আমাদের বিরুদ্ধে কোনো একটা রায় দেওয়া হবে: খালেদা
এতিমখানা দুর্নীতি মামলার রায় বিপক্ষে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তার মতে, বিপক্ষে গেলে এই রায় হবে সরকারের ইচ্ছায় ও নির্দেশে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বৃহস্পতিবার পুরান ঢাকার বকশীবাজারে বিশেষ আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে চতুর্থ দিনের শুনানিতে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন।
বেলা ১২ টা ৬ মিনিট থেকে একটা ২৪ মিনিট পর্যন্ত খালেদা জিয়া আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেন। বক্তব্য শেষে বেলা একটা ৪০ মিনিটে তিনি আদালত ছেড়ে যান।
রায় পক্ষে গেলেই স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার প্রমাণ পাবেন খালেদা
‘শাসক মহলের ইচ্ছে অনুযায়ী আমাদের বিরুদ্ধে কোন একটা রায় দেওয়া হবে’ এমন আশঙ্কা করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, আপনি (বিচারক) সাহস ও সততার সঙ্গে সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে আইন অনুযায়ী ন্যায় বিচার করবেন।’কেন স্বাধীনভাবে রায় দেয়া নাও হতে পারে বলে ভাবছেন, তাও জানান বিএনপি প্রধান। বলেন, ‘আমাদের বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন দাবি করা হলেও সাম্প্রতিক বিভিন্ন উদাহরণ সেই দাবিকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’
এই মামলার রায় পক্ষে এলেই বিচার বিভাগ স্বাধীন বলে মনে করবেন খালেদা জিয়া। বলেন, ‘এই স্বাধীনতার দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা বর্তমান মামলাতেও অনেকখানি বোধগম্য হবে। প্রমাণিত হবে, বিচারকগণ স্বাধীনভাবে, বিবেকশাসিত হয়ে এবং আইনসম্মতভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম কি না।’
রায় বিপক্ষে গেলেই দুর্নীতিবাজ প্রমাণ হবে না
বিএনপি প্রধান বলেন, রায় বিপক্ষে গেলেও তিনি তোয়াক্কা করবেন না। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে বহু বিখ্যাত নেতাকেই দুর্নীতি মামলায় ফাঁসান হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সেই সব বিচারকে কি বিশ্ববাসী ন্যায়বিচার বলে মেনে নিয়েছে? ইতিহাসের ধোপে সে সব রায় কি টিকেছে?’।
‘যাদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করে সাজা দেয়া হয়েছিল, বিশ্বমানবতা ও ইতিহাস তাদেরকেই দিয়েছে অপরিমেয় মহিমা। ইতিহাস রায় দিচ্ছে, নিরপরাধকে অপরাধী সাব্যস্ত করে যারা রায় দিয়েছিলেন তারাই প্রকৃত অপরাধী।... পৃথিবীতেও তাদের নাম ও স্মৃতি যুগ যুগ ধরে অগণিত মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কার কুড়াচ্ছে।’
বহু বিখ্যাত মানুষেরও সাজার উদাহরণ
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমাদের এই দেশে ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিচারের নামে অবিচারের বিভিন্ন নমুনা আমরা দেখেছি। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একজন প্রভাবশালী নির্মাতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান। তাকেও দুর্নীতির মামলার বিচারে কারাদ- দেয়া হয়েছিল।’
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, অলি আহাদ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী, মওলানা শওকত আলী-মোহাম্মদ আলী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাস ও জওহর লাল নেহেরু, দক্ষিণ আফ্রিকায় কিংবদন্তি নেলসন ম্যা-েলা, যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং, যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের সাজার কথাও উল্লেখ করেন খালেদা জিয়া। বলেন, ‘তাদের মতো মানুষদেরকেও কোনো না কোনো বিচারেই সাজা দেওয়া হয়েছে। তথাকথিত সেইসব রায়ের পিছনেও কোনো না কোনো যুক্তি, অজুহাত ও আইন দেখানো হয়েছিল।’
‘হযরত ইমাম আবু হানিফা ও সক্রেটিসের মতো মহামানবদেরকেও তো বিচারের নামেই সাজা দেয়া হয়েছিল’
‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয়, কেউ নেন না’
এই মন্তব্য করে বিএনপি নেত্রী বলেন, যারা শিক্ষা নেন, মানুষ ও ইতিহাস তাদেরকে সম্মানিত করে। আর যারা কোনো শিক্ষা নেয় না, তাদের ঠাঁই হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে, আর মানুষের ঘৃণা ও ধিক্কারে।’
বিচারকের প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘সময়ের পরিক্রমায় আজকের সময়ও এক সময় ইতিহাস হবে। আলোচ্য এ মামলাটিও নিশ্চয়ই ইতিহাসের এক মূল্যবান উপকরণ হবে। কাজেই এই পটভূমিতে আপনি ইতিহাসের শিক্ষা থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করবেন কি-না, সেই সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। এরজন্য আপনাকে নির্ভর করতে হবে সুবিবেচনা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, সাহস ও সততার ওপর। অনাগত দিন বলে দেবে, আইন ও বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়ে আপনি সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছিলেন কি-না।’
আ.লীগের আন্দোলনের সমালোচনা
দীর্ঘ বক্তব্যে বিএনপি সরকারে থাকাকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কথাও তুলে ধরেন খালেদা জিয়া।
আওয়ামী লীগ আন্দোলনের নামে দেশে সহিংস হানাহানি ও নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল মন্তব্য করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা সাধারণ মানুষকে বহনকারী যানবাহনে বোমা মেরেছে এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে চলন্ত বাসের বহু নিরাপরাধ যাত্রীকে তারা জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছে।’
‘বিভিন্নভাবে আরো বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের মাথা তারা ইট দিয়ে থেঁৎলে দিয়েছে।’
২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় ফেরার পরও আওয়ামী লীগের এসব কর্মকা- অব্যাহত ছিল বলেও আদালতে মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া। বলেন, এই দলটির আন্দোলনের কারণেই সে সময়ে সেনা প্রধান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে নেয়। আর আওয়ামী লীগ এই সরকারকে সমর্থন দেয়।
‘সুইস ব্যাংকে কারা টাকা জমিয়েছে’
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের হিসাবে বিপুল পরিমাণ টাকা জমা হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে কারা এই টাকা জমিয়েছে, সেই প্রশ্ন তোলেন খালেদা জিয়া। বলেন, ‘গত ১০ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতায় নেই। কারা সুইস ব্যাংকে ওই টাকা পাচার করেছে?’ ফাঁস হওয়া পানামা পেপার্সেও বিদেশে অবৈধ পথে ক্ষমতাসীনদের অর্থ পাচারের কথা এছ বলেও দাবি করেন খালেদা জিয়া। বলেন, অফসোর কোম্পানিগুলোতে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে।
দেশে এখন কোনো খাতই অবাধ লুটপাট থেকে মুক্ত নয় মন্তব্য করে বিএনপি নেত্রী বলেন, ‘অথচ এখনো প্রচারণা ও মামলা চলছে আমাদের বিরুদ্ধে।’ ‘আমাদের বিরুদ্ধে তো কম অপপ্রচার করা হয়নি। সারা দুনিয়ায় চষে বেড়িয়ে এবং সব তন্নতন্ন করে দেখে কয় লাখ বা কয় কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আজ পর্যন্ত আনতে পেরেছে?’-প্রশ্ন রাখেন বিএনপি নেত্রী।
গত ৭ বছরে ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা চুরি হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া। বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নামে আইটি খাতে বিশাল দুর্নীতি চলছে। জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধি
খালেদা জিয়া আদালতে আসার পর তার আইনজীবী মওদুদ আহমেদ, সানাউল্লাহ মিয়া ও মাসুদ আহমেদ তালুকদার দুই মামলায়ই তাঁর জামিন স্থায়ীর আবেদন করেন। দুদকের পক্ষে আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল এই আবেদনের বিরোধিতা করেন। শুনানি শেষে বিচারক আত্মপক্ষ শুনানির পর জামিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে বলে জানান। আত্মপক্ষ শুনানির পর জামিন স্থায়ীর আবেদন নামঞ্জুর করে আগামী ১৬ নভেম্বর ধার্য তারিখ পর্যন্ত জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধি করেন।
মামলায় কী অভিযোগ
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তার আগের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই এই মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এতে এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।
২০০৯ সালের ৫ অগাস্ট এই মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে জমা পড়ে। এতে খালেদা জিয়া ছাড়াও তার ছেলে তারেক রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমানকে আসামি করা হয়।
গত ১৯ অক্টোবর প্রথম দফা, ২৬ অক্টোবর দ্বিতীয় দফা এবং গত ২ নভেম্বর তৃতীয় দফায় আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য রাখেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
এই মামলা ছাড়াও খালেদা জিয়া, তার ছেলে এবং আরও বেশ কয়েকজন আসামির বিরুদ্ধে চলছে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট এই মামলাও করে দুদক। এতে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়। দুটো মামলাই পুরান ঢাকার বিশেষ আদালতে চলছে সমান্তরালে।
(ঢাকাটাইমস/৯নভেম্বর/আরজে/ডব্লিউবি)