দিনাজপুরে ‘পীর’ হত্যায় গ্রেপ্তার ১

নিজস্ব প্রতিবেদক, দিনাজপুর
| আপডেট : ১৫ মার্চ ২০১৭, ১৮:৩১ | প্রকাশিত : ১৫ মার্চ ২০১৭, ১২:৫৩

দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে কথিত ‘পীর’ ও তার গৃহকর্মীকে হত্যার ঘটনায় ইসাহাক আলী নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

বুধবার ভোরে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়াও সায়েদুল ও সুমি নামে দুই মুরিদকেও আটক করে ‘নজরদারিতে রেখে’ জিজ্ঞাসাবাদ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ হত্যার কারণ বা কোনো সূত্র উদ্ধার করা যায়নি বলে জানিয়েছেন দিনাজপুর পুলিশ সুপার মো. হামিদুল আলম।

এ ব্যাপারে মঙ্গলবার রাতে বোচাগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেছেন নিহত পীরের মেয়ে ফাতেমা ফারহানা এ্যামি।

এ ঘটনার তদন্ত তত্ত্বাবধানে দিনাজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহাফুজ জামান আশরাফকে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিটি করা হয়েছে।

সোমবার রাতে বোচাগঞ্জ উপজেলার দৌলাগ্রামে কথিত পীর ফরহাদ হোসেন চৌধুরী এবং তার গৃহকর্মী রূপালি বেগমকে ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

নিহত ‘পীর’ ফরহাদ হোসেন চৌধুরী একসময় দিনাজপুর পৌর বিএনপির সভাপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন দিনাজপুর মোটর পরিবহন মালিক গ্রুপের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ৮ বছর আগে তিনি হঠাৎ দাঁড়ি রেখে জুব্বা-আলখেল্লা পড়ে পীর সেজে যার। গড়ে তুলেন বোচাগঞ্জ উপজেলার দৌলাগ্রামে ‘কাদরিয়া মোহাম্মদিয়া দরবার শরীফ’ নামে একটি দরবার। সেখানে তার মুরিদরা তাকে বাবা বলে ডাকতে শুরু করেন। কথিত ওই দরবারে প্রতি রাতে ভক্তদের মাহফিল ও জিকির হতো। সিরাজগঞ্জ থেকে আসা শফিকুল ইসলাম নামে এক ‘মুরিদের’ সঙ্গে হত্যার তিন দিন আগে পীরের বাড়ির গৃহকর্মী রূপালি বেগমের বিয়ে হয়।

দরবারের খাদেম সায়েদুল জানান, তিনি এবং সুমি নামে ৫২ বছর বয়সী এক মুরিদ প্রতিদিনের মত জিকিরে অংশ নিতে এসে দীর্ঘক্ষণ ‘হুজুরকে’ ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ডাকতে গিয়ে রক্তমাখা লাশ পান। পরে পাশের রান্নাঘরে পাওয়া যায় রূপালির লাশ।

তাদের দুজনের শরীরে গুলির চিহ্নের পাশাপাশি ধারালো অস্ত্রের আঘাতের ক্ষত ছিল বলে রাতে জানিয়েছিল পুলিশ।

সোমবার রাতে লাশ উদ্ধারের পর দরবারে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে পুলিশ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা মঙ্গলবার ঘটনাস্থল ঘুরে আলামত সংগ্রহ করেছেন। সোমবার রাতেই দুজনের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

কথিত পীর ও তারা নারী মুরিদের হত্যার পর ইতোমধ্যে জোর তদন্ত শুরু হয়েছে। আলামত সংগ্রহ করছে সিআইডির একটি দল। তবে এখন অবধি মেলেনি কোন ‘ক্লু’।

জানা গেছে, বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে অনুসন্ধান চালাচ্ছে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তের বরাত দিয়ে এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে পুলিশের একটি তদন্ত সূত্র জানায়, ‘ধরন দেখে মনে হচ্ছে- ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। তদন্তের পর বিস্তারিত বলা যাবে।’

তবে নিহত কথিত পীরের রাজনৈতিক জীবন, ব্যাক্তিগত জীবনে ব্যবসায়িক কোন ঝামেলা অথবা বিরোধ ছিল কী না? সে বিষয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানায় ওই তদন্ত সূত্রটি।

প্রতিবেশী শামসুল মিয়া জানান, ফরহাদ হোসেন চৌধুরী পরিবার নিয়ে দিনাজপুর শহরের বালুয়াডাঙ্গায় থাকতেন। তার স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। সন্তানদের নাম আশিক, এ্যামি ও অর্ণব।

তিনি আরও জানান, ৮ বছর ধরে এই দরবার শরিফটি চলছে। এটি চালাতেন ফরহাদ হোসেন চৌধুরী। সেখানে প্রতিদিন রাতে মুরিদরা আসতেন এবং জিকির করতেন। বিকালে ফরহাদ হোসেন শহর থেকে গাড়ি করে দরবার শরিফে চলে আসতেন।

প্রতিবেশীদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, প্রায় ৬-৭ বছর আগে নাগরিক জীবনের সবকিছু ছেড়ে আকস্মিক ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করেন ফরহাদ হোসেন চৌধুরী। সেসময় সবার কাছে রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে নিজেকে পীর পরিচয়ই বেশি দিতেন তিনি। লোকজনও তাকে সেভাবেই চিনত। রাজনৈতিক অঙ্গন ও মোটর মালিক সমিতিতে নিজের ভালো অবস্থান থেকেই অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে সু-সম্পর্কের সুবাদে অল্প সময়েই নিজের বেশকিছু ভক্ত অনুরাগী তৈরি করে বনে যান কথিত পীর।

প্রতিবেশীরা জানায়, ধীরে ধীরে ফরহাদ হোসেন বাড়িতে পীরের আখড়া গড়ে তুলেছিলেন। একসময় বাড়িটি ‘দৌলা দরবার শরিফ’ নামে পরিচিত হয়ে পড়ে আশেপাশের মানুষদের কাছে। গত কয়েকবছর ধরে এ কথিত পীর এই আস্তানায় সপ্তাহে একদিন আনুষ্ঠানিকভাবে মুরিদরা জিকির-আজকার করতেন। এছাড়াও প্রায় দিনই এই আস্তানায় কমপক্ষে শতাধিক মুরিদ-ভক্ত জমায়েত হতেন এবং রাতভর চলত জিকির। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, জিকির শুরুর আগে আগে তখনো লোকজন জড়ো হয়নি- এমন সময় ৬-৭ জন দুর্বৃত্ত দরবারে ঢুকে প্রথম ‘হুজুরকে’ চাকু দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে ও গলা কাটে। পরে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় রূপালী বেগম চিৎকার করলে দুর্বৃত্তরা একই কায়দায় তাকেও পাশের আরেকটি ঘরে হত্যা করে।

দৌলা দরবার শরিফের খাদেম সায়েদুল বলেন, প্রতিদিন রাতে দরবারের জিকির ও মিলাদ হতো। জিকিরে অংশ নিতে সুমি নামে এক মুরিদ রাতে দরবারে আসেন। দীর্ঘক্ষণ হুজুরকে (ফরহাদ) ঘুমিয়ে থাকতে দেখে তিনি আমাকে ডাক দেন। আমি এসে দেখি হুজুরের রক্ত মাখা লাশ। পরে পরিবারের অন্যদের খোঁজ নিতে গিয়ে পাশের একটি কক্ষে গৃহকর্মী রূপালিকেও মৃত অবস্থায় দেখতে পাই।

ঘটনাস্থলে থাকা জেলা পুলিশ সুপার হামিদুল হক জানান জানান, পুলিশ এরই মধ্যে তদন্তে নেমে গেছে। সিআইডির সদস্যরা আলামত সংগ্রহ করছে।

প্রাথমিক তদন্তের বরাতে সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন, নিহত ফরহাদ হোসেন চৌধুরী দৌলা খানকার পীর হিসেবে পরিচিত।

স্থানীয়রা জানায়, গেলো ৮ বছর ধরে ফরহাদ হোসেন আখড়াটি চালাচ্ছেন। সপ্তাহে একদিন বিশেষ জিকিরের আসর বসে। আজও এরকম জিকিরের আগে সুযোগ বুঝে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়।

(ঢাকাটাইমস/১৫মার্চ/প্রতিনিধি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :