স্বর্ণা, ভালো থাকিস মা…

আরাফাত সিদ্দিকী সোহাগ
| আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০১৭, ১৮:০২ | প্রকাশিত : ২৮ এপ্রিল ২০১৭, ১৭:২৮

ছবির শিশুটির নাম স্বর্ণা। আমাদের এটিএন নিউজের নেত্রকোণা প্রতিনিধি শামীম আহমেদের মেয়ে।সাড়ে চার বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে স্বর্ণা। নেত্রকোণায় তাদের বাড়ির পাশেই খেলছিল বন্ধুদের সঙ্গে। পাশেই ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ঠিক করছিলো এক লোক। হঠাৎ যান্ত্রিক গোলযোগে অটোরিকশাটি ছুটে এসে স্বর্ণাকে চাপা দেয়। আহত হয় আরও একজন। অটোর সামনের একটি রড স্বর্ণার মাথায় আঘাত করে। মুহূর্ত দেরি না করে স্বজনরা মেয়েটাকে নিয়ে ছুটে যায় নেত্রকোণা সদর হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা বলতে মাথায় ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ। সিটি স্ক্যান করার পরামর্শও দেয়নি তারা। চিকিৎসকরা মেয়েটিকে পাঠায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তবে সেখানেও ডাক্তাররা জানান, মাথায় আঘাতের চিকিৎসা ওই হাসপাতালে সম্ভব নয়। তারাও নতুন ব্যান্ডেজ করে। স্যালাইন লাগায়। ততক্ষণে রক্তক্ষরণে স্বর্ণার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে। মেয়েটির বাবাই তাকে রক্ত দেয়। রক্তের ব্যাগসহ তুলে দেয় হয় অ্যাম্বুলেন্সে। সিটি স্ক্যান করার পরামর্শও দেয়া হয়নি সেখান থেকেও।

নেত্রকোণা থেকে শিমুল মিল্কি ভাই ফোন করে আমাকে এই ঘটনা জানায়। এরই মধ্যে কবি নির্মলেন্দু গুণও ফোন দিলেন। পিজি (বিএসএমএমইউ দেশের প্রথম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সেখানকার উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান। অফিস থেকে প্রভাষ আমিন উপাচার্যকে জানান বিষয়টা। উপাচার্যের সঙ্গে কবি নির্মলেন্দু গুণ কথা বলেন। ডা. কামরুল সরাসরি শিশুটিকে ব্লক-সি, নিউরোলজি বিভাগে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। সেখানকার ডাক্তারকে বলে রেখেছেন তিনি। সন্ধ্যা নাগাদ স্বর্ণা ও তার স্বজনরা সাবেক পিজি হাসপাতালে পৌঁছালে ডাক্তার জানান, তাদের এখানে কোন সিট খালি নেই। আর সিট খালি না থাকলে চিকিৎসা দেবার নিয়ম নেই তাদের। বিষয়টি উপাচার্য কামরুল হাসানকে জানালে, তিনিও তার পিএস মারফত অপারগতা প্রকাশ করেন। নির্মলেন্দু গুণকে তিনি বলেছেন, ওরা দেরি করেছে পৌঁছাতে। কবি গুণ তাকে বলেছেন, এক্সিডেন্টটা অফিস টাইমের মধ্যে, তোমাদের জানিয়ে ঘটেনি বলে আসলে আমি দুঃখিত।

আবার ব্যান্ডেজ। আবার অ্যাম্বুলেন্স। এবার গন্তব্য, দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ডিএমসিএইচ)। সেখানে চিকিৎসা শুরু হয়। ময়মনসিংহ থেকে আসার পথেই গাড়ির ঝাঁকুনিতে স্বর্ণার শরীরে লাগানো ব্লাড ব্যাগের নলটি ছুটে গেছে। আমি ডিএমসির ডাক্তারকে জানাই রক্ত টানা হয়েছে দুপুর দুইটার দিকে। রাত নয়টার সময়ও সেই রক্ত স্বর্ণার শরীরে দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ঢাকা মেডিজেলে আমাদের সহকর্মী, তাকে সবাই নানাভাই ডাকে। তিনি দৌঁড় ঝাপ করে সিটি-স্ক্যান করান। স্বর্ণার জায়গা হয় ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডের বারান্দায়। কেবিনে ডাক্তার/নার্স সহজে যায় না। ভাবলাম কেবিনের জন্য চেষ্টা করে লাভ নেই। স্বর্ণা ও তার স্বজনদের ডিএমসিতে রেখে রাত ১১টার দিকে ফিরলাম অফিসে।

রাত একটা বেজে ৫৯ মিনিট। শামীম ভাইয়ের ফোন। কান্না জড়িত কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলাম। শামীম জানালো তার মেয়ের অবস্থা ভালো না। ডিএমসি থেকে বলেছে, দ্রুত আইসিইউতে নিতে হবে। কিন্তু তাদের আইসিইউতে সিট খালি নেই। ডিএমসির পরিচিত সব ডাক্তারদের ফোন দিতে শুরু করলাম। এতো রাতে কেউ ফোন ধরলেন, কেউ ধরলেন না। যাদের সঙ্গে কথা হলো, তারা জানালো আইসিইউতে সিট খালি না থাকলে আসলে কারো কিছু করার নেই। তাদের কথা যৌক্তিক। এরই মধ্যে ডিএমসিতে স্বর্ণা ও তার স্বজনদের আশে পাশে বেশ কয়েকজন দালাল জুটে গেছে। তারা বলছে নাম না জানা, নানা হাসপাতালের কথা। অনেকটা উপকার করতে আসা স্বেচ্ছাসেবীর ভঙ্গী। সাংবাদিক শামীম সহজেই বিষয়টা বুঝেছে দেখেই ফোন দিয়েছে আমাকে। আমি ফোন দিলাম আদ-দ্বীন হাসপাতালে। তারা জানালো, ঢাকা শহরের সব জায়গা থেকে রুগী আনা-নেয়া করতে পারে। কিন্তু ডিএমসিতে অ্যাম্বুলেন্স নিলে, ওখানকার অ্যাম্বুলেন্সের সিন্ডিকেট, তাদের গাড়ি ভাংচুর করে। আমাদের ট্রান্সপোর্টে ফোন দিয়ে অনুরোধ করলাম একটা গাড়ী পাঠাতে। নিউজের গাড়ি দেখলে আর যাই হোক, দালালরা ঝামেলা পাকাবে কম।

যে কয়টা ভালো হাসপাতালের নাম জানি, ফোন দিতে শুরু করলাম। গ্রিন লাইফ সব শুনে পরামর্শ দিলো ধানমন্ডির পেডি কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যেতে। মাত্র সাড়ে চার বছরের শিশু, তাও আবার হেড ইনজুরি। তারা রিক্স নিতে রাজি নয়। হাসপাতালের ইমেজ বলে কথা। পেডি-কেয়ার জানালো তাদের এনআইসিইউতে সিট খালি আছে। তারা ভর্তি নিবে। এরই মধ্যে আমাদের একটা গাড়ি পৌঁছে গিয়েছে ঢাকা মেডিকেলে। স্বর্ণাকে নিয়ে আসতে পারলেও ডিএমসির তুহিন নামের এক ওয়ার্ড বয় ডাক্তারদের লেখা রুগীর হিস্ট্রি ও অন্যান্য কাগজ কেড়ে নিয়েছে। তার ক্ষোভ, স্বর্ণাকে গ্রিন রোডের ইউনিহেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে কেন নেয়া হচ্ছে না। এই হাসপাতালটির সম্পর্কে এরই মধ্যে খোঁজ নিয়েছি আমি। তাদের আইসিইউ বলতে অক্সিজেনের নল, আর এসি রুম। যাই হোক, কাগজ রেখেই স্বর্ণাকে নিয়ে তার স্বজনরা আসল ধানমন্ডি পেডি কেয়ারে। তাদের আগেই আমি পৌঁছে কথা বলেছি সেখানে। তার পরেও বাচ্চাটা পৌঁছানোর পর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। আমার কাছে মনে হচ্ছিল কয়েক ঘণ্টা। অবশেষে ডাক্তার এসেই জানালো সেই এক কথা, তারা মাথায় আঘাত পাওয়া শিশুটিকে রাখতে অক্ষম। অথচ আগে আমাকে চিকিৎসার নিশ্চয়তা দিয়েছিলো। তর্ক করে নষ্ট করার মতো সময় নেই আমার হাতে। দ্রুত গাড়িতে উঠে গেলাম ল্যাব এইড হসপিটালে। সেখানেও কিছুটা সময় নষ্ট। বয়স আর ইনজুরির ধরণ শুনে, সবাই বলে সিট নেই আইসিইউতে। সেখান থেকে সেন্ট্রাল হসপিটালে। অভিজ্ঞতার হেরফের নেই। রওনা দিলাম স্কোয়ারের দিকে। গ্রিন রোড, পান্থপথের বিভিন্ন ক্লিনিকের লাল নীল উজ্জ্বল সাইনবোর্ডগুলো যেন উপহাস করছিলো। গাড়ির শব্দ ছাপিয়ে হাপর টানার শব্দ আসছিলো স্বর্ণার বুক থেকে। সব শব্দ ছাপিয়ে শুনছি স্বর্ণার মায়ের কান্না। স্কোয়ারেও সেই একই কথা। তবে তারা নানা গবেষণায় সময় কিছুটা বেশি নষ্ট করেছে। সেখান থেকে মহাখালীর মেট্রোপলিটন হাসপাতালে। ম্যাট্রোতে নানা টালবাহানার পর জানালো তারা রুগী রাখবে। তবে প্রতিদিন ভাড়া গুনতে হবে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার। রাজি হলাম। তখন শিশুটির জীবন বাঁচানোই মুখ্য। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এখানে কেটে গেলো প্রায় ঘণ্টা খানেক। নিউরো সার্জন কল্যাণ কুমার বড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলে বাচ্চাটা ভর্তি নিলো তারা। লিখিত রাখল দুপুরের আগে কম পক্ষে ৪০ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। মেট্রোপলিটনের আইসিইউতে নেয়ার পর, সেখানকার ডাক্তার রুগী দেখেই আঁতকে উঠলো। জানালেন তাদের এখানে এনআইসিইউ বা পিআইসিইউ নেই। প্রয়োজনে বাচ্চাটিকে লাইফ সাপোর্ট দিতে পারবেন না তারা। তবে সেই নাম না জানা তরুণ ডাক্তারের কাছে কৃতজ্ঞ। যতক্ষণ আমি শিশুদের আইসিইউ আছে এমন হাসপাতাল খুঁজে বের করছি। দক্ষ হাতে ততক্ষণ স্বর্ণার সেবা করেছেন তিনি। ভর্তির সময় জমা দেয়া টাকা যাতে ফেরত পেতে ঝামেলা না হয়, সেই ব্যবস্থা করেছেন।

মহাখালীর আয়েশা মেমোরিয়ালে শিশুদের আইসিইউ আছে। তাদের ওয়েবসাইট থেকে নাম্বার নিয়ে ফোন দিলাম। কিছু না শুনেই তারা জানালো সিট খালি আছে। বললাম বাচ্চার বয়স সাড়ে চার। বললো সমস্যা নেই। বললাম হেড ইনজুরি। তারা জানালো তাদের নিউরোলজিস্ট আছেন। মহাখালী থেকে জাহাঙ্গীর গেট যাওয়ার পথে হাসপাতালটি। স্বর্ণাকে সরাসরি তারা পিআইসিইউতে নিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরে জানালো ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েছে। আধঘণ্টা পরে জানালো আপনারা সময় করে গিয়ে ভর্তি হয়ে আসেন। হাসপাতালটার খরচও অনেক কম। তবে অ্যাডভান্স দেয়ার পর্যাপ্ত টাকা নেই শুনে একটু গাইগুই করে কিছু টাকা নিয়ে ভর্তি করে নিলো। ডাক্তার জানালো বাচ্চাটাকে হয়তো লাইফ সাপোর্ট দেয়া লাগতে পারে। আবার নাও লাগতে পারে। তবে আজ হোক কাল হোক মাথায় অপারেশন লাগবে। মাথার খুলির কিছুটা অংশ ভেঙ্গে ঢুকে গেছে। সকালে নিউরো সার্জন এসে সিদ্ধান্ত নেবেন কি করবেন। পরদিন তারা ১১টার দিকে তারা জানালো স্বর্ণার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। একটু স্থিতিশীল না হলে অপারেশন করা সম্ভব না। রাতে নির্মলেন্দু গুণ এলেন হাসপাতালে। স্বর্ণাকে দেখতে। ডাক্তার যা বললো তাতে বুঝলাম, মানুষের মস্তিষ্কের জ্ঞান বা কর্মক্ষমতার যে পরিমাপক, তাতে স্বর্ণার অবস্থান তিন। ভর্তি করার সময় সেটা ছয় ছিলো। সুস্থ মানুষের থাকে ১৫। ডাক্তার জানালেন, শুধু মাথার খুলি নয়, স্বর্ণার কানের পাশে হাড়ও ভেঙ্গেছে। তবুও একটু আশায় আছেন তিনি। যদি কোন অলৌকিক কিছু ঘটে। শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো।

পরদিন স্বর্ণার অবস্থা একটু ভালো হলো। তবে সন্ধ্যায় ডাক্তার জানালেন, আর কিছুই করার নেই তাদের...

এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন নেত্রকোণায় স্বর্ণার দাফন শেষ হয়েছে। নির্মলেন্দু গুণ তার ক্ষোভ ঢেকে রাখতে না পেরে লিখেছেন, মা স্বর্ণা-তুই আমাদের ক্ষমা করিস না। আর আমি ভাবছি, দোসটাতো আসলে স্বর্ণারই। এই দেশে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার চাইতে বড় অপরাধ আর কি আছে?

মা স্বর্ণা, যেখানেই থাকিস... ভালো থাকিস... আরেকবার জন্মানোর সুযোগ পেলে, এই দেশে আসিস না...।

(লেখাটা এটিএন নিউজের সাংবাদিক আরাফাত সিদ্দিকী সোহাগের ফেসবুক পাতা থেকে সংগৃহীত)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :