সবাই বিদেশ গেলে দেশে থাকবে কারা?

শেখ আদনান ফাহাদ
  প্রকাশিত : ১০ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৯:০৬
অ- অ+

রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সফল হলেও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের লড়াই চলছে। স্বাধীন বাংলাদেশেও রক্তপাত কম হয়নি। বলা যেতে পারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদ নিয়ে খুব একটা আসেনি। এরপরেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রযন্ত্র কাজ করছে, দারিদ্রের হার কমছে, শিক্ষার হার বাড়ছে (যদিও শিক্ষার কার্যকারিতা নিয়ে অনেক যুক্তিসংগত বিতর্ক আছে), নারী ও শিশু স্বাস্থ্য পরিস্থিতি দিন দিন ভালো হচ্ছে। দেশের জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে কৃষক ও কৃষি বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় খাদ্য উৎপাদন বেড়ে আত্মনির্ভরশীলতার পর্যায়ে পৌঁছেছে, ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আর সুশাসনের অভাব থাকলেও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। সরকারি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচার হয়ে গেলেও ব্যাংক রিজার্ভ বাড়ছে। ব্যাংক রিজার্ভে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই আমাদের অবস্থান। দেশের ক্রমবর্ধমান রপ্তানি, ক্রমহ্রাসমান আমদানি, এবং প্রবাসে নানাবিধ শ্রম ও মেধাসাধ্য কাজ করা বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থ এই দারুণ অর্জনের নেপথ্য কারণ হিসেবে কাজ করছে। তবে আজকের লেখার বিষয় বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নয়। প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সও আলোচনার বিষয় নয়।

আজ কথা বলব তাদের বিষয়ে যারা এদেশে থেকে যেতে পারতেন, কিন্তু নানা কারণে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। প্রথমে নিজে যান, তারপর একে একে বউ, বাচ্চা, মা-বাবা, এমনকি ভাইবোন পর্যন্ত নিয়ে যান। একপর্যায়ে দেশই হয়ে যায় তাদের বিদেশ আর বিদেশ হয়ে যায় দেশ! ফলে এধরনের প্রবাসীদের কাছ থেকে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরাসরি তেমন কোন সার্ভিস পান না। আমাদের ছেলে-মেয়েদের মেধা, দক্ষতা এভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যায়, যাকে ইংরেজিতে বলে ব্রেইন ড্রেইন বা বাংলায় মেধা পাচার।শুধু কি মেধারপাচার? প্রাচারের প্রক্রিয়ার পাশাপাশি দেশ থেকে কত অর্থও যে পাচার হয় তার হিসেব কে কখন করেছে? আরেকধরনের মাইগ্রেশন হয়ে থাকে, যেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং বিশেষ একটি ধর্মের মানুষের কথা আসবে। কি কি কারণে এদেশে পড়াশুনা করে, এদেশেই অর্জিত নানা সনদ, দক্ষতার শক্তিতে তারা দূরদেশে চলে যান? এদেশের রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ, ব্যবস্থা কেন তার অনেক দক্ষ ও কর্মক্ষম মানুষকে ধরে রাখতে পারেনা? দোষ কি শুধু রাষ্ট্রের নাকি মানুষের মনোজগতের উপনিবেশও এর জন্য দায়ী? বিশ্ব ব্যাংকের এক হিসেবে, বিশ্বের নানা প্রান্তে কাজ করা বৈধ বাংলাদেশীরা ২০১৫ সালে দেশে ১৫ বিলিয়ন (ইউএসডি) ডলার রেমিট্যান্স প্রেরণ করেছেন। এই বিশাল অঙ্কের রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে একেবারে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া বা পরিবারসমেত প্রস্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন মানুষদের অবদান যে নগণ্য সে কথা বলা বাহুল্য।কোন গবেষণা না করেই বলা যায়, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, মালয়েশিয়া, এমনকি যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইরাক, লিবিয়ায় কাজ করা অদক্ষ, সেমি-দক্ষ ও দক্ষ শ্রমিকদের রক্ত পানি করা শ্রমের বিনিময়ে বিশাল অঙ্কের রেমিট্যান্স আসছে বাংলাদেশে। এসব দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে বাংলাদেশর রেমিটেন্স প্রবাহ। অন্যদিকে ইউরোপের নানা দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমাদের কাছের জাপান, সাউথ কোরিয়া, চীন ও, অস্ট্রেলিয়াতে বসবাসকারী শিক্ষিত কিন্ত দেশান্তরী বাংলাদেশীদের অবদান নিতান্তই কম। মধ্যপ্রাচ্য কিংবা মালয়েশিয়াতে কর্মরত প্রবাসীদের সিংহভাগই এদেশের মাঠে-ঘাটে, বাজারে, স্কুল-মাদ্রাসায় সামান্য পড়াশুনা করা তরুণ সমাজ। এই শ্রমিকদের প্রায় সবাই অত্যন্ত পরিশ্রম করে, কষ্ট ভোগ করে এই অর্থ উপার্জন করেন। নিজে এক/দু বেলা কোনমতে খেয়ে, কম ঘুমিয়ে, পরিবার ও দেশের জন্য মহামূল্যবান অর্থ প্রেরন করেন। এই গরীব মানুষদের প্রেরিত অর্থ দিয়ে এদেশের অনেক শিক্ষিত মানুষের রুটি-রুজিরও ব্যবস্থা হয়। অথচ, এরাই যখন আবার দেশে ফিরে আসেন তখন যন্ত্রণার শেষ থাকেনা। বিমানবন্দর থেকেই শুরু হয় তাদের নতুন কষ্টের। যাইহোক তাদের কথায় আসি, যারা দেশ ছেড়ে চলে যান, আর আসার ইচ্ছে পোষণ করেন না। যদিও অনেকে ফিরে আসেন।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অফিসিয়াল মিডিয়া টিমের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন কাভার করতে গিয়ে দারুন এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস যেন আমাদের যাদুর শহর ঢাকার শাহবাগের রুপ ধারণ করেন। ঢাকার সাংবাদিক, লেখক, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদদের আড্ডাস্থলে রূপান্তরিত হয় পুরো জ্যাকসন হাইটস এরিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য শহরে বসবাস করা দেশ ছেড়ে যাওয়া সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরাও এসে নিউইয়র্কের বিভিন্ন স্থানে প্রধানমন্ত্রীর সফরকালীন সময়টা থাকার চেষ্টা করেন। একদিন সন্ধ্যার ঘটনা। আড্ডা মারছি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। দেখলাম কোট-টাই পড়া একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে। আমি আসলে তাকিয়ে ছিলাম তার সাথেই হেঁটে চলা লাল শাড়িপড়া মেয়েটির দিকে। একেবারে যেন আমাদের দেশের সদ্য বিয়ের পিঁড়িতে বসা কোন মেয়ে। মার্কিন মুল্লুকে এমন বাংলাদেশী স্টাইলে শাড়ীপড়াবউ দেখে মনে পড়ে গিয়েছিল দেশে অপেক্ষা করা আমার প্রেয়সীর কথা! ছেলেটির হেঁটে চলার স্টাইল দেখে আমার ঢাকা কলেজের এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। পেছন থেকে দেখতে আমার সেই বন্ধুটির মত, যার পেস বল কলেজের শক্ত পিচে আমরা কেউই খেলতে পারতাম না। বুকটা কেমন করে উঠল, আমি কী ভেবে প্রায় দৌড়ে গিয়ে নাম ধরে ডাকলাম! ছেলেটিও সাথে সাথে ফিরে তাকাল! আরে! এতো সত্যি সত্যি আমার সেই বন্ধু, আরিফ!!! দুজন দুজন জড়িয়ে ধরলাম। নতুন বউটি ততক্ষণে যেন একটু বিরক্ত হতে শুরু করল!গুনে গুনে দেখলাম প্রায় ৮ বছর পর দোস্তের সাথে আমার মোলাকাত।সেই বন্ধু আজ একটা মেয়ের বাবা।

বন্ধুটি বদন কিতাবে প্রায় প্রতিদিনই মেয়ের, অর্ধাঙ্গিনীর ছবি দেয়। ছবিতে তার পরিশ্রমের আভাস পাওয়া না গেলেও, দেখা যায় সুন্দর, ফাঁকা, পরিষ্কার ফুটপাথে, লনে, পার্কে, শপিং মলে, বাগানে, রাস্তায় বন্ধুর মেয়ে খেলা করছে আর জামাই-বউ দুজন সে বিস্ময়কর দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে সুখের ভেলায় ভেসে যাচ্ছে! আমি তাকে সেদিন বদন কিতাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম-“আমাদের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা কেন দেশ ছেড়ে চলে যায়?” সে যা লিখেছে, তা তুলে দিলাম। “মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়াতে যারা যায় তাদের খুব বড় অংশ যায় কাজের উপর ভিসা নিয়ে। অর্থাৎ উনাদেরকে বিভিন্ন কোম্পানী তাদের কাজের জন্য স্পন্সর করে নিয়ে যায়।আসলে ওখানে থাকার সুযোগটা একেবারে নাই বললেই চলে। এছাড়া যে পরিমাণ পরিশ্রম তাদের করতে হয় সেক্ষেত্রে থাকার আগ্রহটাও কমে যায় যা একরকম পালিয়ে বাঁচার মত।উন্নত বিশ্বে যাওয়াটা খুব সহজ প্রক্রিয়া না।যারা মেধার বিনিময়ে আসে তাদের বেশীর ভাগই থেকে যায় নিজেদের মেধার সর্বোচ্চ বিকাশের জন্য। যেমন যার যোগ্যতা আছে নাসায় জব করার বা এরোপ্লেন বানানোর সে বাংলাদেশে যেয়ে মোটরসাইকেল বানিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারবেনা এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।আমারমত যারা খয়রাতি ভিসায় এসেছে তাদের মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী ভাইদের মত কঠিন জীবন যাপন করতে হয় না। যার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই জীবনটাকে গড়ে নিতে পারে।কোন মামা খালু বা চাচার দরকার হয়না। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপদ এবং অপার সম্ভাবনাময় জীবন।যারা ইমিগ্র্যান্ট হয়ে আসে তাদের আসার আগে থেকেই মাইন্ড সেটআপ থাকে পাড়ি জমানোর।যে অংশ অনেক টাকা পয়সা খরচ করে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আসে তাদের মূল উদ্দেশ্য যতটা না পড়ালেখা তার চেয়ে বেশী হচ্ছে টাকা কামানো এবং কোনোভাবে সেটেল হয়ে যাওয়া।সব কিছুর মূলে টাকাটা প্রধান বিষয়। এদের মাঝে অনেকেই বাংলাদেশে থেকেও বিভিন্নরকমের প্রতিষ্ঠান বা নতুন নতুন ব্যবসা চালু করতে পারে। কিন্তু আসল কথা হলো উদ্যোক্তা সবাই হতে পারেনা।বাংলাদেশকে আমরা যতই অনিরাপদ বলি না কেন ১৬ কোটি মানুষ কিন্তু দিব্যি দিন কাটাচ্ছে। সো নিরাপত্তা খুব বড় ইস্যু না যতটা মুখে বলা হয়। সিস্টেমেটিক কিছু পরিবর্তন আসলে বাংলাদেশের চেয়ে ভাল জায়গা পৃথিবীর আর কোথাও নেই‍! মানবসম্পদ যে খুব কমে যায় তা কিন্তু পুরোপুরি সত্য না। যে যেখানেই থাকুক তারা কিন্তু প্রতিনিয়ত দেশকে সেবা করে যাচ্ছে যার অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব। বাংলাদেশে থাকলেই দেশপ্রেমিক আর বিদেশে থাকলে দেশপ্রেম কম এই ধারণারও পরিবর্তন দরকার। দেশে থেকে হাজার কোটি টাকা চুরি করা বা সীমাহীন অন্যায় কাজ করার চেয়ে বিদেশে বসে নিজের পরিবারের অবস্থার পরিবর্তন করাটাই অধিক দেশপ্রেমেরকাজ”।

কী সহজ কিন্তু সত্য কথায় আমার বন্ধু একটা ছোট প্রশ্নের কী সামগ্রিক উত্তর দিয়ে দিল। খয়রাতি ভিসা বলতে সে সম্ভবত ‘ডিভি লটারি’কে বুঝিয়েছে। যে কাজই করুক না কেন, উন্নত বিশ্বের শহরে একজন বাসিন্দা যে পরিমাণ শান্তি, আত্মসন্মান নিয়ে, আরামের সাথে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে, আমাদের ঢাকায় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও কি সেটা পারে? শারীরিক প্রতিবন্ধীরা যেভাবে নিশ্চিন্তে উন্নত বিশ্বের শহরে চলাফেরা করতে পারে, ঢাকায় আমরা সুস্থ মানুষই কি সেভাবে পারি? ঘণ্টার ঘণ্টার পর জ্যামে আটকে থাকা, বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়ার পারিবারিক-সামাজিক চাপ, দুর্নীতিবাজ আর বিত্তশালীদের সামাজিক মূল্যায়ন, কালো টাকার ছড়াছড়ির বাংলাদেশে আসলেই কি সবার সৌভাগ্য হয় একটা ভালো জীবনের মালিক হওয়ার? কত মেধাবী এদেশ থেকে চলে যায় শুধু কাজের সুযোগ আর “ভালো” জীবনধারণের খরচ মেটাতে সক্ষম এমন বেতন-ভাতার অভাবে।

বদন কিতাবে আমার প্রশ্ন দেখে একজন একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে গোপনে লিখেছেন, “দেশ ত্যাগের প্রধান কারণ দেশের প্রতি অভিমান। কারণ যা হবার তা এখানে হয় না। যা না হবার তা-ই এখানে ঘটে এবং ঘটা করেই ঘটে। ত্যাগ-তিতিক্ষা আর দু:সময়কে এদেশের মানুষ ভুলে যেতে পছন্দ করে। তাই অবমূল্যায়ণের গ্লানি নিয়ে শিক্ষিত, স্বাবলম্বী উন্নত মানসিকতাসম্পন্ন এক শ্রেণির ভালো মানুষ এদেশে থাকতে চান না,”। অত্যন্ত সামাজিক এবং মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন এই জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কথায় দেশের আমলাতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকৃত চিত্রই ফুটে উঠে। শুধু নিজের এবং সৃষ্টিকর্তার উপর ভিত্তি করে এদেশে যে চাকরি মেলেনা, তার প্রমাণ তো প্রতিটি ঘরে ঘরে। ধর্ম আর অসততার অস্তিত্ব যেন একই সত্ত্বার সওয়ারি। চাকরি নিতে ঘুষ, পেনশনের টাকা তুলতে পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়! এমন আত্মঘাতি এবং সম্মানবোধহীন সমাজে একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ কেন থাকতে চাইবে?

বদন কিতাবে আমার এক বন্ধু আছেন, নাম তার সাইফুল এ পলাশ। অত্যন্ত রাজনীতি ও সমাজ সচেতন এই তরুণ দেশ ছেড়ে যাওয়ার কারণ গুলো আমাদের জানাতে চেষ্টা করেছেন। তিনি যে কারণগুলো লিখেছেন, সে গুলো হলঃ “ ১। সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ২। নোংরা রাজনীতি ৩। অনেকের দেশত্ববোধের অভাব ৪। দেশে অবৈধ উপায়ে টাকা কামাই করে তা দিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা ৫। বিচারহীনতার প্রভাব ৬। প্রকৃত মেধাবীদের মূল্যায়ন না হওয়া ৭। শিক্ষার মানের অবনতি এবং সময়োপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা না করা ৮। উন্নত জীবন ব্যবস্থার স্বপ্ন ইত্যাদি”।

আমাদের রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের দুর্নীতিপ্রিয় অংশের যদি লজ্জাবোধ থাকে, তাহলে পলাশের এই কথাগুলো জানলে তারা নিশ্চয়ই লজ্জা পাবেন। তবে এই কাঙ্ক্ষিত লজ্জাবোধ তাদের কখনো হবে বলে আমার মনে হয়না। দেশের এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি একটা অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতিপরায়ণ আমলা এবং রাজনীতিবিদদের রাজনীতিতে আসার এবং কয়েক বছরের পরের জীবনের হিসেব মেলালেই আশা করি আমার বক্তব্যের সত্যতা পেয়ে যাবেন। দুর্বল নানা প্রতিষ্ঠানে ভরা বাংলাদেশে গণমাধ্যম হতে পারত রাষ্ট্রের কার্যকর চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু সেটা হতে পেরেছে কই? বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম আর এর কর্মীরাও যে সিস্টেমের অংশ হয়ে গেছেন। তারাও যে আজ লোভ আর ভোগবাদের অনুগত এবং বিশ্বস্ত দাসে পরিণত হয়েছেন।

আমার আবেগী ছাত্র আব্দুল্লাহ শুভ প্রাতঃস্মরণীয় লেখক আহমদ ছফার এক মহা মূল্যবান কথা উল্লেখ করে লিখেছে, “ আহমেদ ছফার মতে, এদেশে উচ্চবিত্তরা থাকে করুণা করে। তার বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি একমত নাহলেও একেবারে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। বৃষ্টি হলে, এদেশের শহরের মাটিগুলা কাঁদাহয়ে একটা পঁচা গন্ধ ছড়ায়। এটা উনারা সহ্য করতে পারেননা। বিদেশের শহরের মাটির গন্ধ আতর-আতর । আতরের গন্ধের টানে এদেশের জন্য উচ্চবিত্তদের করুণার বাক্স একসময় খালি হয়ে যায়। তারপর কেটে পরে।সাধারণ মানুষদের নিরাপত্তার অভাব বাংলাদেশে কখনোই ছিল না যতটানা আমাদের বোঝানোহয় মিডিয়া দ্বারা। নিরাপত্তার অভাব তারাই বেশী বোধ করে যাদের ঘাপলা আছে। ঘাপলার কারণে দেশত্যাগ করে।অবৈধ টাকা পাচার করে। তারপর একসময় সে টাকার টানে দেশে থাকতে পারেনা। দেশের মাটি ছেড়ে, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে আজীবনের জন্য দেশত্যাগ করা সহজ কথানা। এরা নিজেদেরকে সেই লেভেলে নিয়ে গেছে যে লেভেলে গেলে নিজবাদে অন্য সব ছাই। আরও কারণ কাছে। অনেককারণ । শেকড় নিয়ে,রক্ত নিয়ে গবেষণা করতে হবে,”।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমার এক বাংলাদেশী বন্ধু আর অস্ট্রেলিয়ায় সেটল হওয়া আমার ঢাকা কলেজের এক ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা দেশ ছেড়ে চলে গেলে কেন? তারা যে জবাব দিয়েছে তার সারকথা হল, উন্নত জীবনের আশায় তারা দেশ ছেড়ে গেছেন এবং ভালোই আছেন।আমার আরেক বন্ধু সিরাজুল ইসলাম আমাকে লিখেছে, “ সত্যিকথাই বলেছ! কেন চলে যায়? আমিও ভাবছি জানুয়ারী মাসে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চলে আসবো এই সূর্য্য উদয়ের দেশে। অনেক কষ্ট হয় কথাটা মনে হলে। কি আর করবো? দুইবার BCS ভাইভা দিলাম কিন্তু চাকুরী হলোনা। কত ব্যাংকেও ভাইভা দিলাম।কিছুই হলো না জীবনে। চলে আসলাম প্রবাসে। সত্যি মাতৃভুমির জন্য অনেক কষ্টহয়” বন্ধুর এই কষ্টের অনুভূতির জবাবে বলেছি, “মন খারাপ করোনা বন্ধু। চালিয়ে যাও”। অন্য কিছু বলার বা কিছু করার তাওফিক কিংবা তাকত কোনটাই আমার নেই।

১৯৭১ সালে আমাদের অনেক কষ্ট যারা ভাগ করে নিয়েছিলেন সেই অনেক ভারতবাসীর একজন আমার প্রাণের ভাই, আগরতলার সমরজিৎ কানুনগো। তিনি লিখেছেন, “মাটির টান ব্যাপারটা সাংঘাতিক । কেউ ইচ্ছে করে দেশ ছাড়েনা । অনেক কারণ থাকে । কিছুটা রুটি রোজগারের সুবিধা , উপযুক্ত মেয়ের পাত্র পাওয়া , ধর্মের জিগীর , ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা ।প্রতিবেশীদের ব্যবহার, রাজনৈতিক টানাপড়েন, হয়তো অন্যদেশে কোন সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে ...”। ‘ধর্মেরজিগির’ বলে সমরজিৎ দাদা আবার আলোচনা অন্যদিকে নিয়ে গেলেন। সাম্প্রদায়িক কারণে এদেশ থেকে একদল আবার বিদেশে চলে যায়। তাদের চলে যাওয়াটা খুবই দুঃখজনক, সেটা নানা দিক থেকেই। অনেকে আসলেই অত্যাচারিত হয়ে দেশ ছাড়েন, অনেকে আবার মনোজগতের অহেতুক ভয় কিংবা অস্তিত্ব সংকটের জন্য দেশ ছাড়েন। অনেকে আছেনএদেশে ব্যবসাবাণিজ্য করেন, লাভের টাকা বিদেশেপাচার করেন। অনেকে চাকরি করেন এদেশে। যতদিন চাকরী করেন, ততদিনভালো থাকেন। যখনি বেনেফিটের টাকা পেয়ে যান, তখন সুযোগ বুঝে কাছের কোন বিদেশে পাড়ি জমান। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখলে বিষয়টা দুই দিক থেকেই দুঃখজনক। এদেশে হিন্দুদের উপর যে অত্যাচার হয়, তার সবগুলো অত্যাচারই মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষের উপর হয়। বিচারের জন্য আইন-আদালত পুলিশ থাকলেও অনেকে সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে বাংলাদেশ থেকে চলে যান। অত্যাচারী আর অত্যাচারিতের, বিচার আর অবিচারের বিষয় প্রাধান্য না পেয়ে প্রধান হয়ে উঠে ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতা।

এখন প্রশ্ন হল, এভাবে দেশ থেকে যদি দক্ষ ও কর্মক্ষম জন শক্তি উন্নত জীবনের টানে, কর্মসংস্থানের অভাবে, দেশের সিস্টেমের প্রতি বিরক্ত হয়ে, কিংবা দেশপ্রেমের অভাবে বা আত্মবিশ্বাসের অভাবে বা সাম্প্রদায়িকতার জন্য, যেকারণেই হোক না কেন, দেশ ছেড়ে যদি চলে যেতে থাকে তাহলে দেশে থাকবে কারা? এদেশের কৃষক-শ্রমিকের পরিশ্রমে, কোন কোন রাজনীতিবিদের স্বপ্ন ও দূরদর্শিতায়, অদম্য অনেকতরুণ-তরুণীর মেধায় দেশ হয়তো টিকে আছে বাএগুচ্ছে। কিন্তু দেশ থেকে যদি অতিমেধাবী বা অতিদক্ষজন শক্তি চলে যায়, তাহলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে কি? দেশটাকে কিছু লুটেরার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে ভালো থাকলে কোনদিন আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবেনা।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আজ থেকে দেশে স্বর্ণ বিক্রি হবে নতুন দামে
উত্তরায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ওপর উঠে গেল ট্রাক, নিহত ৩
ফরিদপুরে ১১৪ বোতল ফেন্সিডিলসহ দুই মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে রিভিউ আবেদনের আদেশ স্থগিত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা