অনিয়মের স্বর্গরাজ্য সালথা-নগরকান্দা সমাজসেবা অফিস, ভোগান্তির শেষ নেই

নুরুল ইসলাম, সালথা-নগরকান্দা (ফরিদপুর)
  প্রকাশিত : ১১ জুন ২০২৪, ১৭:০২
অ- অ+

শতশত জীবিত মানুষকে মৃত দেখিয়ে বাতিল করা হচ্ছে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা। অসহায়দের ভাতা পেতে লাগছে ঘুস, হয়রানির শিকার যেখানে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। মাসের পর মাস ঘুরে ঘুসের টাকা দিয়েও অনেকের কপালে জুটছে না ভাতা। কারো কারো আবার ভাতা হওয়ার পরও পাচ্ছেন না টাকা। এছাড়াও, নানা কৌশলে ভাতাপ্রাপ্তদের বিকাশ নম্বর ভুল দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ভাতার টাকা। এমন লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে ফরিদপুরের সালথা ও নগরকান্দা উপজেলা সমাজসেবা অফিসে।

গত কয়েক বছর ধরে এই দুটি সমাজসেবা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের অফিসকে অনিয়ম-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন। তাদের স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতির ফলে চরম বেকায়দায় পড়ে প্রতিনিয়ত নাজেহাল হচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। অভিযোগ আছে এসব দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের যোগসাজশ রয়েছে। যে কারণে অনিয়ম-দুর্নীতির দায় নিয়ে ঠেলাঠেলি করছে সমাজসেবা অধিদপ্তর ও ইউনিয়ন পরিষদ।

অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, সচিব ও উদ্যোক্তারা অর্থের বিনিময় জীবিত ব্যক্তিদের মৃত সনদ সরবরাহ করছেন। সেই সঙ্গে নিজেদের পছন্দ মতো ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে সমাজসেবা অফিসে আবেদন করেন। পরে সমাজসেবা অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অর্থের বিনিময় ম্যানেজ করে নিজেদের পছন্দের লোকদের ভাতার আওতায় নিয়ে আসেন। এর ফলে অনেক অসহায়, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও বিধবা নারী ভাতার তালিকায় নাম ওঠাতে পারছেন না।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীদের ভাতা দেওয়ার কথা বলে ৯৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গেল বছরের ২৩ জুন নগরকান্দার সমাজসেবা অফিসার আবুল কালাম আজাদকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনায় তার স্ত্রী-সন্তানরাও জেল খাটেন। তিনি বরখাস্ত হওয়ার পর গত ১০ মাস ধরে নগরকান্দার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন সালথা উপজেলা সমাজসেবা অফিসার সৈয়দ ফজলে রাব্বী নোমান।

তার বিরুদ্ধেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। তিনিও অনিয়মের মাধ্যমে সালথায় ৯ বছর ধরে কর্মরত আছেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী একজন সরকারি কর্মকর্তা এক কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি থাকতে পারবেন না। তাছাড়া তিনি ঠিকমতো অফিসও করেন না। প্রায় দিনই তার অফিসের দরজা খোলা থাকলেও সেবাপ্রত্যাশীরা তাকে পান না বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন।

সরেজমিনে গত কয়েক দিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরকান্দার জগদিয়া বালিয়া এলাকার নুরজাহান বেগমের বয়স্ক ভাতা, ব্রাক্ষণডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল আলী মোল্যার বয়স্ক ভাতা, একা রানী বিশ্বাসের বয়স্ক ভাতা, আলাউদ্দীন সরদারের বয়স্ক ভাতা, শংকরি রানী বিশ্বাসের বিধবা ভাতা, বড় কাজলী গ্রামের আয়মানা বেগমের বয়স্ক ভাতা, দফা গ্রামের রোকেয়া বেগমের বয়স্ক ভাতা, খবিরন নেছার বিধবা ভাতা, মিলন খানের প্রতিবন্ধী ভাতা, গোয়ালদী গ্রামের মরিয়মের বয়স্ক ভাতা, পুরাপাড়া গ্রামের মো. ইদ্রিস খানের বয়স্ক ভাতা ও মুকন্দপট্টি গ্রামের মো. রুস্তম আলী মীরের প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড বাতিল করা হয়েছে।

এদের সবাইকে মৃত দেখিয়ে তাদের ভাতা বাতিল করা হয়। পুরাপাড়া ইউনিয়নের দফা গ্রামের ভুক্তভোভোগী খবিরন নেছা বলেন, ‘১৫ বছর আগে আমার নামে একটা বিধবা ভাতার কার্ড হয়। এরপর থেকে আমি কয়েক বছর ঠিকমতো টাকা পাইছি। কিন্তু গত তিন বছর ধরে আমি কোনো টাকা পাই না। সমাজসেবা অফিসে গিয়ে খোঁজ নিলে সেখান থেকে বলে, তুমি মৃত, তোমার ভাতা বাদ।’

প্রতিবন্ধী মিলন খানের মা শাহিনুর বেগম বলেন, ‘ছয় বছর আগে আমার ছেলে মিলনের প্রতিবন্ধীর ভাতার কার্ড হয়। এরপর মাত্র একবার টাকা পাইছে। এখন পর্যন্ত আর কোনো টাকা-পয়সা পায়নি আমার ছেলে। শুনেছি ভাতা বন্ধ করে দিছে। গ্রাম পুলিশ, স্থানীয় মেম্বার ও সমাজসেবা অফিসে ৬ হাজার টাকা দিয়েও ভাতা ফেরত পাইনি আমরা।’

শুধু এরাই নয়, নগরকান্দায় কয়েক বছরে এদের মতো শতশত ভাতাপ্রাপ্ত জীবিত নারী-পুরুষকে মৃত দেখিয়ে ভাতা বাতিল করা হয়েছে। তবে কীভাবে এদের মৃত দেখানো হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। কেউ কেউ বলছেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মৃত সনদ নিয়ে সমাজসেবা অফিসে জমা দিয়ে তারপর এদের ভাতা বাতিল করা হয়েছে।

তবে নগরকান্দার মধ্যে মৃত দেখিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাতা বাতিল হয়েছে পুরাপাড়া ইউনিয়নে। এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আতাউর রহমান বাবু ফকির বলেন, ‘অনেককেই মৃত দেখিয়ে ভাতা বাতিল করা হয়েছে। আমি এসব বিষয় আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে উপস্থাপন করেছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার ইউনিয়ন থেকে কাউকে মৃত সনদ দেওয়া হয়নি। কোথা থেকে এসব মৃত সনদ তৈরি করা হয়েছে, তা আমার জানা নেই।’

এদিকে সালথা উপজেলা গট্টি ইউনিয়নের কাউলীকান্দা গ্রামের নুপি খাতুন, রেজিয়া বেগম, সিংহপ্রতাব গ্রামের আমেনা বেগম, ফুলজা খাতুন ও আমেনা খাতুনের বয়স্ক ভাতার বাতিল করা হয়েছে। তাদেরও মৃত দেখিয়ে ভাতা বাতিল করা হয়।

এরমধ্যে ৮০ বছর বয়সী নুপি খাতুন বলেন, ‘দুই বছর ধরে আমার ভাতার কার্ড হইছে। আমি অনেকবার ভাতার টাকা পাইছি। কিন্তু আমি ছয় মাস ধরে টাকা পাই না। শুনছি, আমাকে মৃত দেখিয়ে আমার ভাতা বাদ দিয়ে দিছে।’

গট্টি ইউনিয়নের পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান লাবলু জীবিত ব্যক্তিকে মৃত সনদ দেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাহজাহান মোল্যা বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে কয়েকজন জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে ভাতা বাতিল করা হয়েছে। এ ঘটনাটি ভুলে হয়ে গেছে।’

বল্লভদী ইউনিয়নের কেশারদিয়া গ্রামের ফিরোজা বেগম বলেন, ‘আমি অন্ধ, প্রতিবন্ধীর ভাতার জন্য গত ১০ মাস আগে ইউনিয়ন পরিষদের গিয়ে আবেদন করি। সেখানে আমার কাছ থেকে ২০০ টাকা নেয়। এরপর সমাজসেবা অফিসে গেলে এক মহিলা একটা কাগজ হাতে দিয়ে ৩০০ টাকা নিয়ে বলে আপনার প্রতিবন্ধী ভাতা হয়ে গেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা টাকাও পেলাম না। আমি গরিব মানুষ, শুধু শুধু ভাতার জন্য দৌড়াদৌড়ি করে আমার দুই হাজার টাকা খরচ হয়েছে।’

ফুলবাড়িয়া গ্রামের টুকু শেখ বলেন, ‘৭-৮ মাস ধরে আমার প্রতিবন্ধী ভাতা হইছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত টাকা পাইনি।’

ভাওয়াল ইউনিয়নের পুরুরা সাধুপাড়া গ্রামের বয়স্ক ভাতাভোগী সোরাপ মোল্যার ছেলে মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাবার ভাতা ৭-৮ বছর আগে হয়েছে। ব্যাংকের মাধ্যমে যখন টাকা পেতাম, তখন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু বিকাশে টাকা লেনদেন শুরু হওয়ার পর সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমে পরপর ৩ বার আমার বাবার বিকাশ নম্বরে কোনো টাকাই আসেনি। অন্য একটি নম্বরে তার টাকা চলে যেত। যে নম্বরে টাকা যেত, সেই নম্বরে ফোন দিলে বন্ধ পাওয়া যেত। এটা সমাজসেবা অফিসের কারসাজি, তারা বিভিন্ন বিকাশ নম্বর দিয়ে ভাতাভোগীদের টাকা হাতিয়ে নেয় বলে আমার ধারণা।’

সালথা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা (নগরকান্দায় অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) সৈয়দ ফজলে রাব্বী নোমান বলেন, ‘নগরকান্দার সাবেক সমাজসেবা অফিসার কর্মকালীন সময় জীবিত লোক মৃত দেখিয়ে ভাতা বাতিলের এসব ঘটনা ঘটেছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক লোকজন এসব অভিযোগ আমার কাছে দিয়েছে। আমি এসব অভিযোগে বিষয় হেড অফিসকে অবগত করেছি। তারা ব্যবস্থা নিতে চেয়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘সালথায় গট্টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত মৃত সনদ ও রেজুলেশনসহ ছয়টা নাম আমাদের অফিসে আসে। সেগুলো আমরা চেক করে দেখি তারা জীবিত, কিন্তু তাদের মৃত সনদ দিয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। পরে বিষয়টি আমরা ইউএনও স্যারকে জানাই।’

সমাজসেবা অফিসে ঘুস-বাণিজ্য আর অনিয়মের বিষয় তিনি বলেন, ‘এসব বিষয় কেউ যদি লিখিত অভিযোগ দেয়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বালী বলেন, ‘সমাজসেবা অফিস থেকে কেউ যদি হয়রানির শিকার হয় বা অর্থ লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর জীবিত ব্যক্তি যারা মৃত দেখিয়ে বাতিল করা হয়েছে এমন অনেক অভিযোগ আমরা পেয়েছি। জীবিত ব্যক্তিকে মৃত নিবন্ধন দেওয়ার ঘটনার সঙ্গে যেসব ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার ও সচিব জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ফরিদপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক এএসএম আলী আহসান বলেন, ‘এসব বিষয় আমার জানা ছিল না। এসব ঘটনার তদন্ত করা হবে। তবে সালথা ও নগরকান্দা সমাজসেবা অফিসের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর এক কর্মস্থলে ৯ বছর থাকা সালথা সমাজসেবা অফিসার দ্রুত বদলির ব্যবস্থা করা হবে।’

ফরিদপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল নগরকান্দা) মো. আসাদুজ্জামান শাকিল বলেন, ‘জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখানো চরম প্রতারণা। এসব বিষয় কেউ অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ নিয়ে শুক্রবার (৭ জুন) সকালে ফরিদপুর জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার বলেন, ‘সমাজসেবা অফিসের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর জীবিত ব্যক্তিদের মৃত সনদ দেওয়ার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। এসব ঘটনায় যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর দীর্ঘদিন এক কর্মস্থলে থাকা সমাজসেবা অফিসারকে বদলির ব্যবস্থা করা হবে।’

(ঢাকাটাইমস/১১জুন/এসআইএস)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আজ দেশে ফিরছেন খালেদা জিয়া, পথে পথে অভ্যর্থনা জানাবেন নেতাকর্মীরা
হিরো আলমের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও গর্ভপাত ঘটানোর অভিযোগে মামলা
প্যাথলজিক্যাল নমুনা বিদেশে পাঠাতে অনুমতি লাগবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের
বেইলি রোডে ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টারে আগুনের সূত্রপাত নিয়ে যা জানা গেল 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা