ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গা কেন বাংলাদেশে?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:০৬
সীমান্তে ৩১ রোহিঙ্গা নাগরিকের মানবেতর জীবন

সব সময় মানবিকতা প্রদর্শন করতে হয় না। ভারতে আশ্রয় নেীয়া কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের কসবা-আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে পুশইন করাতে চেয়েছিল বিএসএফ। কিন্তু আমাদের সাহসী বিজিবি এবার আর বিএসএফকে ছাড় দেয়নি। বিজিবির শক্ত প্রতিরোধের মুখে বিএসএফ রোহিঙ্গাদের ছোট দলটিকে ভারতে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

খবরে জানা যায়, গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের শূন্যরেখায় ভারতের অংশে অবস্থান নেীয়া ৩১ জন রোহিঙ্গাকে ভারতে ফিরিয়ে নেয় দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নের কাজিয়াতলী সীমান্তের শূন্যরেখা ভারতীয় অংশ থেকে তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়।

২৫ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মুহাম্মদ গোলাম কবির বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন। গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে ওই ৩১ জন রোহিঙ্গা কাজিয়াতলী সীমান্তের শূন্যরেখায় ভারতীয় অংশে অবস্থান নেন।

তাদের মধ্যে আট পুরুষ, ছয় নারী ও ১৭ শিশু ছিল। তাদের বিএসএফ জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা করে বলে তখন গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম মান্নান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। রোহিঙ্গারা যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সে জন্য সীমান্তে সতর্ক অবস্থান নেয় বিজিবি। ফলে টানা চার দিন সীমান্তের শূন্যরেখায় কৃষিজমিতে অবস্থান করেন তারা।

প্রচ- শীত ও অনাহারে থাকায় অসুস্থ হয়ে পড়ে রোহিঙ্গা শিশুরা। বিষয়টি সমাধানে একাধিকবার পতাকা বৈঠকে মিলিত হন বিএসএফ ও বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে পতাকা বৈঠকে কোনো সমাধান আসেনি। অবশ্য সোমবার রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্য তাঁবু বানিয়ে তাদের খাবার সরবরাহ করে বিএসএফ। অবশেষে মঙ্গলবার সকালে ভারতে তাদের ধাপে ধাপে ফিরিয়ে নেয় দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।

যেকোনো বাংলাদেশির জন্য খবরটি আশাব্যঞ্জক। আমাদের সীমান্ত আমরাই দেখব। কে ঢুকবে, কে ঢুকবে না, সেটি আমরা নির্ধারণ করব। বিজিবি বা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিটি সাহসী ভূমিকা আমাদের আশাবাদী করে তোলে, আমাদের মনে দেশপ্রেমের অনুভূতি তৈরি করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সাহসী জাতি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান আর দোসর খোন্দকার মোশতাক গং জাতির পিতাকে হত্যা করলে বাংলাদেশ সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পুরো বিশ্ব শেখ হাসিনার কারণে এখন বাংলাদেশকে সমীহ করে। আইনি লড়াইয়ে ভারত ও মিয়ানমারকে পরাজিত করে বিশাল সমুদ্র অঞ্চল জয় করেছে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম শেখ হাসিনাকে নিয়ে খুব গর্ব অনুভব করে। কারণ তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নতুন করে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে।

একটি স্বাধীন দেশের নিজস্ব ভূখ- থাকে, নিজস্ব সরকার থাকে, জনগণ থাকে, সংবিধান থাকে। বন্যার পানির মতো অন্য দেশের মানুষও যদি সব সময় বিনা বাধায় সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে চলে আসতে পারে, তাহলে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের কোনো মানে থাকে না। তবে হ্যাঁ, গণহত্যা থেকে বাঁচতে কোনো জনগোষ্ঠী যদি আশ্রয় চায়, তাহলে ভিন্ন কথা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে কোটিখানেক বাংলাদেশি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। বাংলাদেশও সাম্প্রতিককালে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে আশ্রয় দিয়েছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে প্রাণ বাঁচাতে কিছু রোহিঙ্গা ভারতেও ঢুকেছিল। সেই রোহিঙ্গাদের ভারত ফেরত পাঠাতে চাইলে মিয়ানমারেই পাঠাতে হবে। কিন্তু আমরা লক্ষ করলাম, অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করল বিএসএফ। রোহিঙ্গাগুলো খোলা আকাশের নিচে কষ্ট করল খুব। কিন্তু আর কত? ভারত নাকি সামরিক, অর্থনৈতিক পরাশক্তি? বাংলাদেশ যদি এতগুলো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে পারে, খাওয়া-পড়া দিতে পারে, তাহলে ভারত কেন পারবে না? ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন যে অবস্থায় আছে, সেখানে কি এ ধরনের অন্যায় পুশইনের ঘটনা মানানসই? ভারত-বাংলাদেশ যেখানে একসাথে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কাজ করার কথা, সেখানে এ ধরনের পুশ-ইনের চেষ্টা জনমনে অপ্রত্যাশিত সংশয় তৈরি করে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা যদি ভারতে প্রবেশ করতে চায়, সেটি ভারত হতে দেবে? তাহলে বিএসএফ কীভাবে এমন পুশ-ইনের চেষ্টা করতে পারে?

বিএসএফ কর্তৃক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা খুব স্পর্শকাতর। ভারতের আসাম রাজ্যে স্থানীয় মুসলমানদের ‘বহিরাগত’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার একধরনের অপচেষ্টা রয়েছে। বাংলাদেশ যদি ভারতের রোহিঙ্গাদের একজনকেও প্রবেশ করতে দেয়, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য বড় কোনো সংকট সৃষ্টি হতে পারে। আসামের মুসলিম আর রোহিঙ্গা মুসলিমদের চেহারা হুবহু এক রকম। আসামের হতদরিদ্র বাঙালি মুসলমানদের রোহিঙ্গা বলে চালিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

কখনো কখনো মানবিকতা প্রদর্শন করতে হয়, যেমনটা ‘মানবতার জননী’ খ্যাত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করেছেন। ৩০-৪০ জন নয়, প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের ভূখ-ে। বিশ্বব্যাপী এই মানবিকতা প্রশংসিত হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা-সম্পর্কিত চাপ নিতে হচ্ছে। এরপরও শেখ হাসিনার সরকার রোহিঙ্গাদের মানবিক গ্রাউন্ডে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। শান্তির পথে, সংলাপের মাধ্যমে রোহিঙ্গা-সংকট সমাধানের পথ বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার এই মানবিক, শান্তিবাদী, অহিংস নীতিকে কেউ কি ‘দুর্বলতা’ ভাবছেন? তাহলে ভুল ভাবছেন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :