কুকুরের জন্য ভালোবাসা!

পুত্রের বয়স দুই হতে আরো মাসখানেক মতো বাকি। তার প্রিয় প্রাণী এখন কুকুর। কখন পথ কুকুর ডেকে উঠে তার জন্যে দিনমান কান পেতে রয়। বাড়ির প্রধান ফটক গলে একটু বেরুলেই কুকুর দেখতে কোল থেকেই তার ইতিউতি চাউনি। না দেখতে পেলে মুখ ভার। আর দেখলে তো কথাই নেই। কাছে যাওয়ার জন্যে সেকি আকুলতা! আধো বুলিতে ‘কেউ, কেউ’, ‘আয়, আয়’ বলা।
প্রাণীকুল নিয়ে ছোটদের বইয়ে কুকুরের ছবিখানি তার জান। ছোটপর্দায় কুকুর দেখলে চোখ সরে না। ঢাকা শহরে আমরা একটা খেলনা কুকুর তালাশ করে মরছি। যেটা একটু নড়বে চড়বে, একটু ‘ঘেউ, ঘেউ’ করবে।
পথের কুকুর কিন্তু আমার না পছন্দের প্রাণী। রাতবিরেতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে তাড়া খাওয়ার অনেক ঘটনা আছে। আছে তাড়া দেয়ার ঘটনাও। একবার তো দুই কুকুরের ‘কাইজ্যা’র পর্যায়ে একটি আমার পায়ে পেছন থেকে পা নিয়ে আছড়ে পড়লো। জিন্স প্যান্ট বলে খুব একটা লাগেনি। তবু জলাতঙ্কের আতঙ্ক নিয়ে সে রাতেই মুঠোফোনে পরামর্শ নেই ঢাকা দক্ষিণের ভেটেরিনারি কর্মকর্তা বন্ধুস্থানীয় আজমত ভাইয়ের।
তিনি অভয় দিয়ে বলেন, স্যাভলন দিয়ে জায়গাটা একটু ধুয়ে দিলেই চলবে। তবু দিন কয়েক জলাতঙ্কের আতঙ্কে কেটেছে। কুকুরের কামড়ে, আঁচড়ে পেটে বাচ্চা আসার সেই কুসংস্কারও কী মনে একটু বাসা বাঁধেনি? শেষ পর্যন্ত আজমত ভাইয়ের অভয়বাণী অবশ্য বাস্তবতায় রূপ নিয়েছিলো।
ঢাকার মিরপুরের শেওড়াপাড়ায়ও নাকি রাতে বাড়ি ফিরতে কুকুর বিড়ম্ভনায় পড়তে হয়। বছর কয়েক আগে এমন কথা অনেকেই বলেছেন। এখন সেই পরিস্থিতি আছে কি না জানি না। তো পথের কুকুর নিয়ে এই সব বিরক্তি থাকলেও কেউ অযথা এই বোবা প্রাণীদের আঘাত করলে, নিষ্ঠুর আনন্দ করলে- আমি মেনে নিতে পারি না। তখন কিন্তু মায়াই লাগে।
সেখানে জলাতঙ্ক প্রতিরোধের নামে রাষ্ট্রের পয়সায় কুকুর নিধন কেন মানবেন কুকুরপ্রেমীরা। তাদের প্রতিরোধের মুখে বছর কয়েক ধরে ঢাকায় কুকুর নিধন বন্ধ। তবে কুকুর নিয়ন্ত্রণে সরকারি-অসরকারি যৌথ রসায়নে বন্ধ্যাকরণ কর্ম হাতে নেয়া হয়েছে। তার সুফল নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। কারণ ঢাকায় মানুষ, বাড়ি, গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে পথ কুকুরের সংখ্যা। জলাতঙ্ক প্রতিরোধের উপায় তবে কী?
চট্টগ্রাম শহরে অবশ্য এখনো নিধনযজ্ঞ আছে। তা থামাতে সম্প্রতি ঢাকার কুকুরপ্রেমীরা রাজধানীর রাজপথ প্রকম্পিত করেছে। সার্ক ফোয়ারার চারিদিকে নাকি সেদিন কয়েকশো মানুষ দাঁড়িয়ে যায়। সুখপাঠ্য পোস্টার হাতে তাদের মানবন্ধন যথেষ্ট আওয়াজই করতে পেরেছে। তাদের দেখাদেখি চট্টগ্রাম থেকেও নিধন প্রতিরোধে সচিত্র কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
ঢাকার সেই মানববন্ধনের ঠিক তিন দিনের মাথায় ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম দেয় আরেক খবর। ৩০ জানুয়ারি বিকেলে তাদের খবর- ‘চাঁদপুরে কুকুরের কামড়ে ১৮ জন জখম’। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে তাতে বলা হয়েছে, সেই দিন সকাল আটটা থেকে ১২টার মধ্যে সাত অথবা আটটি পাগলা কুকুর মতলব পৌরসভার পাশাপাশি আটটি এলাকার লোকজনকে এলোপাতাড়ি কামড়াতে থাকে। এতে ১৮ ব্যাক্তি মারাত্মক আহত হন।
গত এক যুগে মাধ্যম মহাজনরা যেসব জ্ঞান দিয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কুকুর মানুষকে কামড়ানোর বিষয়টি আর খবর নয়। খবর হচ্ছে, কোনো মানুষ যদি কুকুরকে কামড়ায়। তবে আহতের সংখ্যা যখন ১৮ তখন মহাজনরা নিশ্চয় বিবেচনায় নিবেন।
যাই হোক, কুকুরের কাজ কুকুর করেছে। ‘‘তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে/ মানুষের শোভা পায়?’’- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, উত্তম ও অধম।
কুকুর নিধনকারী প্রশাসন উত্তম না অধম সেই আলাপে আমরা যাচ্ছি না। তারাও আসলে উভয় সংকটে আছে। কারণ সড়কের একদিকে কুকুরপ্রেমী। আর দিকে জলাতঙ্ক আতঙ্কে থাকা পথচারী। কোন কুল রক্ষা করবে নগর প্রশাসন?
ইউরোপ-আমেরিকায় অবশ্য কুকুর প্রেম বহু আগেই মানবপ্রেম ছাপিয়ে গেছে। কুকুরের সঙ্গে বসবাস, প্রিয় কুকুরকে সয়সম্পত্তি লিখে দেয়া- আরো কত না কা- আছে তাদের।
আমাদের দেশে ‘কুত্তার বাচ্চা’ খুব ভালো বুলি নয়। ‘কুত্তা’ সুধালে কুকুরও নাকি মাইন্ড করে, নাটকে এমন রসিকতাও আমরা দেখেছি। মানুষকে খেপিয়ে তুলতে ‘কুত্তার লেজে আগুন ধরিয়ে দেয়া’র মতো উপমার বিস্তর ব্যবহার আছে। যতো পথ ধরেই বুঝান না কেন, ‘কুকুরের লেজ নাকি কখনো সোজা হয় না’।
রম্যবিদ, কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের প্রকাশিত না অপ্রকাশিত একটা লেখায় কুকুরের লেজ নিয়ে বোধোহয় একটা কৌতুক পড়েছিলাম। প্রশ্নোত্তর আকারে তা তুলে দিচ্ছি।
- কুকুর উপরদিকে লেজ নাড়ে কেন?
- জনতা আর ভবনের ভিড়ে ঢাকা শহর ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। নগরবিদরা তাই ঢাকা শহর উপরদিকে বাড়াতে বলছেন। কুকুর জায়গা বাঁচাতেই উপর-নিচে লেজ নাড়ে!
ঘিঞ্জি শহরে কুকুর উপর-নিচেই লেজ নাড়ুক।
তায়েব মিল্লাত হোসেন : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

মন্তব্য করুন