নারী কেলেঙ্কারির সেই জেলা প্রশাসকেরা এখন...

প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকে বিভিন্ন সময় অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) বিরুদ্ধে নারীঘটিত কেলেঙ্কারির অভিযোগ সামনে আসছে বারবার। এতে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নৈতিকতা ও জবাবদিহি প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
অতি সম্প্রতি শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিনের সঙ্গে দুই নারীর আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর তাকে ওএসডি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
অনেকে বলছেন, ছবি-ভিডিও ভাইরাল হওয়ার কারণে কোনো কোনো কর্মকর্তার নৈতিক স্খলনের কর্ম প্রকাশ পাচ্ছে। অপ্রকাশিত কত ঘটনা রয়ে যাচ্ছে আড়ালে।
যারা মাঠ প্রশাসনের দায়িত্বে থাকেন, তারা শুধু সরকারের প্রতিনিধি নন, বরং জনগণের কাছে একজন নৈতিক নেতা। কিন্তু তাদের এমন আচরণ জনগণের আস্থাকে চরমভাবে ধ্বংস করছে বলে হতাশা প্রকাশ করেন সাবেক কর্মকর্তারা।
জেলা প্রশাসক জেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এমন একটি পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অনৈতিকতায় জড়ানো শুধু একজন ব্যক্তির ব্যর্থতা নয়, এটি গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থার নৈতিক সংকটকেও প্রকাশ করে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বারবার এমন ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ পদের কর্মকর্তাদের মধ্যে নৈতিক স্খলন ও অনিয়ম-অসদাচরণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
পরিসংখ্যান ঘেঁটে অন্তত আটজন জেলা প্রশাসকের যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়ানোর তথ্য পাওয়া গেছে। আর একজন জেলা প্রশাসক সাংবাদিক নির্যাতন করে শাস্তি পান।
তাছাড়া একাধিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে নানা সময়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের ওএসডি করা হলেও কার্যকর বা চূড়ান্ত শাস্তির নজির বিরল।
একজন আশরাফ উদ্দিন
প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়ানোর সর্ব সাম্প্রতিক নজির শরীয়তপুরের ডিসি আশরাফ উদ্দিন। তিনি ২০২৪ সালের ৩ নভেম্বর এই জেলায় যোগ দেন।
তাকে নিয়ে বিতর্ক সামনে এসেরেছ যখন একাধিক নারীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আপত্তিকর এসব ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়- এক নারীকে কোলে নিয়ে চুম্বন করছেন আশরাফ উদ্দিন।
তার বিরুদ্ধে একজন নারী গণমাধ্যমে অভিযোগ করেন, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্পর্ক গড়ে ওই নারীর সংসার ভাঙেন ডিসি আশরাফ। পরে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাকে হুমকি দেওয়া হয়।
অভিযোগ ওঠার এক দিন পরেই ডিসি আশরাফকে ওএসডি করা হয়। এই নারী কেলেঙ্কারির তদন্ত কমিটি গঠনের কোনো খবর এখনো পাওয়া যায়নি।
প্রশাসনে আরও যত নারী কেলেঙ্কারি
শুধু বদলি করে বা ওএসডি করেই দায় শেষ করায় এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলে মত প্রশাসন বিশ্লেষকদের। তারা বলছেন, সরকারি প্রশাসনের ভিতরে নৈতিকতা, জবাবদিহিতা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না আনলে এসব কেলেঙ্কারি বন্ধ হবে না। বিগত সময়ে বেশ কয়েকটি যৌন কেলেঙ্কারির মতো গুরুতর অপরাধের ঘটনা ঘটেছে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে।
জামালপুরের আহমেদ কবীর
২০১৯ সালের আগস্টে ডিসি আহমেদ কবীর ও তার অফিস সহকারীর একটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওটি ছিল তার অফিসের সংযুক্ত কক্ষে ধারণকৃত। তদন্তে কেলেঙ্কারির প্রমাণ মেলে। তখন তাকে ওএসডি করা হয়। পরে আহমেদ কবীরের বেতন গ্রেড কমিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়, পদোন্নতিও বন্ধ থাকে তার।
দিনাজপুরের মাহমুদুল আলম
২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর এক নারী ভিডিও বার্তায় অভিযোগ করেন, ডিসি মাহমুদুল আলম প্রতারণা করে তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি বলেন, ‘প্রলোভন দেখিয়ে সম্পর্ক গড়ে সংসার ভাঙেন, পরে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’ এই ঘটনার পর মাহমুদুলকে প্রত্যাহার করা হয়। আর কোনো শাস্তির তথ্য পাওয়া যায় না।
নাটোরের গোলামুর রহমান
নাটোরের তৎকালীন ডিসি গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে এক নারী ম্যাজিস্ট্রেট যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়, ডিসি তাকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কুপ্রস্তাব দেন, রাতের বেলা সার্কিট হাউসে যেতে বলেন। পরে তাকে ওএসডি করা হয়। তবে বড় কোনো শাস্তি না দিয়ে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে।
নেত্রকোনার মঈনউল ইসলাম
তার কার্যালয়ের এক নারী কর্মীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগে এলাকাবাসী মানববন্ধন করে। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তদন্ত চলাকালেই তাকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা যায় না।
বাগেরহাটের এ এন এম ফয়জুল হক
অন্যের স্ত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় সরিয়ে দেওয়া হয় ফয়জুল হককে। তাকে সেসময় ওএসডি করা হয়েছিল। পরে যথাসময়ে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হন তিনি।
বরগুনার হাবিবুর রহমান
এক নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও ভাইরাল হয় তার। ভুক্তভোগী নারী জানান, ডিসি বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন। কিন্তু পরে বিয়ে করতে অস্বীকার ও প্রতারণা করেন। তিনি ডিসির বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকার লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। এই ঘটনায় হাবিবুর রহমানকে ওএসডি করা হয়। তবে কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তথ্য নেই।
নারায়ণগঞ্জের মনোজ কান্তি বড়াল
ডিসি মনোজ কান্তি বড়াল স্থানীয় এক নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়েন বলে অভিযোগ ওঠে। খিলগাঁওয়ের এক ফ্ল্যাটে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর অভিযোগে স্থানীয়রা তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে। এই ঘটনায় কোনো শাস্তি হয়নি মনোজ কান্তি বড়ালের। পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হন তিনি।
নারীঘটিত কারণ ছাড়াও সাংবাদিক নির্যাতন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন।
২০২০ সালের মার্চে গভীর রাতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেন ডিসি সুলতানা পারভীন। পরে তাকে মাদক মামলায় এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ঘটনার তদন্তে ডিসির বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ মিললে তাকে প্রত্যাহার করা হয় এবং দুই বছর বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়। তবে পরে সেই শাস্তি প্রত্যাহার করে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
প্রশাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্মকর্তারা বারবার কেলেঙ্কারিতে জড়ালেও প্রকৃত অর্থে কেউ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাননি। তাদের অনেকেই পরবর্তীতে পদোন্নতি পান, ভালো পদে দায়িত্ব পান। এতে করে অন্যরাও অনিয়ম করতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
যদি কেলেঙ্কারিতে জড়ানো কর্মকর্তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা না হয়, তবে অনিয়ম-অসদাচরণে লাগাম টানা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করে বিশ্লেষকরা বলেন, কেবল বদলি বা ওএসডি নয়, প্রয়োজন বিচারিক তদন্ত ও যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকৃত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
(ঢাকাটাইমস/২২জুন/এসএস/মোআ)

মন্তব্য করুন