দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ে গ্রেপ্তার হন সাবেক রেলমন্ত্রীর এপিএস, যেভাবে উত্থান তার

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ০৯ মে ২০২৪, ০৯:১৬

ঢাকার একটি আদালত চত্বর থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার হন প্রয়াত রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের এপিএস অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক তালুকদার। আইনি পেশার সঙ্গে যুক্ত ওমর ফারুক ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর গ্রেপ্তারের পর থেকে কারাগারেই আছেন। আলোচিত এই ঘটনার তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। তবে এখনও ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতিবেদন দেয়নি সংস্থাটি।

বুধবার সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। দুই নিখোঁজ জঙ্গিকে না পাওয়া পর্যন্ত মামলা শেষ করা যাচ্ছে না।’

পলাতক দুই জঙ্গির অবস্থান শনাক্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তাদের ধরার চেষ্টা চলছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার তদন্তে উঠে আসে দুবাইয়ের একটি নম্বর দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে কারাবন্দি অবস্থায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক। জঙ্গি ছিনতাই পরিকল্পনার পুরোটা জানতেন তিনি।

এদিকে আদালত চত্বর থেকে পুলিশকে মারধর করে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পিছিয়ে আগামী ১০ জুন ধার্য করেছেন আদালত। বুধবার শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাশেদুল আলমের আদালত এই তারিখ নির্ধারণ করেন। এদিন মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ছিল। তবে মামলার তদন্ত সংস্থা সিটিটিসি প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি। এজন্য বিচারক নতুন তারিখ ধার্য করেন।

২০২২ সালের ২০ নভেম্বর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতের প্রধান ফটকের সামনে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেল ও মইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নেন তাদের সঙ্গীরা। প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই দুই জঙ্গি আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য ছিলেন।

পরে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় সহায়তার অভিযোগ ওঠে আইনজীবী ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ওমর ফারুক একসময় প্রয়াত রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের এপিএস ছিলেন। ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল রাতে টাকার বস্তা নিয়ে বিজিবি সদর দপ্তরের গাড়িসহ ঢুকে যান ওমর ফারুক। সেসময় ঘটনাটি বেশ আলোচিত হলে এপিএসের পদ থেকে ওমর ফারুককে সরিয়ে দেন সুরঞ্জিত। এরপর তিনি আইনি পেশায় যুক্ত হন। বস্তাভর্তি টাকা উদ্ধারের ঘটনায় বেশ কিছুদিন কারাগারে ছিলেন ওমর ফারুক। সেসময় জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। বিয়েও করেন পলাতক জঙ্গি সোহেলের বোন তানজিলা আফরোজ জাহানকে। এটি ওমর ফারুকের দ্বিতীয় বিয়ে ছিল। সর্বশেষ তানজিলাকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের বাসায় থাকতেন তিনি।

সিটিটিসি বলছে, দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ছয় মাস আগে জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেলের স্ত্রী ফাতিমা তাসনিম শিখা কারাগারে তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করেন এবং এই পরিকল্পনার কথা জানেন। পরে বিষয়টি ওমর ফারুককে অবহিত করা হয়। ঘটনার দিন সকালে শিখাকে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আনেন ওমর ফারুক। শিখা, আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান আয়মান ও অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ঘটনাস্থলে থেকে পুরো বিষয়টি তদারকি করেন। আর জঙ্গি ছিনতাইয়ে ১০ থেকে ১৩ জন অংশ নেন। পরে পুলিশ শিখা, ওমর ফারুক, তার স্ত্রী তানজিলাকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য পায়।

গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন, জঙ্গিদের একাধিক মামলায় আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন ওমর ফারুক। এর মধ্যে রয়েছে জঙ্গি আলী আহসান ওসমান ও গুনভীর মামলাও। আইনজীবী পেশার আড়ালে তিনি জঙ্গিদের সহযোগিতা করেছেন। আদালত থেকে শ্যালক সোহেলকে ছিনিয়ে নিতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেন।

ঘটনার সঙ্গে ওমর ফারুকের সম্পৃক্ততার বিষয়ে সিটিটিসি প্রধান বলেন, জঙ্গি ছিনতাইয়ে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওমর ফারুক পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেলের বোনকে বিয়ে করেছেন। ঘটনার আগে-পরের প্রযুক্তিগত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ওমর ফারুক আবু সিদ্দিক সোহেল ও মোজাম্মেল হোসেনের স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলতেন। আদালত প্রাঙ্গণ থেকে এই দু্ই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সে অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

এদিকে ২০২২ সালের ৭ মে ওমর ফারুক নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে ঢাকাটাইমস। তখন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওমর ফারুকের বেশভূষাও বদলে গেছে। ক্লিন-শেভ চেহারা বদলে গেছে শ্মশ্রুতে। তাতে লেগেছে মেহেদির রঙও। নিয়োজিত আছেন আইন পেশাতে। ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে এনরোলমেন্ট হয় তার। সদস্য পদ পান পরের বছরের ২৪ মে।

যেভাবে উঠে আসেন ওমর ফারুক:

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলপথ নিয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় করেন ২০১১ সালে। দেশব্যাপী রেলপথ বিস্তৃত ও উন্নয়নের জন্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে দেওয়া হয়েছিল রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সুরঞ্জিত রেলমন্ত্রী হওয়ার পর ওমর ফারুককে তার এপিএস করে নেন। ওমর ফারুকের বাড়ি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সেলবরষ ইউনিয়নের হাওরপাড়ের মির্জাপুর গ্রামে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামের সাধারণ পরিবেশেই বড় হয়ে উঠেছেন ওমর ফারুক। পরিবারও ছিল স্বনামধন্য। তবে একপর্যায়ে পরিবারে আর্থিক অসচ্ছলতা দেখা দেওয়ায় ফারুক ঢাকায় এসে শুরুতে কারওয়ান বাজারে একটি রেস্টুরেন্টে এক হাজার ২০০ টাকা বেতনে চাকরি নেন। সে সময় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ছিলেন অনুকূল তালুকদার ডালটন।

অনুকূলের সঙ্গে পরিচয়ের পর একসময় দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। অনুকূল ২০০৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন যান। তখন তার জায়গা দখল নেন ওমর ফারুক। ধীরে ধীরে সুরঞ্জিতের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন তিনি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লা নির্বাচনি এলাকা থেকে বিজয়ী হন। পরে মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর ওমর ফারুক তার এপিএস হিসেবে নিয়োগ পান।

কী ঘটেছিল ওই রাতে বিজিবি গেটে?

২০১২ সালের ৯ এপ্রিল রাতের ঘটনা। হঠাৎ করেই একটি গাড়ি ঢুকে পড়ে বিজিবি সদর দপ্তরের ফটক দিয়ে। ওই গাড়িতে ছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলওয়ের কমান্ড্যান্ট এনামুল হক। গাড়িরচালক ছিলেন আজম খাঁন। ওই গাড়ি থেকে তখন উদ্ধার করা হয় একটি টাকার বস্তা। যেখানে ৭০ লাখ টাকা ছিল। অভিযোগ ওঠে, রেলওয়ের নিয়োগ বাণিজ্য থেকে এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি হয় ওই ঘটনায়। তুমুল সমালোচনার মুখে মন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন প্রয়াত রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এর আগে এপিএস পদ থেকে ওমর ফারুককে বরখাস্তও করেন তিনি।

গাড়িতে বস্তায় পাওয়া টাকার উৎসের খোঁজে নামে দুদক। অনুসন্ধানে ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়ায় ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট রমনা থানায় মামলা করে দুদক। মামলায় জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়। তদন্ত শেষে দুদক আইনের ২৭(১) ও ২৬(২) ধারায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক।

কারাদণ্ড হয়েছিল পাঁচ বছর:

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক মো. আতাউর রহমান এক রায়ে ওমর ফারুক তালুকদারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। সেই সঙ্গে, এক কোটি ২৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা অর্থদণ্ডও দেন আদালত। তার নামে থাকা ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি ফ্ল্যাট বাজেয়াপ্ত করারও আদেশ দিয়েছিলেন আদালত।

রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন ওমর ফারুক। ওই সময় তিনি জামিনে ছিলেন। কিন্তু রায় ঘোষণার পর সাজা পরোয়ানা জারি করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। পুলিশ তাকে কারাগারে নিয়ে যায়। পরে তিনি জামিনে ছাড়াও পান। ঢাকার মোহাম্মদপুরের যে ফ্ল্যাটটি বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত সেই ফ্ল্যাটেই চেম্বার করতেন ওমর ফারুক।

ঢাকাটাইমস/০৯মে/এসএস/ইএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :