মুমূর্ষু বুড়িগঙ্গার বুকে জীবনের যুদ্ধ; আজিজ মাঝিদের গল্প

খাদিজা আক্তার, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০১৭, ১০:৪০ | প্রকাশিত : ২৩ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:২৫

অপরিকল্পিত নগরায়ন আর শিল্পায়নের বেপরোয়া যাত্রায় একসময়ের উত্তাল বুড়িগঙ্গা আজ মুমূর্ষু অবস্থায় উপনীত হলেও, নিজের সবটুকু দিয়ে যুগ যুগ ধরে হাজারো দরিদ্র মানুষের জীবিকার আধার হয়ে নিজেকে মহিমান্বিত করে চলেছে ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যার সন্তান এই নদী।

প্রতিদিন কত লঞ্চ আর স্টিমারের ভার বইতে হয় তাকে, কত শিল্প-কারখানা তাদের বিষাক্ত বর্জ্য ঢেলে মেরে ফেলতে চাইছে এই বিশাল জলাধারকে! তবু সর্বহারার বন্ধু হতে যুগে যুগে এতটুকু কার্পণ্য করেনি দুঃখিনী বুড়িগঙ্গা।

বিশালদেহী নানা জলযানের প্রতিদিনের হুঙ্কার, এদের ধাক্কায় সৃষ্ট দানবীয় ঢেউ, শিল্পপতিদের লোভের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট অসহ্য দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানি সামলে হাজারো গরীব মানুষের নিত্যদিনের জীবিকা প্রদান করে চলেছে বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গাকে আঁকড়ে ধরে নিম্নআয়ের হাজারো মানুষ বেঁচে থাকছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তাদেরই একদল ছোট নৌকায় যাত্রী পারাপার করে অর্জন করে চলেছে নিজের এবং পরিবারের মহামূল্যবান জীবিকা।

সরেজমিনে দেখা যায় শুধু সদরঘাট থেকে কামরাঙ্গীরচর পর্যন্ত রয়েছে ১০টি নৌকার ঘাট। একেকটি ঘাটে ৫০/১০০টি নৌকা থাকে। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা ভেড়ানো থাকে ঘাটে। একেকটি নৌকায় ৮/১০ জন যাত্রী চলাচল করতে পারে। মজার বিষয় হল, নৌকাগুলোতে এখনো যান্ত্রিকতার ছোঁয়া লাগেনি। হাতের বৈঠা দিয়েই দক্ষ মাঝিরা প্রতিদিন অসংখ্যবার যাত্রী পারাপারের কাজ করে।

মাঝিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সারাদিন যাত্রী পারাপারের কাজ করে গড়ে ৮০০/১০০০ টাকা আয় করেন একেকজন মাঝি। এর মধ্যে ঘাটের নানা খরচ বাবদ কমপক্ষে ২০০ টাকা খরচ হয়। বাকি টাকা দিয়ে নিত্যদিনের সাংসারিক খরচ মেটাতে হয়।

বুড়িগঙ্গার পানিতে জীবনযুদ্ধে নিয়োজিত এমনি একজন মাঝি আজিজুর রহমান (৫৫)। গত ২২ বছর ধরে বুড়িগঙ্গা নদীর সোয়ারীঘাট থেকে জিঞ্জিরা পর্যন্ত যাত্রী পারাপারের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন তিনি।

আজিজুর রহমান জানান, ২২ বছর আগে ভোলা থেকে কাজের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। চাচাতো ভাইয়ের সুবাদে সোয়ারীঘাট এলাকায় নৌকা পারাপারের কাজ জুটে যায়। আর কোনো কাজ করা হয়ে উঠেনি তার। সেই থেকে তার পরিচয় আজিজ মাঝি।

আজিজ মাঝি ঢাকাটাইমসকে বলেছেন, প্রতিদিন বুড়িগঙ্গার বুকে নৌকা চালিয়ে যে টাকা আয় করেন তা দিয়ে তার বৃদ্ধা মাসহ সাত সদস্যের সংসার কেটে যাচ্ছে ভালোভাবেই। জীবনের বাকি দিনগুলিও এ পেশায় কাটিয়ে দিতে চান তিনি।

আরেক জীবনযোদ্ধা ইলিয়াস মাঝি। তিনিও প্রায় ১৮ বছর ধরে বুড়িগঙ্গায় যাত্রী পারাপারের সাথে যুক্ত আছেন। তিনি জানান, যতো দিন বুড়িগঙ্গা বেঁচে থাকবে, ততোদিন বেঁচে থাকবে নৌকার মাঝিদের জীবন জীবিকার স্বপ্ন।

ইলিয়াস কিংবা আজিজ মাঝির ছোট ডিঙ্গি দিয়ে প্রতিদিন নদী পাড়ি দিয়ে অফিসসহ নানা কাজে আসেন নানা শ্রেণী-পেশার হাজারো মানুষ। বড় বড় ব্রিজ দিয়ে দুই পাড়কে সংযোগ করা হলেও এখনো ছোট ডিঙ্গি নৌকার প্রয়োজনীয়তা ফুরায়নি এতটুকু। বরং বাড়তি যাত্রীর চাপে মাঝে মাঝে হিমশিম খেতে হয় ডিঙ্গি নৌকার মাঝিদের।

নিজের জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও ইলিয়াস কিংবা আজিজ মাঝির কষ্ট বুড়িগঙ্গাকে নিয়ে। মানুষের লোভ আর পরিকল্পনাহীনতা একটি নদীর পানিকে কী পরিমাণ দূষিত করতে পারে সেটা বুড়িগঙ্গাকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না বলে মন্তব্য করলেন আজিজ মাঝি।

আর কত সহ্য করবে বুড়িগঙ্গা? প্রশ্ন ইলিয়াসের। শেষ পর্যন্ত বাঁচবেতো বুড়িগঙ্গা? বুড়িগঙ্গা না বাঁচলে তাদের মত খেটে খাওয়া মানুষের কী হবে! কপালে ভাঁজ নিয়ে উল্টো ঢাকাটাইমস প্রতিবেদককেই প্রশ্ন তাদের। তারা জানালেন, আগে অনেকগুলো পরিবার মাছ ধরেও জীবিকা নির্বাহ করত। সে পরিবারগুলো এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। বুড়িগঙ্গার ঢাকা অংশের কালো পানিতে মাছ থাকার প্রশ্নই উঠেনা বলে মন্তব্য করলেন অভিজ্ঞ আজিজ।

ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, একসময় ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যার পানি এক স্রোতে মিশে বুড়িগঙ্গা নদীর সৃষ্টি হয়েছিল। তবে বর্তমানে এটা ধলেশ্বরীর শাখাবিশেষ। কথিত আছে, গঙ্গা নদীর একটি ধারা প্রাচীনকালে ধলেশ্বরী হয়ে সোজা দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিশেছিল। পরে গঙ্গার সেই ধারাটির গতিপথ পরিবর্তন হলে গঙ্গার সাথে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে প্রাচীন গঙ্গা এই পথে প্রবাহিত হতো বলেই এমন নামকরণ। মূলত ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি। কলাতিয়া এর উৎপত্তিস্থল। বর্তমানে উৎসমুখটি ভরাট হওয়ায় পুরানো কোন চিহ্ন খোঁজে পাওয়া যায় না।

বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজ করেছিলেন বাংলার সুবাদার মুকাররম খাঁ। তার শাষণামলে শহরের যেসকল অংশ নদীর তীরে অবস্থিত ছিল, সেখানে প্রতি রাতে আলোকসজ্জা করা হতো। এছাড়া নদীর বুকে অংসখ্য নৌকাতে জ্বলতো ফানুস বাতি। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে অপরুপ সৌন্দের্য্যের সৃষ্টি হতো।

উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, ১৮০০ সালে বিদেশী লেখক টেইলর বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন-‘বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে তখন দুর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো’।

যে বুড়িগঙ্গাকে দেখে টেইলর নামের বিদেশী লেখকের ইতালির ভেনিসের কথা মনে হয়েছিল, সেই বুড়িগঙ্গার বর্তমানের অবস্থা দেখে আতঙ্কিত আজিজ এবং ইলিয়াসের মত মাঝিরা। অন্যান্য আরও অনেক মাঝির সাথে কথা বলে তাদের মনের কষ্ট আর আতঙ্ক টের পাওয়া যায়।

বুড়িগঙ্গা না বাঁচলে, তারাও বাঁচবেন না। তাই সরকারের কাছে তাদের আকুতি, বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য বিশেষ প্রকল্প হাতে নেয়া হোক। এছাড়া ডিঙ্গি নৌকাগুলোর জন্য নেই কোনো ঘাটও। সরকার ইচ্ছে করলে তাদের জন্য স্থায়ী ঘাটও নির্মাণ করে দিতে পারে বলে পরামর্শ দিলেন মাঝিরা।

এ বিষয়ে আজিজ মাঝি বলেন, ‘ আমরাতো শুধু জীবিকা অর্জন করিনা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে সেবাও দিই। যাত্রী এবং আমাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেও সরকার বুড়িগঙ্গার দুপাড়ে ছোট ছোট ঘাট বানিয়ে দিতে পারে’।

মাঝিরা জানাল, দুপাশের দখল হয়ে যাওয়া তীর উদ্ধার করলেই অনেক জায়গা বেরিয়ে আসবে। এসব উদ্ধারকৃত জায়গায় সহজেই সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি ডিঙ্গি নৌকার জন্য ঘাট বানানো যেতে পারে।

ঢাকাটাইমস/২৩ জানুয়ারি/ এসএএফ

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজধানী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজধানী এর সর্বশেষ

মুগদায় আইডিয়াল শিক্ষার্থীকে পিষে মারল ময়লার গাড়ি, চালক আটক

পুরান ঢাকায় বাবার সঙ্গে অভিমান করে স্কুল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যু: বিচার চায় সচেতন নাগরিক সমাজ

তীব্র তাপপ্রবাহে জনসাধারণের মাঝে পানি, খাবার স্যালাইন বিতরণ বিএনপির

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও নেতাকর্মীরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে: সালাম

ঢাকা মেডিকেলে এক কারাবন্দিকে মৃত ঘোষণা

ভাষানটেকে অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫, বাকি একজনও আশঙ্কাজনক

মুগদা-মান্ডা সড়কে অভিযান: ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভাঙচুর ও মারধরের অভিযোগ  

মোহাম্মদপুরে তিতাসের এমডির বাসার সামনে ককটেল বিস্ফোরণ

রাজধানীতে থাকবে না ফিটনেসবিহীন বাস, জুন থেকে মাঠে নামছে বিআরটিএ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :