির্দেশনা।’ (কামালউদ্দীন খান স্মারকগ্রন্থ, বাংলা একাডেমি, পৃ: ১১৪)।

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল সাংস্কৃতিকভাবে একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারে, আলোকিত পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা রেনেসাঁ ব্যক্তিত্ব কামালউদ্দিন আহমদ খান এবং মা কবি বেগম সুফিয়া কামাল। কবি সুফিয়া কামাল এ দেশের স্বনামধন্য এবং খ্যাতিমান কবি এবং সমাজসেবী ছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন আমাদের গত শতাব্দীর ঢাকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের, ম্ক্তুবুদ্ধিচর্চার বহুল আলোচিত ‘শিখা গোষ্ঠী’র সক্রিয় চিন্তক ও লেখক কামালউদ্দীন আহমদ খান। সুলতানা কামালের মতে, তাঁর পিতা কামালউদ্দীন আহমদ খান ‘অসম্ভব বিদ্বান, প্রবলভাবে সমাজ সচেতন, সাহিত্য অনুরাগী মানুষ ছিলেন। ঘরেই তৈরি করেছিলেন আলোকিত পরিবেশ’। মানবতাবাদী পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে তাঁর জীবনেও তাঁদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে বলে স্বীকার করেন কৃতজ্ঞতার সাথে। ফলে এমন পরিবারের সুযোগ্য সন্তান সুলতানা কামালের পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন সর্বোপরি সামাজিক পরিবেশই হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর সেরা পাঠশালা। সুলতানা কামালের চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় পাই তার লেখনিতে, আত্মকথনে। পারিবারিক আবহেই তিনি দৃঢ়চেতা মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠেন।

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বড়ো হয়েছেন টিকাটুলীতে, তারাবাগে। লীলা নাগ প্রতিষ্ঠিত নারী শিক্ষা মন্দিরে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। পরবর্তীতে তিনি আজিমপুর গার্লস হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন এবং হলিক্রস কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি নেদারল্যান্ডস থেকে ওমেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ বিষয়ে আরেকটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৮১ সালে বিসিএস পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হন কিন্তু সরকারি চাকুরি আর তাঁর করা হয়ে ওঠেনি। তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানান কর্মকাণ্ডে সবসময় জড়িত ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়ভাবেই। সামাজিক দায়িত্বপালনের ইতিবাচক জীবনব্যাপী ভূমিকা পালন তার পরিবার, মা-বাবার কাছ থেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। সুলতানা কামালের ভাষায়, ‘আমাদের জীবনবোধে মা’র কর্মকাণ্ডের ছায়া খুবই বিস্তৃত এবং গভীর। তবে ন্যায়নীতি, সত্যাসত্য বিচার, বোধবুদ্ধি দিয়ে মানুষকে চেনা, দেখা এবং শোনা- এ বিষয়ে যে দীক্ষা সে তো বাবার কাছেই পাওয়া।’ (কামালউদ্দীন খান স্মারকগ্রন্থ, বাংলা একাডেমি, পৃ: ১১৫)

তার কর্মজীবন শুরু ঢাকার সংগীত কলেজে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। পরে তিনি একটি বিশ্বখ্যাত টোবাকো কোম্পানিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন, অল্পকিছুদিন চাকুরিও করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি সিলেটের খাদিম নগরে একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি বেকার ও ভাসমান লোকজনদের নিয়ে জাতিসংঘের আইনি পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সালে তিনি কানাডিয়ান গণতন্ত্র ও মানবাধিকার গ্রুপের পক্ষ থেকে জন হামফ্রে ফ্রিডম পুরস্কার পান। তিনি আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দীর্ঘদিন নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। এছাড়াও তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এবং We can end violence against woman Alliance-এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম হিলট্রাক কমিশনের কো-চেয়ারপার্সন। তিনি ফ্রিডম ফাউন্ডেশন এবং অমর্ত্য সেন প্রতিষ্ঠিত ‘প্রতিচি বাংলাদেশ’-এর ট্রাস্টটিসহ গান্ধি আশ্রম ট্রাস্ট, রোকেয়া মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ ইউনেস্কো ন্যাশনাল কমিশন, দি ন্যাশনাল লিগাল এইড কমিটির তিনি সম্মানিত সদস্য। এছাড়াও তিনি নারী অধিকার ফোরামের সদস্য। ওমেন লিভিং আন্ডার মুসলিম ল’ সাউথ এশিয়া পাটনারশিপেরও তিনি সদস্য। তিনি সুন্দরবন সুরক্ষা এবং পরিবেশ নিয়ে যেমন আন্দোলনে সক্রিয়, তেমনি সরকারের নানা স্তরের দুর্নীতিসহ মানহীন শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচক, মৌলবাদী সংস্কৃতি বিকাশের নানাচিত্র তুলে ধরতে সরব। সর্বোপরি দেশ ও দশের সামগ্রিক উন্নয়ন, জনযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা সংগ্রামের মুক্তির চেতনায় ঋদ্ধ মানব কল্যাণই তার মৌল জীবন দর্শন।

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা, নারী ও শিশু অধিকারসহ নানা বিষয়ে জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে নিয়মিতভাবে কলাম লিখে থাকেন। তিনি আত্মজীবনীসহ মানবাধিকার বিষয়ে একাধিক বইও লিখেছেন। নারী অধিকার নিয়ে তার লেখা বই ‘মানবাধিকার : নিঃশঙ্ক মন’ ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে ‘Unfearing Mind’ শিরোনামে। তার লেখা গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর মধ্যে রয়েছে: মানবাধিকার, রাষ্ট্র, সমাজ, (Human Right, State the Society), আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ছিলাম কোথায় যেন নীলিমার নীচে’। দীর্ঘ সময় ধরে তার লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধের সংকলন নিয়ে এই বইগুলি প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি নারী অধিকার ও মানবাধিকার ক্ষেত্রে পেশাদার ও দক্ষতার কারণে বিশ্বের ত্রিশটিরও বেশি দেশে ভ্রমণ করেছেন যেমন- এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসহ কানাডা ও ইউরোপ। সুলতানা কামাল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাও দিয়ে থাকেন। তিনি শিশুদের নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। তিনি শিশু সংগঠন কচিকাঁচার মেলার সাথেও জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, ‘সংস্কৃতি সংসদ-৩’- এর সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সুলতানা কামাল সংস্কৃতির স্বায়ত্তশাসন ও ‘৬৯-এর গণঅভ্যুথানে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি। তিনি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। শুধু তাই নয় এই নাট্যদলের শুরুর দিকে সুলতানা কামাল অভিনয়ও করেছেন।

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং তিনি আগরতলা ফিল্ড হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন ছিলেন। তার নিরলস মানবসেবার ধারাবাহিকতা আজো সক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য সুলতনা কামালসহ আরো চারজন নারী CNC প্রশংসা পান। তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানে, ‘মুক্তির জন্য যুদ্ধ, অপমান-বৈষম্য-অবমাননা থেকে মুক্তি। প্রত্যেকটা মানুষ ভাববে মানুষ হিসেবে আমার আপন মর্যাদা আছে। একজন মানুষের সত্তার স্বীকৃতি। আমাদের সংবিধানেই আছে সেটা হলো মুক্তিকামী মানুষের ইচ্ছার দলিল। এদেশের মালিকানা এদেশের জনগণের। এই মালিকানা ভালোবাসার, এদেশকে রক্ষা করার। একুশের চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও ছিল এটাই। আমাদের দেশের মানুষের মৌলিক চিন্তাটা হলো- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। আমি মনে করি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিজেদেরকে আরো সৎভাবে, স্বচ্ছভাবে, সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারকে আরো সমৃদ্ধ করতে হবে, ছড়িয়ে দিতে হবে।’

ব্যক্তিজীবনে সুলতানা কামাল সিলেট জেলার খ্যাতিমান আইনজীবী সুপ্রিয় চক্রবর্তীকে বিয়ে করেন। তাদের একমাত্র সন্তান দিয়া সুদেষ্ণা অমৃতা চক্রবর্তী লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক এবং পরে বার এট ল পাশ করে ব্যারিস্টার হয়েছেন। দিয়া সুদেষ্ণা চক্রবর্তী একজন সম্ভাবনাময়ী সুগায়িকা হিসেবেও পরিচিতিলাভ করেছেন। তার গানের এলবামও প্রকাশিত হয়েছে। তার স্বামী আমাদের পরম শ্রদ্ধার প্রিয় মানুষ সুপ্রিয় চক্রবর্তী জড়িয়ে আছেন আমাদের মনে, ভাবনার অনুভবে। তার জন্মদিনে সুপ্রিয়দাকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি আমরা। কারণ আমাদের কাছে সুলতানা কামাল এবং সুপ্রিয়দা যুগলবন্দি আত্মীয়তার বন্ধনে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ।

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বাংলাদেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও ভূমিকা রেখেছেন। ২০০৮ সালে ৪১ দিনের জন্য তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইয়াজউদ্দিন আহমেদের সময়কালে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নীতির প্রশ্নে আপস না করায় ২০০৮ সালের ১১ই ডিসেম্বর তিনি তার তিন সহকর্মীকে নিয়ে উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি অন্যায়ের সাথে কখনো আপস করেননি বলেই জীবনের নানাপর্বে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও কখনো দ্বিধা করেননি। তিনি নাগরিক অধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন। ধর্মনিরপেক্ষ, মুক্তবুদ্ধিচর্চার অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে, সুশাসন সুনিশ্চিত করতে, দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আজন্মের সৈনিক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। মানবিক বাংলাদেশ গড়ার অসম্ভব আশাবাদী ও সক্রিয় মানুষ এবং আমাদের সকলের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব সুলতানা কামালের জন্মদিনে তাঁর সুস্থ ও কর্মক্ষম দীর্ঘায়ু কামনা করি।

আবদুল্লাহ আল মোহন: লেখক, গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে নতুন ঘর পেল চার জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩০০ পরিবার
ঈদের আগেই আসছে নতুন নোট, নকশায় থাকছে জুলাই অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি
টাঙ্গাইলে ৫ বছরেও অসমাপ্ত ব্রিজের নির্মাণকাজ! ঠিকাদার লাপাত্তা ৬ মাস 
সাবেক এনআইডি ডিজি সালেহ উদ্দিনের এনআইডি ‘ব্লকড’
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা