অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-১৩

সাপ্তাহিক জনকথায় থাকাকালেই শিল্প ঋণ সংস্থার জনসংযোগ বিভাগের এজিএম আলী নূর ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছিলো, পুরো নাম সম্ভবত শামসুল হক আলী নূর। তিনি পেশায় সাংবাদিক ছিলেন, পেশাগত বহুমুখী অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ একজন মানুষ। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় চারটি ছাড়া বাকি পত্রিকা বন্ধ করে দেবার কারণে বেকার হয়ে পড়া যে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সরকারি সংস্থায় চাকরি দেয়া হয়েছে তাদেরই একজন শামসুল হক আলী নূর। তিনি ছিলেন বরিশালের লোক এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের আত্মীয়। খুবই উদার মানুষ ছিলেন আলী নূর ভাই। সরকারি সংস্থায় চাকরি করা সত্ত্বেও তিনি আসলে অন্যকে সহায়তা করাসহ সাংবাদিকতার অন্যান্য ইতিবাচক প্রবণতার বাইরে যেতে পারেননি অথবা যাননি। সমাজ-দেশ-রাজনীতি নিয়ে সক্রিয়ভাবে ভাবতেন।
সাপ্তাহিক জনতার ডাক-এর পুরো বিষয়টি আলী নূর ভাইকে বিস্তারিত বললাম। তিনি বললেন, বিকেল পর্যন্ত থাকেন; এক জায়গায় নিয়ে যাবো। তিনি চাচ্ছিলেন না, সি গ্রেড পত্রিকায় আমি কাজ করি। নিদেন পক্ষে এমন পত্রিকায় যুক্ত হই যেখানে নেতৃত্বে পেশাদার সাংবাদিক রয়েছেন।
তখন শিল্পঋণ সংস্থার অফিস ছিল আজকের বিআইডব্লিউটিএ ভবনে। দেশের শিল্পে পুঁজির যোগান ও পরামর্শ দেবার জন্য শিল্প ব্যাংক ও শিল্পঋণ সংস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অর্থে সামরিক শাসকদের রাজনৈতিক দল দাঁড় করাবার প্রক্রিয়ায় অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতোই এ সংস্থা দুটিও মূল লক্ষ্য থেকে অনেক দূর সরে গেছে। এর পর হয়ে গেছে সাধারণ ব্যাংক; সুনীলের কবিতায় অরুনার বুকে কেবলই মাংসের গন্ধের মতো!
শিল্পঋণ সংস্থার কাছেই ফকিরাপুলের দোতলায় একটি অফিসে আমাকে নিয়ে গেলেন আলী নূর ভাই। মাঝারি সাইজের লম্বা একটি রুম। দুই দিকে ছোট ছোট টেবিল, মাঝ দিয়ে চলার পথ। শেষ মাথায় একটু বড় টেবিল নিয়ে বসা ব্যক্তির সামনে গিয়ে আমরা বসলাম, তিনি সাপ্তাহিক রিপোর্টার-এর মালিক ও সম্পাদক। কোনো রকম ভূমিকা ছাড়াই আলী নূর ভাই বললেন, এরশাদ ভাই আলম আমার ছোট ভাইর মতো; ওর একটা প্রফেশনাল হাউজ দরকার। এরশাদ মজুমদার চশমার উপর দিয়ে প্রায় পনেরো সেকেন্ড আমাকে পর্যবেক্ষণ করলেন। এর পর আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন, একেবারেই মামুলি বিষয়ে। সঙ্গে চা-বিস্কুটে আপ্যায়ন। প্রায় আধাঘণ্টা পর একটু দূরে বসা এক জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মোজাম্মেল দেখতো একে দিয়ে তোমার চলে কিনা? মোজাম্মেল, মানে খন্দকার মোজাম্মেল হক ছিলেন সহকারী সম্পাদক, পত্রিকার দ্বিতীয় ব্যক্তি। আমি মোজাম্মেল ভাইর কাছে গেলাম। তিনিও মামুলি বিষয়ে কথা বললেন। তিনিও পেশাগত কোন বিষয়ের ধারদিয়েও গেলেন না। মিনিট দশেক পর বললেন, কাল বারোটার দিকে আসেন, পারলে আপনার লেখা ছাপা হওয়া কয়েকটা পত্রিকা নিয়ে আসবেন।
গভীর রাত ধরে নানা বিবেচনায় আমার লেখা ও রিপোর্ট ছাপা হওয়া একগাদা পত্রিকা বাছাই করলাম, বাকি রাত কেটেছে অনেকটা নির্ঘুম। বেলা বারোটার আগেই ফকিরাপুলে সাপ্তাহিক রিপোর্টার অফিসে হাজির হই। মোজাম্মেল ভাই আগেই ছিলেন। অতি বিনয়ের সঙ্গে সালাম দিয়ে তার সামনে বসলাম। পত্রিকার কপিগুলো রাখলাম তার টেবিলে হীরক খ- রাখার সাবধানতায়; এর আগে এগুলো পড়েছিলো খাটের নিচে। প্রয়োজনের সময় ফেলনা জিনিসও হয়ে যায় মহামূল্যবান। কিন্তু কয়লা থেকে হীরক হয়ে ওঠা আমার মহামূল্যবান বস্তুর দিকে এক ঝলক তাকালেনও না, ওলটপালট করে দেখা তো দূরে বিষয়; তার আচরণে আমি খুবই হতাশ হলাম। মনে হলো, আমার অনেক গবেষণা আর রাত জাগার কষ্ট মাঠে মারা গেছে; আমাকে আসলে নেবে না!
এটা ভেবে একটু বেখেয়াল হয়েছি তখন শুনলাম মোজাম্মেল ভাই বললেন, শফিক ওই টেবিলটা রেডি করো। এর পর মোজাম্মেল ভাই তার কাজে মনোনিবেশ করলেন, আমি অতি নীরিহ মফিজের মতো তার সামনেই বসে থাকলাম। আরো পাঁচ-সাত মিনিট অসহ্য নীরবতার পর যখন বিদায় নেবার কথা ভাবছি তখন মোজাম্মেল ভাই বললেন, যান ওই টেবিলে বসেন। অফিস সহকারী শফিক বললো, আসেন স্যার। আমার বসার স্থান হলো মোজাম্মেল ভাইয়ের টেবিলের উল্টো দিকে। শফিক একটু ঝুঁকে বললো, এখানের স্যাররা খুব ভালো। চা লাগলে আমাকে বলবেন; এখন একটু চা দেই? আমার অনুমতির অপেক্ষা না করেই সে চা বানাতে চলে গেলো। চা পানের স্বস্তিতে ভাবলাম, কেউ আমার সঙ্গে কোন কথা বলে না কেন! এদিকে আর একটি ভাবনায় পেয়ে বসলো। তা হচ্ছে, চাকরি তো হলো; কিন্তু বসের মুখোমুখি বসা তো ঝামেলার, কখন কোন বেয়াদবি হয়ে যায়। এজন্যই বলা হয়, বসের সামনে ও ঘোড়ার পিছনে থাকতে নেই। কিন্তু আমাকে তো বসতেই হবে বসের সামনে। এদিকে নাজিউর রহমান মঞ্জুর বলতেন, মাজারেও বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না; তাতে হঠাৎ বেয়াদবি হয়ে যেতে পারে।
শেষ বিকেলে সম্পাদক সাহেব বললেন, মোজাম্মেল আমি প্রেসক্লাবে যাচ্ছি, আজ আর আসবো না। আমাকে বললেন, তোমার সঙ্গে কাল কথা বলবো। আমি দাঁড়ালাম। সম্পাদক বললেন, আমাকে দেখলে কখনো দাঁড়াবে না! অনেক বছর পর একই রকমের একই কথা বলেছেন সম্পাদক শফিক রেহমানও।
এরশাদ ভাই চলে যাবার পর আমার টেবিলে আসলো এতক্ষণ নীরবে কাজে নিমগ্ন থাকা খোরশেদ আলম, মোজাম্মেল হক খোকন, আহমেদ কামালসহ আরো দুজন। তারা খুবই আন্তরিকভাবে আমাকে স্বাগত জানালো। এবার বুঝলাম, অফিস সহকারী শফিকের কথাই ঠিক। সঙ্গে আর একটি বিষয় বুঝেছি, কোন রকম উচ্চস্বরে কথা না বলেও সাংবাদিকদের নীরবে কাজ করাবার একটি কৌশল আছে। এ ক্ষেতে অমার দেখা প্রথম ব্যক্তি এরশাদ মজুমদার। সেই কৌশল এখন মিডিয়ার অনুকরণীয় হয়ে গেছে। অনেক টেলিভিশন তো নিউজ রুম ও নিউজ স্টুডিওর মধ্যে দেয়ালই তুলে দিয়েছে। যে কারণে এ টেলিভিশনের নিউজ রুমে পিন পতনেরও সুযোগ নেই। উচ্চস্বরে কথা বলা তো অনেক দূরের বিষয়! যে সময় পত্রিকার অফিস ছিল অনেকটাই আড্ডাখানা সেই সময় নীরবে কাজ করার বিষয়টি সাপ্তাহিক রিপোর্টার সম্পাদক এরশাদ মজুমদার সূচনা করেছিলেন ১৯৮৩ সালে। শুধু তাই নয়, নিউজ এজেন্সির ধারণা বাস্তবায়ন করার কথা ভাবতেন এরশাদ ভাই।
সাপ্তাহিক রিপোর্টারে আমার প্রথম দিন কাটলো সহকর্মীদের সঙ্গে মামুলি গল্প করে তাদের কাজের ফাঁকে। দ্বিতীয় দিনে বেলা বারোটার পর এলেন সম্পাদক। তিনি নিজের টেবিলে যাবার আগেই মোজাম্মেল ভাইকে বললেন, কি মনে হয় তোমার? মোজাম্মেল ভাই সংক্ষেপে বললেন চলবে।সম্পাদক আমাকে বললেন, আসো। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। এবার তিনি পুরো প্রফেশনাল আলোচনা গেলেন। বললেন তার নানা অভিজ্ঞতার কথা। তবে সাপ্তাহিক জনতার ডাক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপনের মতো স্বপ্নের জাল বোনার ধার দিয়েও গেলেন না। বরং প্রফেশনের নানা প্রতিবন্ধকতা ও তার পত্রিকার সংকটের বিষয় নিয়ে কথা বললেন। একদম শেষে বললেন, মোজাম্মেল যখন তোমাকে পছন্দ করেছে তখন আমার আর বলার কিছু নেই; তুমি কাজ করো। এরপর বললেন, তোমাকে মাসে বারোশ’ টাকা দেবো; সাতশ’ টাকা কনভেন্স, আর ৫শ’ টাকা বেতন।
তার কথা শুনে ঝাঁকি খাবার অবস্থা হলো অমার। জীবনে এটা প্রথম শুনলাম, বেতনের চেয় কনভেন্স বেশি হয়, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হবার মতো! তবু আমি রাজি হলাম। শেষে বুঝেছি, আমি সঠিক কাজটিই করেছি। এরশাদ মজুমদার ও খন্দকার মোজাম্মেল হকের হাত ধরে সাপ্তাহিক রিপোর্টার-এ কাজ করার সুবাদে সাংবাদিকতায় ফাউন্ডেশনের প্রাথমিক কাজটি হয়েছে। আর এ পত্রিকার সূত্র ধরেই সাপ্তাহিক সুগন্ধায় যোগদান এবং গেদুচার চিঠির সঙ্গে নিজের পরিচয় একাকার হয়ে যাওয়া। সাপ্তাহিক সুগন্ধার কারণে পরিচিতি তৈরি হয়েছে তা থেকে ৩৬ বছরেও খুব একটা বের হওয়া গেছে বলে মনে হয় না! যেটি আমার বিশেষ সাফল্যের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে অনেকের কাছে। যা আবার মাঝেমধ্যে আমার বিরক্তিরও উদ্রেক করে, ভালো লাগার কষ্টের মতো!
লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, মাই টিভি

মন্তব্য করুন