উত্তরা গণভবনে হচ্ছে স্থাপনা, ঐতিহ্য বিনাশের শঙ্কায় নাটোরবাসী

সাইফুল ইসলাম, নাটোর
 | প্রকাশিত : ০৬ মার্চ ২০১৯, ২১:১৪

নাটোরের উত্তরা গণভবনের পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর ভেতর ও বাইরে নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে নাটোর জেলাকে নিয়ে তিন বছর মেয়াদী একটি পরিকল্পনায় পর্যটন ব্যবস্থার আধুনিকায়নে এ পদক্ষেপের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

জানা গেছে, ২০১৭ সালে গণপূর্ত বিভাগ থেকে গণভবনের কর্তৃত্ব নেয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে আমন্ত্রণ জানিয়ে অধিকতর সংস্কার ও স্থাপনা নির্মাণের প্রস্তাব দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বিবেচনার জন্য পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে। এ যাবতকালে নাটোর জেলার সর্ববৃহৎ এ প্রকল্পটি সম্পর্কে অনেকটা অন্ধকারেই ছিল নাটোরবাসী। তবে সম্প্রতি উত্তরা গণভবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এর ভেতরে ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি থ্রি-ডি সিনেপ্লেক্স নির্মাণের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হওয়ার খবরে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে সচেতন মহলে।

বুধবার উত্তরা গণভবনে গিয়ে মূল ফটক পেরোতেই দেখা যায়, গণভবনের প্রস্তাবিত সংস্কার ও স্থাপনা নির্মাণের একটা নকশা বিলবোর্ড আকারে টানানো রয়েছে। নকশা অনুযায়ী, গণভবনের চার দিকে সংস্কারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী, প্রস্তাবিত নকশার দক্ষিণ দিকে একটি ওয়াচটাওয়ার, ফুট ওভারব্রিজ, পাথওয়ে, পাথওয়ে ল্যান্ডস্কেপ, গার্ডেন, ফোয়ারা, ভাসমান প্লাটফর্ম, পশ্চিমে দুইটি করে বিশ্রামাগার, বসার জায়গা ও সংস্কার করা ঘাট, উত্তরে পাথওয়ে, ফুটওভারব্রিজ ও ওয়াচটাওয়ার এবং পূর্বে পাবলিক টয়লেট, ওয়াটারবুথ, পাথওয়ে, বিশ্রামাগার ও বসার জায়গা। প্রস্তাবনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মূল নকশার পরিবর্তন ঘটিয়েই স্থাপনা নির্মাণ করতে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন।’

নাটোর জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) অনিন্দ্য মণ্ডল জানান, ‘ভেতরে ও বাইরে মিলিয়ে উত্তরা গণভবনের জায়গার পরিমাণ ৪৪.৩৯ একর। এর মধ্যে ভেতরে ৪১.৫০ একর ও বাইরে ২.৮৯ একর। গণভবনের সৌন্দর্য্যবর্ধন ও লাভজনকতা বিবেচনায় বেশকিছু সংস্কারসহ একটি থ্রি-ডি কর্নার স্থাপনের প্রস্তাব সংবলিত একটি প্রকল্প তৈরি করে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। যেখানে ভেতরের প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ৩৪ কোটি ও বাইরে ৩১ কোটি টাকা। ভেতরে ও বাইরে মিলিয়ে থ্রি-ডি কর্নার সিনেপ্লেক্স, মোটেল, শপিং কমপ্লেক্স, সুইমিং পুল, কালভার্ট, ওয়াকওয়ে, বোটিং, পুকুরপাড় বাঁধাই করে দর্শনার্থীদের বিনোদনের যাবতীয় ব্যবস্থার পরিকল্পনা রয়েছে প্রস্তাবিত প্রকল্পে।’

নাটোরের প্রবীণ লোকজনদের মতে, ‘সর্বশেষ উত্তরা গণভবনের মূল নকশায় পরিবর্তন আসে ১৯৬৫ সালে। তৎকালীন পূর্ত বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার উত্তরা গণভবনের মূল ভবনের ছাদে একটি গম্বুজ স্থাপন করে যা এখনো অবিকৃত রয়েছে। ১৯৯৭ সালে দিঘাপতিয়া রাজবংশের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী ভারতে বসবাসকারী বিমলেন্দুনাথ পূর্বপুরুষের জমিদারি দেখতে দিঘাপতিয়া আসেন। সেসময় উত্তরা গণভবনে এসে মূল নকশার বাইরে স্থাপিত গম্বুজ দেখেন তা অপসারণের অনুরোধ করলেও প্রশাসন তা রাখেনি।’

দিঘাপতিয়ার রাজার রাজা দয়ারাম রায়ের কর্মচারী নঈমুদ্দীনের চতুর্থ বংশধর শহিদউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘তিনপুরুষ ধরে তারা দিঘাপতিয়া রাজ ঐতিহ্যের সাক্ষী। গর্ব আর জৌলুসের সেই রাজবাড়ির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে সম্প্রতি উত্তরা গণভবনকে উন্মুক্ত করে। আর এখন গণভবনকে টার্গেট করে ব্যবসা করলে তা ইতিহাসের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা ভেবে এমন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।’

চিত্রশিল্পী এম আসলাম লিটন বলেন, ‘আমরা সর্বদা ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের পক্ষে। তবে সংস্কারের নামে ইতিহাস-ঐতিহ্যের নান্দনিকতা ও ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বিকৃত করা বা পরিবর্তন করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এসব বিবেচনায় রেখে সংস্কার করা হোক।’

নাটোর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি রেজাউল করিম খান বলেন, ‘উত্তরা গণভবনের আলাদা গুরুত্ব আছে রাষ্ট্রের কাছে। তাই এখানে পর্যটন স্পট না করাই ভালো। নতুন কোন পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধি না করে শহরের অন্য কোন স্থানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে নাটোরবাসীর সুষম বিনোদন নিশ্চিত হবে। সর্বোপরি উত্তরা গণভবনকে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে।’

জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবী সুশান্ত কুমার ঘোষ বলেন, ‘রাজ-রাজণ্যের ইতিহাসবেষ্টিত উত্তরা গণভবন সংস্কার হতে পারে- তবে তা অবশ্যই ঐতিহাসিক গুরুত্ব অক্ষুণ্ন রেখে। এর বাইরে ন্যুনতম পরিবর্তন হওয়া মানে মূল চেতনা থেকে দূরে সরে আসা। একজন আইনজীবী হিসেবে এমন বিকৃতি ঠেকাতে প্রয়োজনে আইনজীবী নেতাদের প্রতিবাদের কর্মসূচি দিতে আমরা অনুরোধ করব।’

নাটোরের কৃতি সন্তান বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক ডা. জাকির তালুকদার বলেন, ‘উত্তরা গণভবন ব্যবসা করার জায়গা না। এখানে মানুষ আসে ইতিহাসের সংস্পর্শ পেতে। গণভবনকে ব্যবসা কেন্দ্র বানিয়ে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করলে নাটোরের মানুষ এমনকি দেশবাসী চুপ থাকবে না।’

জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রসাদ কুমার তালুকদার বাচ্চা বলেন, ‘উত্তরা গণভবন নাটোরবাসীর ভাবনা ও গর্বের জায়গা। তাছাড়া দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন কোন পর্যটনকেন্দ্র হতে পারে না। ইতিহাসের অংশ এই শতাব্দীপ্রাচীন অবকাঠামোকে এক ইঞ্চি পরিবর্তন করলেও ইতিহাসকেই বিকৃত করা হবে। আমরা এটি হতে দেব না। প্রয়োজনে আইনি লড়াইয়ে যাব আমরা।’

জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক দীলিপ কুমার দাস বলেন, ‘পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধির নামে উত্তরা গণভবনের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপর হাত দেয়া চলবে না। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি বিপুল পরিমাণ অর্থের। পাস হলেও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অক্ষুণ্ন রেখে এবং সরকারি অর্থ স্বচ্ছতার সাথে ব্যয় করতে হবে। অন্যথায় নাটোরবাসী এটি মেনে নেবে না।’

জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোর্ত্তোজা আলী বাবলু বলেন, ‘উত্তরা গণভবনের বাইরে সংস্কার বা নতুন স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারে বিভিন্ন সময় শুনলেও ভেতরে কি করা হবে তা জানি না। তবে যাই করা হোক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন, এটা ভুলে যাওয়া চলবে না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত সরকারের কাছে উত্তরা গণভবন গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরা গণভবন যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন সেটি মাথায় রেখেই নাটোরবাসীর আবেগকে সম্মান জানাতে হবে জেলা প্রশাসনের।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজ বলেন, ‘উত্তরা গণভবনে পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধির প্রকল্পটি নতুন প্রজন্মের চাহিদা বিবেচনায় প্রেরণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি পাস হলে ধাপে ধাপে অর্থ বরাদ্দ আসবে। থ্রি-ডি কর্নার রাজা দয়ারামের কাচারি বাড়ির ভেতরে করা হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে ইতিহাস বা ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন হবে না।’

(ঢাকাটাইমস/৬মার্চ/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :