ভয়াবহ দূষণে নরসিংদীর ৭ নদী
শত সবুজের ছায়ায় ঘেরা, উঁচু-নিচু, চর-পাহাড়ে, ফলে-ফুলে ভরা ৩৩৬০.০৫ বর্গ কিলোমিটারের জেলা নরসিংদী। মেঘনা, শীতলক্ষা, আড়িয়ালখাঁ, হাড়িধোয়া, পাহাড়িয়া ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীবেস্টিত নরসিংদী জেলায় মোট জনসংখ্যা ২৪ লক্ষাধিক।
ছয়টি উপজেলায় সাতটি থানায় ৭২টি ইউনিয়ন নিয়ে এ জেলা গঠিত। রাজধানী ঢাকা থেকে জেলার দূরত্ব রেলপথে ৫৫ কিলোমিটার এবং সড়ক পথে ৫৭ কিলোমিটার। নরসিংদীর সাগরকলা এক সময়ের সারাদেশে সমাদৃত ছিল। কৃষি প্রধান এ জেলা থেকে বর্তমানে সারাদেশের প্রয়োজনের প্রায় ৩০ ভাগ শাক-সিবজি সরবরাহ হয়।
এক সময়ের তাঁত সমৃদ্ধ এ জেলা বর্তমানে আধুনিক শিল্প সমৃদ্ধ জেলায় উন্নিত হয়েছে। মাধবদী-বাবুর হাট নামে দেশের একটি বৃহৎ কাপড়ের হাট এ জেলায় অবস্থিত। দেশের চাহিদার প্রায় এক তৃতীয়াংশ কাপড় এ জেলায় উৎপাদন হয়। সম্পূর্ণ রপ্তানিমুখী কয়েকটি বৃহৎ শিল্প কারখানাও এ জেলায় অবস্থিত। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকাংশ কারখানায়ই ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন করা হয়নি। বড় বড় কিছু শিল্প কারখানাতে ইটিপি স্থাপন করা হয়েছে বটে। কিন্তু তা ব্যবহার হচ্ছে না। কারণ ইটিপি ব্যবহারে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়।
শিল্প প্রসারের সাথে সাথে জেলার নদ-নদীগুলোর মধ্যে আড়িয়ালখাঁ ও পাহাড়িয়া নদী ছাড়া বাকি সবগুলো নদ-নদী মারাত্মক দূষণের শিকার হয়ে পড়েছে। ফলে এ অঞ্চলের জীব বৈচিত্রও পাল্টে গেছে। নদী দূষণের কারণে নদী পাড়ে বসবাসকারীরা শ্বাষকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। জীবন জীবিকায়ও পড়েছে এর প্রভাব। এখন নদীতে মাছ নেই, নেই মাছ ধরার নৌকাগুলো। এক সময়ের এই নদীগুলোতে জেলেরা মাছ ধরতো। নদী পাড়ের মানুষেরা মাছ ধরা, কাপড় কাঁচা ও গোসলের কাজ এমনকি নদীর পানি দিয়ে রান্না বান্নার কাজও করত। কিন্তু আজ এ নদীগুলোর পানি খাওয়া, কাপড় কাচা, গোসলকরা কিংবা মাছ ধরাও স্বপ্নের মত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদী পাড়ে বসবাসকারীরা সাধারণত হাঁস পালন করে করে থাকে। কিন্তু মৃত প্রায় এসব নদী পাড়ের মানুষ হাঁস পালন ছেড়ে দিয়েছে। কারণ নদীর পানি মারাত্মক দূষণের ফলে হাঁসও পানিতে নামলে মরে যায়। কোন কারণে এ নদীর পানিতে পা পড়লে সংগে সংগে পায়ে বিভিন্ন চর্মরোগ দেখা দেয়। পানিতে মিশে যাওয়া কেমিক্যালের গন্ধে নদীর পাড় দিয়ে এখন কেউ হেঁটে যেতে পারে না।
পলাশ উপজেলার উপর দিয়ে প্রবহমান শীতলক্ষ্যা নদী থেকে গজারিয়া ও চিনিশপুর ইউনিয়নের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে হাড়িধোয়া নদী থেকে শীলমান্দী ইউনিয়নের শেখেরচর হয়ে মাধবদী দিয়ে আড়াইহাজার উপজেলার উপর দিয়ে সোনাখালিতে গিয়ে পতিত হয়েছে। এক সময়ে এ নদীটি মৃত প্রায় অবস্থায় বানিয়ারখাল নামধরে মাধবদী থেকে শেখেরচরের উপর দিয়ে মহিষারশুড়া ইউনিয়নের হামটি স্লুইচগেইট হয়ে মেঘনা নদীতে মিশে গেছে।
বর্তমানে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর দুই পাড় দখল করে নিয়েছে এসব প্রভাবশালী শিল্পপতিরা। যার কারণে বর্তমানে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী বিলুপ্ত প্রায়। এ নদী দিয়ে বর্তমানে ড্রেন আকারে শুধুমাত্র শিল্প কারখানার নির্গত বর্জ্য ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীতে পড়ছে। যে কারণে মেঘনা নদীতেও এখন বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি ঘটতে শুরু করেছে।
একইভাবে হাড়িধোয়া নদী দিয়েও বিভিন্ন শিল্প কারখানার শিল্প বর্জ্য ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি মেঘনায় গিয়ে পড়ছে। অতি সম্প্রতি ভৈরব রেল ব্রিজ থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা ব্রিজ পর্যন্ত ‘মেঘনা নদী বাঁচাও’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে নরসিংদী পৌর কর্তৃপক্ষ ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।
এ প্রকল্পের উদ্যোগে গত ৯ মে নরসিংদী পৌর মিলনায়তনে নরসিংদীর সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ ও পৌর কর্তৃপক্ষের সংগে প্রকল্প কর্মকর্তাদের এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এ সভায় নরসিংদীর পৌর মেয়র কামরুজ্জামান নরসিংদীর নদী দূষণ নিয়ে তার গৃহিত পদক্ষেপগুলো উল্লেখ করেন এবং সরকারের উপর মহলে তার প্রেরিত কিছু সুপারিশের কথা জানান।
এসময় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হলো নদী দূষণ বন্ধ করা। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ নরসিংদীর এসব নদী দূষণের কারণগুলো চিহ্নিত করে তা বন্ধ করার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না। এতে আগামী কিছু দিনের মধ্যে নদী দূষণের কারণে নদীবেষ্টিত নরসিংদী শহরের মানুষের নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হবে। কারণ বাতাসে শুধু মাত্র কেমিক্যালের দুর্গন্ধ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। এ জেলার অতি অল্পসংখ্যক লোক এ দূষণের মূলে রয়েছেন।
নরসিংদীর সুশীল সমাজ আশা করছে, অতি দ্রুতই সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের হস্তক্ষেপে নরসিংদীর এই নদী দূষণ বন্ধ হবে।
(ঢাকাটাইমস/৩জুন/প্রতিনিধি/এলএ)
মন্তব্য করুন