মাদকের ভয়াল থাবা

কাদের গনি চৌধুরী
  প্রকাশিত : ০৬ জুলাই ২০২৪, ১৫:৪৩| আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৪, ১৫:৪৭
অ- অ+

গোটা দেশ জুড়ে মাদক ভয়ঙ্কর থাবা বিস্তার করেছে। শুধু শহর নয় প্রত্যন্ত গ্রামেও অবাধে চলছে মাদক ব্যবসা। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে সব ধরনের মাদক। ফোন করলেই বাসায় চলে আসছে এসব মরণ নেশা। মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে প্রসারও। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবাধে আসছে মাদকদ্রব্য।

নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই এখন সবচেয়ে লাভবান ব্যবসা। বিশেষ করে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সহজলভ্য এবং বহনযোগ্য বলে এর বিস্তার দেশজুড়ে। সত্যি বলতে কি দেশের এমন কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে মাদকের থাবা নেই। দেশজুড়ে এক বিশাল জাল বিস্তার করে আছে এই মরণ নেশার ভয়াবহ সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র মাফিয়াদের সঙ্গে রয়েছে এদের শক্ত ও গভীর যোগাযোগ। সম্প্রতি ইয়াবার যেসব চালান ধরা পড়েছে সেখানেও দেখা যায় মিয়ানমারের নাগরিকরা জড়িত। টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার থেকে বেশিরভাগ মাদক আমাদের দেশে আসে। এছাড়াও রয়েছে মাদকের বিভিন্ন রুট। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সীমান্ত এলাকায় মাদকের ছড়াছড়ি। এর কিছু ধরা পড়ে। বাকিটা চলে যায় মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে।

মাদকের ভয়াল থাবায় জরাজীর্ণ দেশের সোনালি এক প্রজন্ম। যে প্রজন্মের সময় কাটতো বিদ্যালয়ের বারান্দায়, বন্ধুদের আড্ডায় থেকে শুরু করে বিস্তীর্ণ খেলার মাঠে।যারা বড় হয়ে উপহার দিতো এক সোনালি বাংলাদেশ।অথচ, স্বপ্নের মতো সেই প্রজন্ম আজ মাদকের ভয়াল থাবায় নাস্তানাবুদ! ভয়াল এই থাবা প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ যেমন করছে অনিশ্চিত, ঠিক তেমনি ধুঁকে ধুঁকে ছিন্ন করছে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য

মাদকাশক্তি আধনিক সভ্যতার বিপজ্জনক রোগ। এইডস, ক্যান্সারের মতো মাদকাশক্তি ও ভয়াবহ রোগ। বর্তমান বিশ্বে পারমানবিক মারণাস্ত্রের চেয়েও ভয়ংক রূপ নিয়েছে মাদকাসক্তি। যা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের জাতির ভবিষ্যত যুব সমাজকে। অকালে ঝড়ে যাচ্ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। মাদকের কারণে দাম্পত্য জীবনে কলহের জেরধরে ভেঙ্গে যাচ্ছে অসংখ্য সুখের সংসার। এটি আজ প্রমাণিত সত্য যে, মাদক সব অপকর্ম ও অশ্লীলতার মূল।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকের সাথে অপরাধ ও অপরাধীদের একটি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। মাদক ক্রয়ের জন্য মাদকাসক্তরা যে কোনো ঘৃণিত কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদ্র অপরাধ থেকে শুরু করে ‘হোয়াইট কলার’ ক্রাইম পর্যন্ত করে ফেলে। ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি লুণ্ঠন, রাহাজানি, ধর্ষণ হত্যা, পতিতাবৃত্তি, অপরহরণ, মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি ইত্যাদি জগণ্য অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে মাদকের দ্বারা। এমনও দেখা গেছে পরিবারের একজন মাদক সেবার কারণে পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে।বহুল আলোচিত পুলিশ দম্পত্তির লোমহর্ষক হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছে তাদের কিশোরী কন্যা ঐশী। তদন্তে জানা গেছে সে ছিল মাদকসক্ত।প্রায় ছেলে বন্ধুদের নিয়ে ক্লাবে গিয়ে দীর্ঘ রাত আড্ডা দিতো এবং মাদক সেবন করতো।

গত ২৭ মে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারে মাদকাসক্ত ছেলে হাতে খুন হয়েছেন পিতা উন্মেষ সরকার। চৌগাছায় মাদকাসক্ত ছেলের হাতে বাবা-মা খুন হয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে মাদকাসক্ত ছেলের হাতে মা খুন হয়েছেন। অতি সম্প্রতি গাজীপুরের কালীগঞ্জে মাদকাসক্ত ছেলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাবা ঘুমন্ত অবস্থায় ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

এভাবে প্রতিনিয়ত কত যে মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে তা সঠিক পরিসংখ্যান নেই। মাদকাসক্তের কারণে নৃশংসতা এতো বেড়েছে যে, গত ১০ বছরে মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে ২০০ বাবা-বাবা মারা গেছেন।

বাংলাদেশে মাদকের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড এন্ড ডেভেলপমেন্ট আস্কটাড প্রতিবেদনে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতি বছর পাচার হয়ে যায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। আর মাদক কেনাবেচা করে অর্থ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৫ম। এশিয়ার দেশগুলোতে মাদকের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনায় বাংলাদেশ একেবারে শীর্ষে রয়েছে। আঙ্কটাডের প্রতিবেদন অনুযায়ী মাদকের অবৈধ অর্থ প্রবাহের দিক থেকে বিশ্ব প্রথম স্থানে রয়েছে মেক্সিকো। এরপর যথাক্রমে কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু ও বাংলাদেশ।

সম্প্রতি বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছেন র‍্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমদ। তিনি জানান, দেশে মাদকসেবী রয়েছে ৭০ লাখ আর তারা বছরে ১ লাখ কোটি টাকার মাদক সেবন করে। যা বাংলাদেশের বাজেটের ২১ শতাংশের বেশি। আর উন্নয়ন বাজেটের ৫৬ শতাংশ।

মাদক দ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) েতথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮০ লাখ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই মাদকদ্রব্য সেবনের প্রবণতা বেশি। ধনীর দুলাল-দুলালীদের কাছে এটি আভিজাত্যের প্রতীক। মাদকদ্রব্যের সম্মোহনে হারিয়ে যেতে এরা ভালবাসে। মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে এরা অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতে চায়। রক্ত প্রবাহে মাদকদ্রব্যের জৈব রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া এদেরকে প্রদান করে এক ধরণের উষ্ণতা। এ পুলক, অনুভূতি, স্বপ্নিল তন্দ্রাচ্ছন্নতা ও নষ্ট আনন্দ একসময় এদেরকে আসক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। আমাদের দেশে শিক্ষিত ও সচেতন মাদকাসক্তদের মধ্যে এমন অনেককেই পাওয়া যায় যারা মনে করেন মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে মেধা স্বচ্ছ থাকে, কাজে আনন্দ পাওয়া যায়, ফলে সহজে সাফল্য আসে। মাদকদ্রব্যের গুণাগুণ সম্পর্কিত যুক্তিগুলোর অধিকাংশগুলোই দুর্বল মানসিকতার পরিচয় বহন করে।

যেভাবে মাদকের বিস্তার বাংলাদেশে:

এক সময় ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে ফেনসিডিল ঢুকতো। এরপর ফেনসিডিলের জায়গা দখল করে নেয়ে হেরোইন। আর এখন দেশে ইয়াবার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ের ইয়াবার চেয়ে ভয়ংকর মাদক ‘আইস’ দেশে ঢুকছে।

বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত এলাকায় ভারত ও মিয়ানমারে অনেক মাদক কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখারা উৎপাদিত মাদক পাঠানো হয় বাংলাদেশে। সেখানকার মানুষ খুব একটা মাদক সেবন না করলেও শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য তারা বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে।

দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় "দেশের তরুণ প্রজন্মের এক চতুর্থাংশ কোনো না কোনো ধরনের নেশায় আসক্ত।" অনুসন্ধানী এ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ১৭ জনের একজন তরুণ মাদকাসক্ত। ছিন্নমূল শিশু কিশোররাও জুতা তৈরি গাম দিয়ে নিয়মিত নেশায় মত্ত রয়েছে। এক গবেষণায় দেখা যায়,৫৭ শতাংশ মাদকাসক্ত নানা অপরাধে জড়িত। আবার তাদের ৭ শতাংশ এইচআইভি ভাইরাসে সংক্রমিত।

মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে। তবে দেশে ৩২ ধরণের মাদক সেবন হয় বলে একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে।

গবেষণায় বলা হয়,দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বেশিরভাগ মাদক। মাদকের প্রবেশ পথ হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে।

এরমধ্যে বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের হাসনাবাদ, ঢাকি, বসিরহাট, পেট্রাপোল, বাদুড়িয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাঁও, স্বরূপনগর, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রানাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদিয়া, মালদহ, বালুরঘাট, আওরঙ্গবাদ, নিতিতাসহ সীমান্ত সংলগ্ন প্রায় সব এলাকার দিয়ে ১৫টি পয়েন্টে বাংলাদেমের সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেরেপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর এলাকার মাদক ঢুকছে।

ভারতের আসাম-মেঘালয়ের বাংলাদেশ সংলগ্ন এলাকাগুলোর ৪টি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিং ও নেত্রকোনায়। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরামের ৪টি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনীতে। এ ছাড়া ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে বাংলাদেশের নওগাঁয় ফেনসিডিল পাচারের নতুন রুটের সন্ধান পাওয়া গেছে।

মিয়ানমারের সঙ্গে মাত্র ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্তে সবচেয়ে সক্রিয় মাদক রুটগুলো গোটা দেশে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কক্সবাজার ও পার্শ্ববতী বান্দরবানের ঘুমধুম, নাইক্ষ্যংছড়ি, দমদমিয়া, জেলেপাড়ার প্রায় অর্ধশত স্পট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা, আইস কোনটিই দেশে উৎপাদিত না হলেও তা পাওয়া যাচ্ছে যত্রতত্র। তার মানে কি এই নয় যে, আমাদের সীমান্ত।

ইয়াবার থাবা:

‘ইয়াবা’ মূলত থাই শব্দ, যার অর্থ ‘ক্রেজি মেডিসিন’ বা ‘পাগল ওষুধ’, এটির মূল উপাদান মেথঅ্যামফিটামিন। ইয়াবা এক ভয়াবহ মাদক, যা মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র এবং শরীরের যে কোনো অঙ্গকেই আক্রান্ত করতে পারে। মেথঅ্যামফিটামিনের সঙ্গে ক্যাফেইন বা হেরোইন মিশিয়ে ব্যবহার হয় মাদকদ্রব্য হিসেবে। বর্তমানে তরুণ-তরুণীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে মূল উপাদানের সঙ্গে মেশানো হয় আঙ্গুর, কমলা বা ভ্যানিলার ফ্লেভার, সবুজ বা লাল কমলা রং। ইয়াবা নামের ছোট্ট ট্যাবলেটটি দেখতে অনেকটা ক্যান্ডির মতো, স্বাদেও তেমনই। ফলে আসক্ত ব্যক্তিরা এর প্রচন্ড ক্ষতিকর প্রভাবটুকু প্রথমে বুঝতে পারে না। কারণ এটি শুরুতে সেবনকারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙা করে তোলে। একবার সেবন করলে এর দিকে আরও ঝুঁকে পড়ে। ইয়াবার আনন্দ আর উত্তেজনা আসক্ত ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয় জীবনের সব যন্ত্রণা, তারা বাস করে স্বপ্নের এক জগতে। তাই অনেকেই নানারকম হতাশা-ব্যর্থতা, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ এবং অসৎ সংসর্গে শুরু করে ইয়াবা সেবন। ইয়াবার প্রচন্ড উত্তেজক ক্ষমতা আছে বলে যৌন উত্তেজক হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে। যাদের ওজন বেশি তাদের কেউ কেউ সিøম হওয়ার ওষুধ হিসেবে শুরু করে ইয়াবা সেবন। ঘুম কমিয়ে দেয় বলে সারা রাতের পার্টির আগে ক্লান্তিহীন উপভোগ নিশ্চিত করতে অনেকের পছন্দ ইয়াবা। আবার কিছু শিল্পীও ইয়াবা সেবন করেন তাদের শিল্পকর্মের দক্ষতা বাড়বে মনে করে। রাত জেগে বেশি বেশি পড়াশোনার জন্য ঘুম কমানোর ওষুধ হিসেবে খায় শিক্ষার্থীরা। এভাবে সাময়িক লাভের ট্যাবলেটটি কখন যে তাদের ধ্বংসের পথে নিয়ে যায় তা তারা টেরও পায় না। অতিরিক্ত আইস সেবনে অনিদ্রা, অতি উত্তেজনা, মানসিক অবসাদ, বিষণ্ণতা, স্মৃতিভ্রম, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি ও লিভারের জটিলতা হতে পারে। আবার এই মাদকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেলে এবং পরে তা বন্ধ করলে, মানসিক অবসাদ বা বিষণ্ণতার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা হতে পারে।

অধিকাংশ মাদক নকল ও ভেজাল:

বাংলাদেশে যেসব মাদক পাওয়া যায় তার ৮৫ শতাংশই ভেজাল। সহজে অর্থ অর্জনের জন্য হয় নকল করছে অথবা ভেজাল মেশাচ্ছে। ফলে মাদকাসক্তরা নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

রাজশাহীতে ২০২১ সালে থাটি ফাস্ট নাইটে ভেজাল মদ খেয়ে মারা গেছেন ৫ জন। দেশ রূপান্তরের এক খবরে বলা হয় ভেজাল মদ খেয়ে ১৪ দিনে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। বিদেশী মদ আমদানি কঠোর হওয়ায় বিভিন্ন নামীদামী ব্রান্ডের বোতল কিনে তাতে তৈরি হচ্ছে ভেজাল মদ। আর এসব মদ খেয়ে প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। বিবিসি বলছে এসব ভেজাল মদ তৈরিতে প্রধান ব্যবহার হয় মিথানল ও স্প্রিট।

সর্বনাশা মাদকের দিকে ঝুঁকছে যুবকরা:

বাংলাদেশের বড় অংশের জনগোষ্ঠী কিশোর-তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। বাংলাদেশে ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বা এর নিচে। অর্থাৎ ৪৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। মাদকদ্রব্য ও নেশাবিরোধ সংস্থা- মানস এর হিসাব মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। এদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, ইয়াবা সেবনকারী শতকরা ৮৫ ভাগই তরুণ যুবসমাজ! আইস সেবনকারীদেরও ৮০ ভাগ তরুণ। যেভাবে বাংলাদেশে মাদকাসক্তের বাড়ছে ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।

মানসের তথ্যানুযায়ী, মাদকাসক্তদের মধ্যে আবার শতকরা ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত।ধূমপানে অভ্যস্ততার মধ্য দিয়ে তরুণরা মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীকালে ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেন, আফিস, কোডিন, মরফিন, এলএসডি, আইসসহ বিভিন্ন মরণনেশায় আসক্ত হয়। ক্রমান্বয়ে মাদকাসক্তরা কিডনি, লিভার, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশেরও বেশি কিশোর অপরাধী মাদকাসক্ত এবং তাদের বেশির ভাগই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। উপরন্তু, ৮৫ শতাংশ কিশোর অপরাধী মাদক কেনার কথা স্বীকার করেছে এবং ৫৫ শতাংশ স্বীকার করেছে যে, তারা মাদক বিক্রি করেছে। এদের অধিকাংশ স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকেই পরিচয় ঘটছে মাদকের সঙ্গে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে মাদক বিক্রি করে অসংখ্য মাদক চোরাকারবারি চক্র। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা, স্থানীয় চোরাকারবারি এমনকি ছাত্র-ছাত্রীরা এর সঙ্গে জড়িত!

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, গত ১০ বছরে নেশাখোর সন্তানের হাতে প্রায় ২০০ বাবা-মা খুন হয়েছেন, স্বামী হত্যা করেছে স্ত্রীকে, স্ত্রী হত্যা করেছে স্বামীকে।এমন কি বাবার হাতে খুন হয়েছে মাদকাসক্ত ছেলে।খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, পরকীয়া প্রেম, দাম্পত্য কলহ, অর্থ লেনদেন, হত্যা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম সবকিছুর মূলেই রয়েছে এই মাদকের নেশা। তাই মাদকাসক্তি প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, সরকারি-বেসরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট জোরদার করতে হবে। এমনকি পুলিশ সদস্যদের ডোপ টেস্ট যেন গতিশীল হয়। ডোপ টেস্টে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মূত্র বা রক্ত, আবার কখনো দুটির নমুনা পরীক্ষা করা হয়। মাদকগ্রহণ করা ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শেষ এক সপ্তাহে মুখের লালার মাধ্যমে, শেষ দুই মাস রক্তের মাধ্যমে, শেষ ১২ মাস বা এক বছরে চুল পরীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া যায় মাদকের নমুনা। বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, স্থানীয় সরকারি ও বেসরকারি সব চাকরিতে প্রবেশকালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সঙ্গে মাদক পরীক্ষার সনদ বা ডোপ টেস্টের রিপোর্ট জমা দিতে হয়। আবার চাকরিতে থাকাকালীন কোনো কর্মচারী বা কর্মকর্তার আচরণ সন্দেহজনক হলে, যে কোনো সময় তার ডোপ টেস্ট করানো যেতে পারে।

শিশুদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে মাদকাসক্তি:

বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মাদকসেবনের ঘটনা বাড়ছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি।বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, পথশিশুদের ৮৫ ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবন করে। এর মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট ও আট শতাংশ ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করে থাকে। সংগঠনটির তথ্যানুযায়ী ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে যেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সূত্র মতে, ঢাকা বিভাগে মাদকাসক্ত শিশুর প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ শতাংশ মেয়ে। মাদকাসক্ত ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে এবং মেয়ে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচন্ড ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

শিশু ও কিশোররা প্রথমে সিগারেট দিয়ে নেশার জগতে প্রবেশ করে। এরপর তারা আস্তে আস্তে গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, সিসা, ইয়াবা, পেথিড্রিন, ঘুমের ওষুধ, ড্যান্ডিসহ নানান ধরনের মাদকে আসক্ত হয়। তার মধ্যে পথশিশুদের কাছে মাদক হিসেবে আকষর্ণীয় মরণঘাতী নেশা ড্যান্ডি। ড্যান্ডি একধরনের আঠা, যা মূলত সলিউশন নামে পরিচিত। এতে টলুইন নামে একটি উপাদান আছে। টলুইন মাদকদ্রব্যের তালিকায় আছে। এটি জুতা তৈরি ও রিকশার টায়ার টিউব লাগানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি খেলে ক্ষুধা ও ব্যথা লাগে না। দীঘের্ময়াদে খেলে মস্তিষ্ক, যকৃত ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মাদকাসক্ত শিশু ও কিশোররা মাদক গ্রহণের কারণে বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। মাদকের বিষাক্ত নিকোটিনের কারণে তাদের কোষগুলো দুবর্ল হতে থাকে। এতে তার শরীর থেকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। মধ্য বয়সে বিকলাঙ্গও হয়ে যেতে পারে। ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে ৮০ ভাগ। এ ছাড়াও দৃষ্টিশক্তি লোপ পাওয়া, টাকা চুরির প্রবণতা বাড়া, পড়াশোনায় মনোযোগী না হওয়া, কমের্র শক্তি কমে যাওয়া, ঝগড়াপ্রবণ হওয়া, পরিবারের কথা না শোনা, ওজন কমে যাওয়া, খাওয়ায় অরুচিসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।

শিশু-কিশোরদের মাদকাসক্তির কারণ:

নিরাময় হসপিটালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শৈশব ও কৈশোরকালে মাদকের প্রতি ঝোঁক থাকে সবচেয়ে বেশি। কারণ, এই সময়টা জীবনের একটা উত্তরকালীন পর্যায়। আর, তখনই দুশ্চিন্তা ও হতাশাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে থাকে। বন্ধুদের চাপ কিংবা প্রলোভনে তখন মাদক নেওয়া শুরু হয়।

শুরুতেই আসক্তি সামান্য পর্যায় থাকলেও একটাসময় এসে নির্ভরশীলতা এতটাই তৈরি হতে থাকে যে মাদক ছাড়া অন্য কিছু বুঝতে পারে না ।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদকাসক্ত হওয়ার পিছনে শিশু-কিশোরদের পারিবারিক অবস্থা খুবই প্রভাব ফেলে। জরাজীর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থা এবং পারিবারিক নিয়মের অভাবের ফলে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা মাদকের প্রতি ঝুঁকতে থাকে।বিশেষ করে সন্তানের প্রতি মা-বাবার অবহেলা, সন্তান কি করছে, কাদের সাথে মিশছে এসব দিকে নজর না রাখা এর জন্য বহুলাংশে দায়ি।

মাঠ পর্যায়ের পরিসংখ্যান বলছে, বস্তিপাড়ায় বসবাস করা ৯০ শতাংশ শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুনী এবং প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা মাদকাসক্ত। এছাড়াও, পরিবারের কোনো সদস্য কোনোভাবে মাদকের সাথে যুক্ত হলে পরিবারের অন্যদের এর প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, একটা শিশু বেড়ে উঠার পথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তার বন্ধু এবং যাদের সাথে ওঠাবসা হয় প্রতিনিয়ত। অনেক সময় মাদকাসক্ত বন্ধুদের কু-প্রভাবেও ভালো ও মেধাবী শিশুকিশোর অসৎ সঙ্গে পড়ে মাদক সেবনের প্রতি উদ্ভুদ্ধ হচ্ছে এবং মাদক সেবন করছে।

জরিপও বলছে মাদকাসক্ত হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বেশি প্ররোচিত হয় সঙ্গদোষে। একটি জাতীয় দৈনিকের ২০১৯ এর জরিপে উঠে এসেছে, প্রায় ২৯ দশমিক ২ শতাংশ শিশু-কিশোর বন্ধুদের প্ররোচনায় মাদকাসক্ত হয়েছে।

শিশুকিশোর থেকে শুরু করে তরুন প্রজন্মের মধ্যে মাদকের মতো ভয়াল থাবা ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান আরেকটি কারণ হচ্ছে এর সহজলভ্যতা। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মফস্বল শহর, দেশের প্রায় প্রতিটা প্রান্তরে সিগারেট থেকে শুরু করে হেরোইন, মদ, ফেন্সিডিলের মতো ছোট, বড় ও মাঝারি সবধরনের ভয়াবহ মাদক সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়।পাশাপাশি এর মূল্যও অনেকটাই হাতের নাগালে। ফলশ্রুতিতে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সকল বয়সী ব্যক্তি মাদকের প্রতি সহজেই আসক্ত হয়ে পড়ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, হতাশা ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থেকে মাদকের প্রতি আসক্ত হওয়ার প্রবণতা শিশু-কিশোরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকে। অল্প বয়সে সর্ম্পকে জড়ানো এরপর বিচ্ছেদ, পারিবারিক অশান্তির পর ধারণা জন্ম নেয় এমন, হতাশা থেকে কাটিয়ে উঠতে মাদক হতে পারে শ্রেষ্ঠ কিছু।এরপর, মাদক সেবনের মাত্রা ধীরে ধীরে যখন বাড়তে থাকে তখন সেটা আসক্তি অবধি চলে যায়, এরপর আর এই আসক্তি থেকে বের হতে পারে না।

অল্পবয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে কৌতূহলবশত মাদক সেবন শুরু করে বলে গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়।স্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এই ভেবে প্রথমে অল্প অল্প মাদক সেবন শুরু করে। একপর্যায়ে যখন তা আসক্তি অবধি চলে আসে তখন তা আর কাটিয়ে উঠতে পারে না।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বন্ধুদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। আর মাত্র ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ যুব সমাজ কৌতুহলবসত মাদক সেবনে ঝুঁকছে।

সমাজের ১৫-৩০ বছর বয়সীদের মাদকাসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। অধিদফতরের ২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১৬-৪০ বছর বয়সীদের প্রায় ৮৪ দশমিক ২৭ শতাংশ মাদকাসক্ত। এই বয়স সীমার মধ্যে ২১-২৫ বছর বয়সী যুবকরা রয়েছেন ‘সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে’। ১৬-২০ ও ২৬-৩০ বছর বয়সীরা ‘মধ্য ঝুঁকি’; ৩১-৩৫ বছর বয়সীরা রয়েছেন ‘স্বল্প ঝুঁকিতে’।

একটি বেসরকারি হিসাব অনুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশের মাদকাসক্ত রয়েছে ৭৫ লাখেরও বেশি। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ যুবক-যুবতী। ৪৩ শতাংশ বেকার, ৬০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত, ৪৮ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ৫৭ শতাংশ যৌন অপরাধী। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮ শতাংশ ধূমপায়ী।

নারীরাও ঝুঁকছে মাদকের দিকে:

দেশে নারীদের মধ্যে মাদকের দিকে ঝোঁকার প্রবণতা বাড়ছে। কয়েকটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আর্থিক নিরাপত্তা ভোগ করা পেশাজীবী নারীদের অনেকেই ঝুঁকছেন মাদকের দিকে। আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে মাদকসেবী কিশোরীর সংখ্যা। গৃহবধূরাও হচ্ছেন মাদকাসক্ত।

আগে অভিজাত ক্লাব গুলোতে দু'চারজন নারীকে মদ খেতে দেখা গেলেও ‘বার’ গুলোতে খুব একটা দেখা যেত না। এখন অভিজাত ক্লাবের পাশাপাশি বার গুলোতে প্রচুর নারী টেবিলে বসে মদ্যপান করেন। যেসব বারে ডিস্কোর আয়োজন থাকে সেখানে প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারীর উপস্থিতি দেখা যায়।।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ থেকে ২০২৩-এর জুলাই পর্যন্ত মাদকাসক্ত হয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে (রিহ্যাব) গেছেন অন্তত ৫০ হাজার মাদকসেবী। ৫ বছরে রিহ্যাবে চিকিৎসা নেওয়া নারী মাদকাসক্ত বেড়েছে ৫ গুণ। আর ১৫ ও তার কম বয়সী মাদকাসক্ত বেড়ে হয়েছে তিনগুণ, সংখ্যায় যা ৪৭ হাজার ৩৭৬ জন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানান, ‘হেরোইন, প্যাথেডিন, মরফিন, ইয়াবা, আইস আরও যেগুলো আছে সেগুলোর কোনোটাই আমাদের দেশের না। আমরা তো মাদক বানাই না। মিয়ানমার, ভারত থেকে আসে। আর চাহিদা বেশি বলেই আটকানো কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি।’

সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে নারী মাদকসেবীর হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ঢাকা আহছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৬৪৭ জন নারীকে চিকিৎসা দিয়েছে। তাদের মধ্যে ১২৯ জন পুনরায় চিকিৎসা গ্রহণ করেন। এসব নারীর মধ্যে ৩৩ শতাংশ ইয়াবা, ২৮ শতাংশ গাঁজা, ১৬ শতাংশ ঘুমের ওষুধ, ১৫ শতাংশ অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের মাদক, ২ শতাংশ মদ, ২ শতাংশ শিরায় মাদক নিয়েছেন। যাদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া ৩৪ শতাংশ, মুড ডিজঅর্ডার ৩০ শতাংশ, বাইপোলার ১২ শতাংশ, ডিপ্রেশন ১০ শতাংশ, ওসিডি ৬ শতাংশ ও বাকিরা অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্ত।

ঢাকা আহছানিয়া মিশন (নারী) মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থী,গৃহিণী,চিকিৎসক, সাইকোথেরাপিস্ট, বেসরকারি চাকরিজীবী,শিক্ষক,মডেল যৌনকর্মী, বেকার,ব্যবসায়ী, ডিজে,এবং এয়ারহোস্টেস।

ঢাকা আহছানিয়া মিশন (নারী) মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর মমতাজ খাতুন জানান,আমাদের এখানে যারা আসছেন তাদের বড় অংশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের স্টুডেন্ট। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আছেন গৃহবধূ। আমরা চিকিৎসা পেশায় জড়িতদেরও পাচ্ছি। সেই সঙ্গে আছেন মডেল, অভিনেত্রী, এয়ার হোস্টেস।’

বন্ধুদের চাপ, একাকিত্ব, পরিবারের অন্য সদস্য বা বন্ধুবান্ধবের মাদক গ্রহণ, বিষন্নতা, হতাশা, বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রশ্রয় বা শাসন, অভিভাবকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, বিচ্ছেদ, সন্তানকে সময় না দেয়ার প্রবণতা- এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, পুরুষের তুলনায় খুব কমসংখ্যক মাদকাসক্ত নারী চিকিৎসা নিতে আসেন। তবে আগের চেয়ে বেশি নারী মাদকাসক্ত ঢাকা মেডিকেলে আসছে। সম্প্রতি পুরুষের পাশাপাশি নারীদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা অনেকটাই বেড়েছে। বন্ধু, প্রতিবেশী, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি থেকে মাদক গ্রহণ করে থাকে নারীরা। এক্ষেত্রে অনেক সময় প্রেমিক- প্রেমিকা, শিক্ষার্থী, স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশের মতো বিশ্বের বহু দেশে মাদকের অবৈধ ব্যবহার বাড়ছে। এতে জাতিসংঘও ((United Nations ) উদ্বিগ্ন। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং অবৈধ পাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্যই জাতিসংঘের আহবানে প্রতিবছর ২৬ জুন পালন করা হয় মাদকের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। এদিবসটি পালনের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মাদক দ্রব্য থেকে মানুষকে বাঁচানো।

জাতিসংঘের মাদকবিরোধী কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (এনওডিসি) এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে— ‘The evidence is clear: invest in prevention’, অর্থাৎ ‘প্রমাণ স্পষ্ট: প্রতিরোধে বিনিয়োগ করুন’। বাংলাদেশে মাদকের অবৈধ পাচার ও অবৈধব্যবহার এখন ওপেন সিক্রেট। জাতিসংঘের এবারের থিমের প্রতি সম্মান দেখিয়, প্রমাণ যেহেতু স্পষ্ট— মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য কার্যকর প্রদক্ষেপ নেয়া উচিত।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
শেখ পরিবারের ৫ সদস্যের সম্পত্তি ক্রোক, রিসিভার নিয়োগের আদেশ
ধাওয়া খেয়ে পিছু হটল ভারতের চার যুদ্ধবিমান
নিজের ওপর চলা নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বিচার চাইলেন রাশেদ খান
এসপি পদমর্যাদার ১৪ কর্মকর্তার বদলি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা