সুন্দরবনে চোরাশিকারিরা বেপরোয়া, হুমকিতে চিত্রল হরিণ
পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ মায়াবী চিত্রল হরিণ এখন হুমকির মুখে। বেপরোয়া চোরা শিকারি ও পাচারকারীদের কবলে পড়ে মারা পড়ছে অসংখ্য চিত্রল হরিণ। বন বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুন্দরবনের সম্পদ ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় তৎপর থাকলেও চক্রটি নানা কৌশলে হরিণ শিকার করে মাংস, চামড়া, মাথা পাচার করছে।
মাঝেমধ্যে বন বিভাগ, কোস্টগার্ড ও পুলিশের হাতে পাচারের সময় ধরা পড়ছে বটে, কিন্তু চোরা শিকারি ও পাচারকারীদের অপতৎপরতা রোধ করা যাচ্ছে না। অভিযানে জব্দ হওয়া হরিণের মাথা, চামড়া, মাংস উদ্ধার থেকে অনুমেয় বিপুলসংখ্যক হরিণ চোরাকারবারিদের শিকার হচ্ছে।
গত বছর খানেকে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, পুলিশের ১৩টি অভিযানে ৫৪০ কেজি হরিণর মাংস, ৫টি চামড়া, ৭টি মাথা, ৮টি নৌকাসহ বিপুল পরিমাণ হরিণ শিকারের ফাঁদ জব্দ করা হয়। এ সময় হরিণ শিকার ও পাচারের অভিযোগে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়।
১৯৯৫ সালের এফএও এবং ইউএনডিসির কারিগরি সহযোগিতায় পরিচালিত পশু শুমারি অনুযায়ী সুদরবন হরিণের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার। ১৯৯৬-৯৭ সালের ইন্টিগ্রেটেড রিসার্স ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের আওতায় বন্য প্রাণীর ওপর এক জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল এক লাখ থেকে দেড় লাখ। ২০০১ সালের আরেক জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল একই।
জানা যায়, চোরা শিকারিরা মাছ বা কাঁকড়ার পাস নিয়ে বনে ঢুকে জাল পেতে স্প্রিং বসানো ফাঁদ, বিষটোপ, কলার মধ্যে বরশি ঝুলিয়ে এবং চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে নিধন করছে বিপুলসংখ্যক হরিণ। শিকার করা হরিণের মাংস, চামড়া পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়, শহরের একশ্রেণির বিলাসী মানুষ ও সমাজপতিদের বাসায়। আবার নানা কাজের তদবিরে ব্যবহৃত হচ্ছে হরিণের মাংস।
চোরাই বাজারে হরিণের মাংস কেজিপ্রতি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এর চামড়ারও কদর রয়েছে যথেষ্ট। একটি চামড়া পাঁচ-সাত হাজার টাকায় বিক্রি হয় বলে সূত্র জানায়।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে বঙ্গোপসাগরের পক্ষীদিয়া চরে অভিযান চালিয়ে হরিণের একটি মাথা, দুটি চামড়া ও ২০ কেজি মাংস উদ্ধার করে কোস্টগার্ডের পাথরঘাটা কন্টিনজেনের সদস্যরা। তবে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে জানান স্টেশন কমান্ডার সাব-লেফটেন্যান্ট মো. জহুরুল ইসলাম। হরিণের মাথা, চামড়া ও মাংস পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
তার দুই দিন আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় মোংলা কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের সিজি স্টেশন কৈখালীর একটি টহল দল সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানার কালির খাল সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে জবাইকৃত হরিণের দুটি চামড়া ও দুটি মাথাসহ ১০ কেজি মাংস উদ্ধার করে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পূর্ব সুন্দরবনের পশুর নদীর চিলা এলাকা থেকে গত ৭ জানুয়ারি বনরক্ষীরা ৩০ কেজি হরিণের মাংস ও পাচারকারীদের ফেলে যাওয়া একটি নৌকা জব্দ করেন। গত ৩ জানুয়ারি শরণখোলা রেঞ্জের চরখালী টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা চরখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৪০০ ফুট হরিণ ধরার ফাঁদ জব্দ করে।
এর আগে গত ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় একই এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২০ কেজি হরিণের মাংস ও ১টি নৌকা এবং ৮ ডিসেম্বর দুপুরে শরণখোলা রেঞ্জের শাপলা টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা সিদুরবাড়িয়া এলাকায় অভিযান চারিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১০ কেজি হরিণের মাংস ও ১টি নৌকা উদ্ধার করে।
গত ২২ নভেম্বর রাতে ও ২৩ নভেম্বর বন বিভাগের স্মার্ট টহল টিম বিভিন্ন এলাকা থেকে দুবলার চরের রাস মেলায় আসা ৫৭ জনকে হরিণ শিকার করার অভিযোগ আটক করে। তাদের দুটি ট্রলারে তল্লাশি চালিয়ে হরিণের মাথা, চামড়া, ৫০ মিটার ফাঁদ জব্দ করে।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের হারবাড়িয়া টহল দল গত ১১ নভেম্বর বনসংলগ্ন মিরগামারি খাল সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ কেজি হরিণের মাংস, একটি চামড়া, একটি মাথা উদ্ধার করে। গত ৮ জুন ভোরে সুন্দরবন সংলগ্ন হরিণ শিকারি ও পাচারকারী হিসেবে পরিচিত চরদুয়ানী এলাকার বলেশ্বর নদীর শাখা নাপিতখালী খাল থেকে শরণখোলা রেঞ্জের সুপতি কোস্টগার্ড অভিযান চালিয়ে ২৪০ কেজি হরিণের মাংস, একটি নৌকা উদ্ধার করে।
গত ১২ মে সন্ধ্যায় ও গভীর রাতে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের স্মার্ট টিমের টহল ও জ্ঞানপাড়া টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা শেলার চরের মানিকখালী খাল ও চরদুয়ানীর বলেশ্বর নদীতে অভিযান চালিয়ে হরিণ শিকারে ব্যবহৃত এমবি আল-মদিনা-১ নামের একটি কার্গো জাহাজ, ৩০ কেজি হরিণের মাংস, ২৩০টি হরিণ ধরার ফাঁদ ও ১টি নৌকা জব্দ করে। এ সময় হরিণ শিকারের দায়ে দাকোপ উপজেলার আমতলা গ্রামের বিশ্বজিৎ মৃধা, বাউফল উপজেলার দাসপাড়া গ্রামের আল-আমিন, গলাচিপা উপজেলার চরকাজল গ্রামের মো. হাসান, একই গ্রামের মো. সুমন, আশাশুনি উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের সাইদ সরকারের বিরুদ্ধে বন বিভাগীয় মামলা হয়েছে।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লে. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, চোরা শিকারি ও পাচারকারীরা মাছের পাস নিয়ে বনে ঢুকে হরিণসহ বন্য প্রাণী শিকার করে। চোরা শিকারিদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের পাস বন্ধ করে দিয়েছে বন বিভাগ।
স্থানীয় এলাকাবাসী চোরা শিকারিদের বিষয়ে সচেতন বলে জানান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী রক্ষায় জনসাধারণকে বিভিন্নভাবে সচেতন করা হয়। ফলে অভিযানকালে হরিণ শিকারি ও পাচারকারীরা মাংস, চামড়া ও মাথা রেখে পালিয়ে যায়।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বন কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, সুন্দরবনের হরিণ শিকার ও পাচার রোধে কঠোর নজরদারি রয়েছে। শিকারি ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বন বিভাগের করা মামলায় সম্প্রতি দুজন হরিণ শিকারিকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। হরিণ শিকারের ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে বলে দাবি করেন তিনি। সুন্দরবন বিশাল এলাকা বলে হরিণ শিকার রোধে সবার সহযোগিতা প্রয়োজনীয়তার কথা জানান তিনি।
(ঢাকাটাইমস/১১ফেব্রুয়ারি/মোআ)