অবৈধ মধুমতি টাউনে থেমে নেই উন্নয়নকাজ

আপিল বিভাগে অবৈধ ঘোষণা করে আলোচিত ‘মডেল টাউন’কে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে। আর এই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করে প্রকল্প এলাকার উন্নয়নের কাজ চলছে আগের মতোই।
রাজধানীর গাবতলী পেরিয়ে সাভারের দিকে এগিয়ে গেলে আমিনবাজারে হাতের বাম দিকে দেখা মেলে মধুমতি মডেল টাউনের। উচ্চ আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করা এই প্রকল্প এলাকায়ও চলছে স্থাপনা নির্মাণ। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন বাড়ি, চওড়া সড়ক। বিদ্যুতের জন্য স্থাপন করা হয়েছে খুঁটি। অবৈধ প্রকল্পের নিরাপত্তার জন্য বসানো হয়েছে আনসার ক্যাম্পও।
সরেজমিন চিত্র
৪ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ১০টা। মধুমতি মডেল টাউনের সামনে গাড়ি থেকে নামতেই চোখ আটকে গেল আনসার ক্যাম্পের একটি সাইনবোর্ডে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে অবৈধ ঘোষণা হওয়ার পরও সরকারি এ সংস্থার পক্ষ থেকে প্রকল্পটিতে নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। ভেতরে প্রবেশ করতে আছে কড়া পাহারা। সাধারণের প্রবেশে কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা আছে।
মডেল টাউনের চারপাশে গাছ লাগানো হয়েছে। উঁচু গাছের কারণে ভেতরের কোনো স্থাপনা বাইরে থেকে দেখা যায় না। ভেতরেও পুরো এলাকাজুড়ে গাছ লাগানো হয়েছে।
কৌশলে নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল শ্রমিকরা কাজ করছেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন মনির হোসেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। সামনে আরও কাজ হবে।’
একটু এগুতেই দেখা গেল দৃষ্টিনন্দন একটি বাড়ি। বাড়িটির চারপাশে সুন্দর দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। দোতলা বাড়িটি দেখতে বেশ মনোরম। তবে বাড়িটি কার শ্রমিকরা বলতে পারলেন না। বাড়িটির উলটো পাশে আরও এক নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। চারপাশে দেয়াল তুলে ভেতরে ভবনের কাজ চলছে। রাস্তার দুই পাশেই বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ লাইন বসানো হয়েছে। বিদ্যুৎও দেয়া হয়েছে বাড়িগুলোতে।
একটু এগুতেই দেখা গেল দৃষ্টিনন্দন একটি সেতু। এটি সদ্য রঙ করা হয়েছে। অনেকেই এতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। সেতুটি পার হয়ে দেখা গেল, বিশাল এলাকাজুড়ে ভরাটের কাজ চলছে।
প্রকল্পটির সব জায়গায় নিরাপত্তারক্ষীদের করা নিরাপত্তা রয়েছে। ওই এলাকার কয়েকটি ছবি তুলতে গিয়ে এক নিরাপত্তা কর্মীর চোখ এড়ানো গেল না। ছবি তোলা দেখেই তেড়ে আসলেন। বললেন, ‘কে আপনি? ছবি তুলছেন কেন? পারমিশন এনেছেন?’।
সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু চুপসে গেলেন। একটু বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘ভাই, ছবি তুইলেন না। কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে। আগে অনুমতি নিয়ে আসেন তারপর ছবি তোলেন।’
কথা বলতে বলতে একটি মাইক্রোবাস এসে হাজির। চালক এসেই বললেন, ‘ভাই, গাড়িতে ওঠেন।’ দেখতে দেখতে আরও কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী হাজির। তারাও বললেন, ‘গাড়িতে ওঠেন। অফিসে চলেন।’
এই পর্যায়ে মধুমতি মডেল টাউনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মেট্রো মেকার্সের উপমহাব্যবস্থাপক মাহবুব হোসেনকে ফোন দিলে তিনি নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেন। আর নিরাপত্তারক্ষীরা প্রকল্প পরিচালক ফায়জুল হকের কাছে নিয়ে গেলে তিনি প্রকল্পটি ঘুরে দেখান।
ফায়জুল হক জানান, মধুমতি মডেল টাউনের পশ্চিম পাশ দিয়ে ১৭০ ফুট চওড়া রাস্তা হচ্ছে। পদ্মা সেতু থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত রাস্তা যাবে। এই প্রকল্পের পাশেই বিভিন্ন জন ব্যক্তিগতভাবে মাটি ভরাট করে বাড়ি তৈরি করছে। কিন্তু মধুমতিকে আটকে দেয়া হয়েছে। অথচ রায়ের অনেক আগেই জমি কেনা ও প্লট আকারে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্লট বিক্রির টাকা দিয়ে মধুমতি মডেল টাউনের জমি ভরাট করা হয়েছে। এখন প্লট ক্রেতারা তাদের জমিতে বাড়ি তৈরি করতে ভয় পাচ্ছে।’
কারা মাটি ভরাট করছে- জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘প্লট ক্রেতারাই ব্যক্তিগতভাবে তাদের জমি ভরাট করছে। তারাই রিস্ক নিয়ে বাড়ি তৈরি করছে। শুধু প্লট মালিকদের সঙ্গে মেট্রো মেকার্সের যে চুক্তি ছিল সেই অনুযায়ী জমি হস্তান্তর করেছে।’
মধুমতি প্রকল্প এবং অবৈধ ঘোষণা করে আদালতের রায়
ঢাকা আরিচা রোডের দক্ষিণ পাশে বিলামালিয়া ও বলিয়ারপুর মৌজায় মেট্রো মেকারস অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেডের মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্প চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নব্বই দশকের শেষ দিকে প্লট আকারে জমি বিক্রি শুরু করে। ২০০৩ সালে শুরু হয় মাটি ভরাটের কাজ। এর আগেই বিক্রি হয়ে যায় প্রকল্পের জমি। প্রায় চার হাজার প্লট বিক্রি করা হয়েছে।
রাজউকের অনুমোদন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই মেট্রো মেকার্স ডেভেলপারস লিমিটেড বন্যা প্রবাহিত এলাকায় মধুমতি মডেল টাউন হাউজিং প্রকল্প গ্রহণের অভিযোগ তুলে হাইকোর্টে ২০০৪ সালে রিট করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি। ২০০৫ সালের ২৭ জুলাই হাইকোর্ট মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্প অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। একই সঙ্গে প্লট গ্রহীতাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে মেট্রো মেকার্স আপিলে গেলে ২০১২ সালের ৭ আগস্ট ওই প্রকল্প অবৈধ ঘোষণা করে চূড়ান্ত রায় দেয় আপিল বিভাগ। রায়ে ছয় মাসের মধ্যে বন্যা প্রবাহ এলাকা রক্ষায় প্রকল্পের জায়গা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ভরাট করা মাটি অপসারণ এবং ছয় মাসের মধ্যে জলাভূমিগুলোকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে মেট্রো মেকারস অ্যান্ড ডেভেলপারসকে নির্দেশ দেয়া হয়। মেট্রো মেকার্স তা না করলে রাজউককে এই দায়িত্ব নিতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। তবে সেক্ষেত্রেও খরচ মেটাতে হবে মেট্রো মেকার্সকেই।
অবৈধ ঘোষণার রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করে কি মধুমতিতে কাজ করা যাবে?
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মধুমতি মডেল টাউন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগেও বহাল রয়েছে। প্রকল্পটির জায়গা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে রিভিউ কোনো বাধা নয়। রিভিউ দায়ের করে ভূমি উন্নয়ন ও স্থাপনা তৈরি করে কোনো লাভ হবে না।’
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মধুমতি মডেল টাউন নিয়ে রিভিউয়ের শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। রিভিউ নিষ্পত্তির পর আদালত যেভাবে বলবে রাজউক সেভাবেই কাজ করবে।’
তবে মধুমতি মডেল টাউনে গিয়েই পাওয়া গেল প্লট মালিক কল্যাণ সমিতির সম্পাদক জি এন মনিরকে। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে চারটি রিভিউ আবেদন করা হয়েছে। মালিকপক্ষের পাশাপাশি প্লট ক্রেতাদের পক্ষ থেকেও রিভিউ আবেদন করা হয়েছে। আমরা বলেছি, বিচারক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি করে প্রকল্প এলাকায় তদন্ত করে রিপোর্ট দেয়ার জন্য যে কী ধরনের পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে। আসলে মধুমতি মডেল টাউনের কারণে ঢাকায় বন্যা হবে কি না? আশা করি আমাদের রিভিউ বিবেচনা করে আদালত আমাদের পক্ষে রায় দেবেন।’
জি এম মনির বলেন, ‘ভিটে মাটি বিক্রি করে ১৫ বছর আগে তিনি মধুমতি মডেল টাউনে জমি কেনেন। মরার আগে বাড়ি করতে পারবো কিনা তাও জানি না। এখন আত্মহত্যা করতে মন চায়।’
প্লট ক্রেতারা নিজেরাই তাদের প্লটের জমি ভরাট করছে দাবি করে মনির বলেন, ‘প্লট মালিকদের সঙ্গে মেট্রো মেকার্সের চুক্তি ছিল জমি ভরাট করে দেবে। কিন্তু আদালতের রায়ের পর মেট্রো মেকার্স জমি রেজিস্ট্রি করে দিলেও আর মাটি ভরাট করে দেয়নি। এখন প্লট মালিকরা নিজেরাই সেই সব জায়গা ভরাট করে নিচ্ছে।’
মনির বলেন, ‘এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে রিটে বলা হয়েছে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ঢাকায় বন্যা তৈরি হবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত মধুমতি মডেল টাউনের কারণে ঢাকায় বন্যা তৈরি হয়নি। ঢাকার পরে বুড়িগঙ্গা নদী রয়েছে। এছাড়া এই প্রকল্পের আগে আরও দুটি নদী রয়েছে। বড়িগঙ্গা নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি না করে বরং অভিযোগ তুলা হয়েছে মধুমতি মডেল টাউনের প্রতি।’
মেট্রো মেকার্সের এজিএম মাহবুব হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মধুমতি মডেল টাউনের জমি কেনা হয়েছে মামলা হওয়ার অনেক আগেই। প্লট বিক্রি হয়েছে মামলার আগে। যখন জমি কেনা ও প্লট বিক্রি হয় তখন এর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠেনি। কিন্তু যখন মাটি ভরাটের কাজ প্রায় সম্পন্ন তখন মামলা করে প্রকল্পটি আটকে দেয়া হল।’
প্লট ক্রেতাদের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুব হোসেন বলেন, ‘প্লট ক্রেতারা তাদের জমিতে যেতে চায়। তারা টাকা ফেরত চায় না। টাকা ফেরত নিতে চাইলে তাকে ফেরত দেয়া হবে।’
এ বিষয়ে জি এন মনির বলেন, ‘যখন আমরা প্লট ক্রয় করি তখন জমির দাম অনেক কম ছিল। এছাড়া ক্রয়মূল্যের চেয়ে অনেক কম দাম দেখিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। যা দিয়ে জমি কিনেছিলাম সেই টাকাটাও পাবো না। তাই কেউ টাকা ফেরত নিতে চাই না।’
আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, ছয় মাসের মধ্যে নিবন্ধন খরচসহ ক্রেতাদের প্রদেয় টাকার দ্বিগুণ পরিশোধ করতে মেট্রো মেকার্সকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।
(ঢাকাটাইমস/১১ফেব্রুয়ারি/এমএবি/ডব্লিউবি/জেবি)

মন্তব্য করুন