অগ্নিঝুঁকি প্রতিরোধে ভবন ব্যবহারের সনদ কার্যকর এবং তদারকি জোরদারের আহ্বান 

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ১০ মার্চ ২০২৪, ১৭:৪৫

অগ্নিঝুঁকি প্রতিরোধে ভবন ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সংক্রান্ত সনদ নেওয়াকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা এবং যথাযথ তদারকির মাধ্যমে ঝুকিপূর্ণ ভবনগুলোকে চিহ্নিত করে ঝুঁকিপূর্ণ বলে নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

‘নীমতলী থেকে বেইলি রোডর অগ্নিকান্ডের বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এই মতামত ব্যক্ত করেন। শনিবার বিকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম-এসএনএফ, সেইফটি এন্ড রাইটস সোসাইটির (এসআরএস) যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করেন।

আগুন লাগার ঘটনাগুলোর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও ভুক্তভোগীর পরিবার এখনও আইনগত প্রতিকার পায়নি বলে বক্তারা বিচার প্রক্রিয়া তরান্বিত করার জোর দাবি জানান।

সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বলেন, এই হত্যাগুলোকে অবহেলজনিত হত্যাকান্ড না বলে বেআইনি কার্যক্রমের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত যারা আছেন তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।

পরিবেশ আইনজীবী সমিতি-বেলার প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পাঁচ-দশ তলা উচু ভবন পুরান ঢাকার ক্যামিক্যাল গুদাম এবং এইসব ভবনে অগ্নিনিরাপত্তার কোনো নির্দেশিকা মানা হয়নি। আমাদের প্রায়শই জাহাজভাঙ্গার শিল্পে, বস্তিতে, মার্কেটে আগুন লাগছে। আমাদের সঙ্গে আমাদের শিশুরাও ভীত এমন পরিস্থিতিতে। নাগরিকদের নিরাপত্তায় তাদের জীবনের অধিকারের আমাদের জন্য জাস্টিস হবে তখনই যখন আমরা যাতে এই স্বস্তিতে ভবনে থাকতে পারি যে নূন্যতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আছে সেজন্য মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এক লাখ ভবন যদি উচ্চ ঝুঁকি সম্পন্ন হয় তবে টাস্কফোর্স তৈরি করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য ভবন, মালিক, স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, প্রকোশলীসহ ডেভেলাপারকে কাজে লাগাতে হবে। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে পুরো কাজ সম্পন্ন করতে হবে যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হয়। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি যেমন নিশ্চিত করত হবে, ক্ষতিগ্রস্থ মানুষকে তেমনি যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ব্যাংকগুলো প্রধানমন্ত্রীর ত্রান তহবিলে টাকা জমা দিলেও চুড়িহাট্টার কেউ এখনো কোন ক্ষতিপূরণ পায় নি,তার জবাব ও দিতে হবে।

ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মতে বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন / সক্রিয়করণে রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের কথা বলা হলেও অদ্যবধি যথাযথভাবে তা কার্যকর করা হয়নি। এ ভবনগুলো অনুমোদন, তৈরি ও ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সঠিক ব্যবস্থা না নিয়ে বিশেষ অভিযানের নামে নির্বিচারে আটক কখনোই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে না। এ ঘটনাগুলো প্রতিরোধের দিকেও আমাদের সমান গুরুত্ব দিতে হবে। এই ভয়াবহ আগুনে প্রাণহানি এবং দুর্ভোগের দায় সরকারের নিতে হবে।

স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, রাজউকের এক সম্মুখ সমীক্ষায় দেখা গেছে ঢাকা শহরে পাঁচ তলা বা এর কম ভবনের সংখ্যা আট শতাংশ। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৯৫ হাজার ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু জরিপে উঠে এসেছে ৯৫ হাজার ভবনের কেবল চার হাজার ১৭৫টি ভবনে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ২০২৪-২০২৭ সালের নির্মিত ভবনের ৯৬ শতাংশ ভবন অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেন্দ্রীভুত নগর ব্যবস্থাপনার কারণে এই নগরী জনবহুল এবং অপরিকল্পিত নগরীতে পরিনত হচ্ছে।

ইকবাল হাবিব বলেন, এমনভাবে আইনগুলো বিক্ষিপ্ত করা হয়েছে যে কাউকে আলাদাভাবে আইনের আওতায় আনা যায় না। এটি মূলত দায় এড়ানোর জন্য করা হয়েছে। ফায়ার ফাইটার এক্ট ২০১৩ সালে প্রণয়ন করা হলেও ফায়ার সার্ভিসের আইনের বিধি-বিধান ২০১৫ সালে একটি ছোট নোটিশের মাধ্যমে স্থগিত করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স এ পর্যাপ্ত পদায়ন করা হচ্ছে না। টাস্কফোর্স তৈরি করে ছয়টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সাধন করে অবৈধ দালনগুলোকে পরিসীমিত ও যথাযথ করে অনুমোদিত ভবনের আওতায় আনতে সার্টিফিকেট চালু করা এবং তা জনস্বার্থে ভবনের দ্রশ্যমান স্থানে টাঙ্গিয়ে দেওয়ার নিয়ম চালু করতে হবে।

এই স্থপতি বলেন, নবায়নযোগ্য কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট চালু করা হয় এবং তা জনস্বার্থে ভবনের সামনে টাঙিয়ে দেয়ার নিয়ম চালু করা হোক যাতে জনগণ নিজে তার সুরক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর সাংঘষিকতা দূরীভূত করে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান বলেন, ফায়ার সার্ভিসে একই লোক ফায়ার ফাইটিং করছে, এবং প্রশাসনিক কাজ করে এবং তাদের গঠন ও অনেক পুরোনো। তাদের প্রিভেনটিব উইংকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। ট্রেনিং প্রোগ্রাম, এসেসম্যান্ট, টাস্ক ফোর্স গঠন এবং রেগুলেটরী সংস্থাকে কার্যকর করার ব্যবস্থা করতে হবে।

আলী আহমেদ খান বলেন, প্রতিটি ভবনে বহির্গমন পথ ও একটি ছোট টিম রাখা প্রয়োজন যারা এই ধরনের দুর্ঘটনায় আটকে পড়া লোকজনকে বের করার পথ দেখিয়ে দেবে। কারণ প্রথমেই যদি এই উদ্যোগ নেওয়া যায় তাহলে দুর্ঘটনার মাত্রা অনেক কমিয়ে আনা যায়। আমাদের অতিদ্রুত কিছু জনসংযোগের জন্য কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। এবং আমাদের সকলকে একত্রে উদ্যোগ নিতে হবে।

বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ইয়াসির আরাফাত খান বলেন, বছরে প্রায় ২৪ হাজারের মতো অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার কারণগুলো অনেকক্ষেত্রেই একই। বেসিক ফায়ার প্রটেকশন, অকুপেন্সীর উপর দালনের নিরাপত্তা নির্ভর করে। বেইলি রোডের ফায়ার দেখলে বুঝা যায় দালানের বহির্গমন পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। ভবন কর্তৃপক্ষ জানমালের নিরাপত্তায় বিনিয়োগ করে না বলে দুর্ঘটনাগুলো এত বেশি হচ্ছে।

অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিতে করণীয় সম্পর্কে বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ারুল হক বলেন, ছয় মাস পর পর ভবনের বৈদ্যুতিক তারগুলোর লোড চেক করতে হবে, যাতে করে শর্ট সার্কিট না হয়। এছাড়া ওয়াসার প্রতিটি এলাকায় হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করায় গুরুত্ব দিতে হবে যাতে দ্রুত আগুন নেভানো যায়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় উক্ত সভায় স্বাগত বক্তব্য এবং উদ্দেশ্য উপস্থাপন করেন ব্লাস্টের পরিচালক (আইন) মো. বরকত আলী। সমাপণী বক্তব্য দেন ব্লাস্টের এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।

(ঢাকাটাইমস/১০মার্চ/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :