ইলিশের জীবন রহস্য উন্মোচন

রাকিবুল হাসান, বাকৃবি প্রতিনিধি
| আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:০৭ | প্রকাশিত : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:২৬

বিশ্বে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।

শনিবার সকাল ৯ টার দিকে বাকৃবি সাংবাদিক সমিতিতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য জানান গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলমের নেতৃত্বে একটি গবেষণা দল ইলিশের জীবন রহস্য আবিষ্কার করেন।

এ গবেষক দলের অপর সদস্যরা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বজলুর রহমান মোল্যা, বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল ইসলাম ও ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ গোলাম কাদের খান।

গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. সামছুল আলম বলেন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে দুই বছর গবেষণার পর এ সাফল্য পেয়েছেন তারা। প্রথমে দেশের বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা থেকে পূর্ণবয়স্ক ইলিশ মাছ সংগ্রহ করেন।

এরপর বাকৃবি ফিস জেনেটিক্স অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি এবং পোল্ট্রি বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জিনোমি ল্যাররেটরি থেকে সংগৃহীত ইলিশের উচ্চ গুণগত মানের জিনোমিক ডিএনএ প্রস্তুত করা হয়।

পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের জিনউইজ জিনোম সিকোয়েন্সিং সেন্টার থেকে সংগৃহিত ইলিশের পৃথকভাবে প্রাথমিক জিনোম তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সার্ভার কম্পিউটারে বিভিন্ন বায়োইনফরম্যাটিক্স প্রোগ্রাম ব্যবহার করে সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্য থেকে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ ডি-নোভো জিনোম সিকুয়েন্স বা জীবনরহস্য আবিষ্কার করা হয়।

তিনি বলেন, ইলিশের জিনোমে ৭৬ লাখ ৮০ হাজার নিউক্লিওটাইড রয়েছে যা মানুষের জিনোমের প্রায় এক চতুর্থাংশ। তবে পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে ইলিশ জিনোমে জিনের সংখ্যা জানার কাজ অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।

সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমানে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স জানার মাধ্যমে অসংখ্য অজানা প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে খুব সহজেই। বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে ইলিশের স্টকের সংখ্যা (একটি এলাকায় মাছের বিস্তৃতির পরিসীমা) কতটি এবং দেশের পদ্মা, মেঘনা নদীর মোহনায় প্রজননকারী ইলিশগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্টক কিনা তা জানা যাবে এই জিনোম সিকোয়েন্সর মাধ্যমে।

বছরে দুইবার ইলিশ প্রজনন করে থাকে। জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে এই দুই সময়ের ইলিশ জীনগতভাবে পৃথক কিনা তা জানা যাবে। এমনকি কোনো নির্দিষ্ট নদীতে জন্ম নেয়া পোনা সাগরে যাওয়ার পর বড় হয়ে প্রজননের জন্য আবার একই নদীতেই ফিরে আসে কিনা সেসব তথ্যও জানা যাবে এই জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে।

ইলিশ মাছের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রধান গবেষক প্রফেসর ড. মোঃ সামছুল আলম বলেন, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। দেশে এর চাহিদার পাশাপাশি বিদেশেও চাহিদা রয়েছে প্রচুর।

পৃথিবীর মোট ইলিশ উৎপাদনের প্রায় ষাট ভাগ উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। তাই দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। আর ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে আমাদের জানতে হবে এর জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজননসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। জিনোম হচ্ছে কোন জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। জীবের জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াসহ সকল জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় জিনোম দ্বারা।

আর এই পুর্ণাঙ্গ জিনোম সিকুয়েন্স থেকেই জানা যাবে এরা কখন, কোথায় ডিম দেবে। আর এসব জানা গেলে সরকার খুব সহজেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে ইলিশের টেকসই আহরণ এবং উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারবে সরকার।

তিনি আরও জানান, ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশীয় ইলিশের একটি রেফারেন্স জিনোম প্রস্তুত করা এবং জিনোমিক তথ্যভান্ডার স্থাপন করা। এই তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে পরবর্তিতে গবেষকরা ইলিশের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করতে পারবে।

তবে ইলিশের সার্বিক উন্নয়নে পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং বা জীবন রহস্য উদঘাটনের এই জ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ফলপ্রসূভাবে কাজে লাগাতে হলে এ বিষয়ে গবেষণা আরও জোরদার করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা।

ইলিশের পূর্ণাঙ্গ ডি-নোভো জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের গবেষণা কাজটি গবেষকবৃন্দের নিজস্ব উদ্দ্যোগ, স্বেচ্ছাশ্রম এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়েছে। এ গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলদেশের মৎস্য সেক্টর পূর্ণাঙ্গ জিনোম গবেষণার যুগে প্রবেশ করল।

এর আগে পাট ও মহিশের পূর্ণ জীবন-রহস্য উন্মোচন করেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা।

২০১৩ দেশি পাটের জীবন-রহস্য উন্মোচন করে বাংলাদেশি গবেষকরা। পাট নিয়ে এ গবেষণায় নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম। এর আগে ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো তোষা পাটের জিনোম সিকোয়েন্স বা জীবন-রহস্য উন্মোচন করে বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন মাকসুদুল আলম ও তার সহযোগীরা।

২০১২ সালে তারা উন্মোচন করেন ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা নামের এক ছত্রাকের জিন-নকশা, যা পাটসহ প্রায় ৫০০টি উদ্ভিদের পূর্ণাঙ্গ জিন তথ্য উন্মোচিত হয়। এত আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে কৃষকের হাতে রোগ প্রতিরোধী ও উন্নত জাতের পাট তুলে দেয়া সম্ভব হবে বলে মত দেন বিজ্ঞানীরা।

২০১৪ সালে মহিষের জিন নকশা উন্মোচন করেন বিজ্ঞানীরা। এ দলের প্রধান ছিলেন লাইভস্টক বিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামান। বাংলাদেশ ও চীনের বিজ্ঞানীরা বিশ্বে সর্বপ্রথম মহিষের পূর্ণ জীবন-রহস্য উন্মোচনে সক্ষম হন।

জীববিজ্ঞানী, বায়ো-ইনফরমেটিশিয়ান ও তথ্য-প্রযুক্তিবিদদের সমন্বয়ে গঠিত একদল গবেষক মহিষের জেনোম উপাত্ত থেকে জৈবিক উপাদান শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করেছেন। এ গবেষণায় পাওয়া উপাত্তগুলো মহিষের উন্নত ও অধিক উত্পাদনশীল জাত উন্নয়নে সহায়ক হবে।

(ঢাকাটাইমস/০৮সেপ্টেম্বর/প্রতিনিধি/ওআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিক্ষা এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :