স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট যেভাবে কাজ করে
তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের কারণে বিশ্ব আজ হাতের মুঠোয়। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে পুরো বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজে রূপান্তরিত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষি, গবেষণা সর্বক্ষেত্রে বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষণীয়। তথ্য-প্রযুক্তিকে বর্তমানে আলাদিনের জাদুর প্রদীপের সাথে তুলনা করলে খুব একটা ভুল হবে না।
তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের সুফল আজ সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছবি, তথ্য আদান-প্রদান এক সময় নিতান্তই কল্পনা হলেও আজ তা বাস্তব রূপ পেয়েছে শুধুমাত্র তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে। বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসেই বিভিন্ন দেশের কোম্পানির সাথে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। ইন্টারনেট আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তথ্য ও গবেষণা, শিক্ষা, আর্থিক লেনদেন, প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন নানা কাজে আমরা ইন্টারনেটের ওপর নির্ভর করে থাকি।
ইন্টারনেট ইন্টারকানেক্টড নেটওয়ার্কের সংক্ষিপ্ত রূপ। অনেকে একে নেটও বলে থাকেন। নেটওয়ার্ক তরঙ্গের মাধ্যমে অসংখ্য কম্পিউটার ডিভাইসকে একে অপরের সাথে যুক্ত করে তথ্য আদান-প্রদান করার পদ্ধতিকে ইন্টারনেট বলা হয়।
বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলেই মানুষ ক্যাবল ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার করে থাকে। ক্যাবল ইন্টারনেট সাধারণত সাবমেরিন ক্যাবল বা অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
তবে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কোনো তার ছাড়াই সরাসরি স্যাটেলাইট থেকে সেবা দেয়া হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল বা গ্রামে যেখানে ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন করা কঠিন, সেখানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যেতে পারে।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট হল এক ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ যা ব্যবহারকারীদের ইন্টারনেট অ্যাক্সেস প্রদান করতে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে। এটি একটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে কক্ষপথের একটি উপগ্রহে ডেটা পাঠানোর মাধ্যমে কাজ করে, যা ব্যবহারকারীর অবস্থানে ইনস্টল করা একটি স্যাটেলাইট ডিশে ডেটা প্রেরণ করে। এই প্রযুক্তি গ্রামীণ বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষভাবে উপযোগী যেখানে ঐতিহ্যবাহী কেবল বা ডিএসএল ইন্টারনেট পরিষেবা উপলব্ধ নাও হতে পারে।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের শুরু হয়েছে অনেক আগেই। ১৯৮০-এর মাঝামাঝি প্রায় ১০০টি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু। তারপর অনেকে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট দেয়া শুরু করে। এরপর যতই সময় গেছে, অন্যান্য প্রযুক্তির মতো এই প্রযুক্তিও উন্নত হয়েছে।
মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী ইলন মাস্কের মহাকাশযান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। স্পেসএক্সের ইন্টারনেট সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান স্টারলিঙ্ক। স্টারলিংক মূলত জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের (ভূ–স্থির উপগ্রহ) মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার একটি প্রকল্প। এখন পর্যন্ত ৬০টি দেশে স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। ইলন মাস্কের বাণিজ্যিক রকেট পরিষেবা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স ২০১৯ সাল থেকে স্টারলিংক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ শুরু করেছে। এরই মধ্যে তারা ৪ হাজার ৫১৯টি স্টারলিংক স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপন করেছে। প্রাথমিক পরিকল্পনায় প্রায় ১২ হাজার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের কথা থাকলেও পরবর্তীতে ৪২ হাজারটি কক্ষপথে স্থাপনের কথা বলেছে স্পেসএক্স। এই স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীতে অবস্থিত অ্যানটেনার মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করবে।
স্টারলিঙ্কের অনেকটা স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মতো কাজ করে। পৃথিবীর লো অরবিটে স্থাপিত অনেকগুলো ভূ–স্থির স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার ওপরে পৃথিবীর কক্ষপথে এসব স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়। স্যাটেলাইটগুলো মূলত টেলিভিশন, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট ফোন ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়। অনেকগুলো ছোট ছোট স্যাটেলাইট পৃথিবীর কক্ষপথে নির্দিষ্ট স্থানে থেকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের সমান গতিতে প্রদক্ষিণ করতে থাকে।
পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে অন্য কোনো কম্পিউটারের সঙ্গে ইন্টারনেট যোগাযোগ করতে হলে, প্রথমে স্টারলিঙ্ক গ্রাহকের কম্পিউটার থেকে রিকোয়েস্ট কাছাকাছি স্যাটেলাইটে যায়। এরপর সেই রিকোয়েস্ট সেলুলার নেটওয়ার্কের মতো একটা থেকে আরেকটা স্যাটেলাইট হয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে (সার্ভার) পৌঁছায়। এরপর কাঙ্ক্ষিত তথ্য নিয়ে একই পদ্ধতিতে গ্রাহকের কম্পিউটারে (মোবাইল বা আইওটি) ফিরে আসবে। এভাবে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া যায়। এমনকি দুর্গম পাহাড় বা জঙ্গলেও ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া যাবে। ফলে পুরো পৃথিবী উচ্চগতির ইন্টারনেটের আওতায় আসবে।
স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট কানেকশন নিতে হলে টিভির ডিশ অ্যানটেনার মতো একটি অ্যানটেনা লাগাতে হয়। এই অ্যানটেনা স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। ওই অ্যানটেনা থেকে একটি ক্যাবল গ্রাহকের ঘরে রাখা স্টারলিঙ্কের ওয়াইফাই রাউটারে লাগিয়ে ইন্টারনেট উপভোগ করা যায়।
স্টারলিঙ্ক ছোট উপগ্রহের একটি অ্যারের (সারি) মাধ্যমে সীমাহীন উচ্চ-গতির ডেটা সরবরাহ করে। গতি প্রতি সেকেন্ডে ১৫০ মেগাবিট (১৫০ এমবিপিএস)। স্পেসএক্স এই হার দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করেছে।
উকলা স্পিডটেস্ট অনুসারে, স্টারলিঙ্ক লিথুয়ানিয়ায় ২০২২ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ১৬০ এমবিপিএস ডাউনলোড গতি রেকর্ড করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৯১ এমবিপিএস, কানাডায় ৯৭ এমবিপিএস এবং অস্ট্রেলিয়ায় ১২৪ এমবিপিএস পাওয়া গেছে। মেক্সিকোতে স্টারলিঙ্কের গতি রেকর্ড করা হয়েছে গড়ে ১০৫ দশমিক ৯১ এমবিপিএস।
স্টারলিংক ইন্টারনেটে খরচ
আবাসিক সেবা: এই প্যাকেজটি আবাসিক ব্যবহারের জন্য। হার্ডওয়্যারের (ডিশ এবং রাউটার) জন্য এককালীন চার্জ ৫৯৯ ডলার। প্রতি মাসে সাবস্ক্রিপশন ফি ১১০ ডলার।
বাণিজ্যিক গ্রাহক: ব্যবসায়িক প্যাকেজটিতে আবাসিক প্যাকেজের দ্বিগুণ গতি পাওয়া যাবে। এর জন্য এককালীন চার্জ ২ হাজার ৫০০ ডলার। প্রতি মাসে ফি ৫০০ ডলার।
স্টারলিংক আরভি: ২০২২ সালের জুনে ইউএস ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন স্পেসএক্সকে বিনোদনমূলক যানবাহন, এয়ারলাইনস, জাহাজ এবং ট্রাকসহ চলন্ত যানবাহনগুলোর সঙ্গে স্টারলিঙ্ক ব্যবহার করার জন্য অনুমোদন দেয়। ভ্রমণের সময়ও এ সেবা নিতে পারবে মানুষ। এর জন্য প্রতি মাসে ১৩৫ ডলার খরচ হবে। আর হার্ডওয়্যারের জন্য দিতে হবে একককালীন ৫৯৯ ডলার। স্টারলিঙ্ক আরভি বর্তমানে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এনজিএসও স্যাটেলাইট ইন্টারনেট দেশে চালু হলে বড় পরিবর্তন দেখা যাবে। প্রত্যন্ত, অনুন্নত এলাকায় সংযোগ দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা উপকার পাবে, ব্যবসা বাড়বে ও মানুষের যোগাযোগ আরও গতিশীল হবে।
ইন্টারনেটের গতি নিয়ে আমাদের অনেকেরই তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিশেষ করে যারা গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকেন। আমাদের দেশে শহরাঞ্চলেও ইন্টারনেটের গতি বেশ ধীর। এই সমস্যা সমাধানের ভাবনা থেকে স্টারলিঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন মার্কিন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা ও মহাকাশযান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের মালিক ইলন মাস্ক।
স্পেসএক্সের অধীনে পরিচালিত স্টারলিঙ্কের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, পৃথিবীর সকল জায়গায় উচ্চ গতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা। বর্তমানে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করা হলেও ইল মাস্কের মতে, স্যাটেলাইট ইন্টারনেটই ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ।
উল্লেখ্য, স্টারলিঙ্ক জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের (ভূ-স্থির উপগ্রহ) মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার একটি প্রকল্প। স্টারলিঙ্কের মূল লক্ষ্য পৃথিবীর সকল জায়গায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা। পৃথিবীর বাইরে ছোট ছোট অনেক স্যাটেলাইট পাঠিয়ে সেগুলোর মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করা হয়।
২০০৪ সালের জুনে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নিয়ে কাজ শুরু করে ইলন মাস্কের স্পেসএক্স । ২০০৮ এসে ইএডিএস অ্যাস্ট্রিয়াম নামক অন্য একটি কোম্পানির কাছে সেট প্রজেক্ট বিক্রি করে দেয়। তারপর ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ফের আত্মপ্রকাশ করে স্টারলিঙ্ক।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা শিগগির চালু হতে যাচ্ছে। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট চালুর ফলে ব্যাকহোলিং, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও গ্রাহকের ডেটা ব্যবহারের পাশাপাশি ডিজিটাল বিভাজন দূর করে সেতু বন্ধনে নতুন দ্বার উন্মোচনে সহায়ক হবে।
(ঢাকাটাইমস/১৯ নভেম্বর/আরজেড)
মন্তব্য করুন