ভালোবেসে যাকে জড়ায়ে ধরি, সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে

আনিসুল হক
 | প্রকাশিত : ১৫ মে ২০২০, ১১:৩৯

'ভালোবেসে যাকে জড়ায়ে ধরি, সে-ই যায় দীর্ঘ পরবাসে'--নির্মলেন্দু গুণ। পশ্চিমবঙ্গের কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। কলকাতা যাওয়া হলে, মেরিনার সঙ্গে বেশ কয়েকবার গেছি, সদর স্ট্রিটে থাকি, পার্ক স্ট্রিটে যাই, যাই অক্সফোর্ডে বইয়ের দোকানে, নিজের উদ্যোগে জোড়াসাঁকো কিংবা কফি হাউজ দেখতে যাই, কিন্তু কলকাতার কোনো লেখককে ফোনও করি না, কোনো পত্রিকা অফিসেও যাই না।

কয়েকবার গেছি ওদের দাওয়াতে, টাইমস অব ইন্ডিয়া দুবার নিয়েছিল দুটো উৎসবে, একবার আমি আর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার গেলাম, আরেকবার আমি, সেলিনা হোসেন আপা, ফারাহ গজনবী, জয়া আহসান গেলাম টাইমস অব ইন্ডিয়ার লিট ফেস্টে। একবার কলকাতা বইমেলা ঘিরে একটা ইন্টারন্যাশনাল লিটফেস্ট হয়, সেটাতেও আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম, বাংলাদেশ থেকে আর গিয়েছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী (ভাই)।

পাশাপাশি বইমেলা হচ্ছিল, বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের উদ্যোগেও বেশ কজন লেখককে ঢাকা থেকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সমরেশ মজুমদারদারদার সঙ্গে কিছুটা খাতির হয়েছে, সে বহু বছর আগে নিউইয়র্কের বইমেলায় যেবার আমাকে উদ্বোধক করে নেয়া হলো, সমরেশদা অতিথি ছিলেন, সেবার থেকে।

কবি জয় গোস্বামীর সঙ্গে খুব সামান্য পরিচয় আছে, তিনিও বাংলাদেশে এসেছিলেন, আমিও কলকাতা লিটফেস্টে গিয়ে আমাদের ছোটভাই কূটনীতিক কবি মাহবুব সালেহ (তুহিন)-এর কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে জয় গোস্বামীর সঙ্গে আহূত হয়েছিলাম।

বিস্ময়করভাবে আমার খাতির হয়ে গেল দেবেশ রায়ের সঙ্গে। আমি দেবেশ রায়ের প্রবন্ধ সংকলনগুলো-- উপন্যাস নিয়ে, সময় সমকাল, উপন্যাসচিন্তা, এই রকম অনেকগুলো, পড়ে ভাজা ভাজা করে খেয়ে ফেলেছি, তাঁর উপন্যাস, খরার প্রতিবেদন, মঙ্গার প্রতিবেদন, জীবনচরিতে প্রবেশ পড়েছি, তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত বহুদিন ধরে পড়েছি, প্রতিদিন এক চ্যাপ্টার করে। আমার একটা প্রবন্ধের বই আছে, লেখা নিয়ে লেখা। ২০১২ সালে দেবেশ রায় বাংলাদেশে আসেন লিটফেস্টে, সেখানে তাঁকে আমি দুটো বই দিই, লেখা নিয়ে লেখা, আর না মানুষি জমিন।

এপ্রিলে আমি টাইফয়েডে আক্রান্ত হই, আমার স্মৃতিলোপ পায় ওই সময়কালের, ওই সময় দেবেশদা আমাকে ই-মেইল করেন। তাও বইয়ে লেখকের ই-মেইল এড্রেস আছে, প্রিন্টারস লাইনে, সেটা দেখে। আমিও জবাব দিই। পরে, যেহেতু আমার টাইফয়েড কালীন স্মৃতি থাকে না, এই ই-মেইলের কথা আমি বেমালুম ভুলে যাই। দুই বছর পরে মনে হলে ই-মেইল ঘেঁটে সেই ই-মেইল চিঠিগুলো উদ্ধার করি। মাত্র কিছুদিন আগে সেসব আবার ফেসবুকে প্রকাশ করি। পরস্পর ডট কমেও সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে। দেবেশ দা আমার না মানুষি জমিনের রিভিউ লেখেন।

কলকাতা লিট ফেস্টে আমাকে দেখেই তিনি সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দেন। তখনই বলেছিলেন, তোমার বইয়ের আলোচনা লিখেছি, একটা প্রবন্ধ সংকলনে আছে, সেটা এখনো বের হয়নি, বের হচ্ছে।

তিনি গত বছর ঢাকায় আসেন। সালমা বানীর ফোন পাই। দেবেশ (দা) রায় আপনাকে খুঁজছেন। আমি যাই। তিনি গেঞ্জি পরে আসেন। আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমি এই ভালোবাসাটার কোনো কারণও পাই না, মানেও পাই না। আমার মনে আছে, একাবর ঢাকা থিয়েটার তাঁকে এনেছিল, একটা সেমিনারে তাঁকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তাঁর লেকচারের পরে, আমার প্রশ্নটা ছিল এ-রকম, দাদা, আপনি বলছেন, যেই মেয়েটি গ্রামের পথ ধরে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে, তার কথা লিখতে হবে।

এই কোকাকোলা, করপোরেট কালচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে, কিন্তু আমাদের পক্ষে ব্যাপারটার মধ্যে বিপুল স্ববিরোধিতা আছে, আমি নিজে করপোরেটে চাকির করি, ওই পেপসি কোকাকোলা আমার বেতন জোগায়, আবার আমি লিখি নাল পিরান কিংবা নিধুয়া পাথার; এই উভয়-সংকটের সমাধান কী? আমাদের লিট ফেস্টগুলোর স্পন্সর করে এই করপোরেটেরা, আপনাকে আমাকে স্পন্সর করে নিয়ে আসে এরা, ভালো হোটেলে রাখে, ভালো খাওয়ায়.... আমার মনে আছে নাটকের কর্মীরা আমার ওপরে বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন।

কিন্তু দেবেশ রায় আমাকে পছন্দ করতেন। তিনি কলকাতা থেকে আমাকে ফোন করতেন। আমিও করতাম। শেষের দিকে কানে কম শুনতেন বলে আর ফোন করা হতো না।

দেবেশ রায় আমাকে ভালোবেসেছিলেন আমার লেখা পড়ে-- এইটে আমি বিশ্বাস করতে চাই। আমার 'উপন্যাস নিয়ে উপক্রমণিকা' প্রবন্ধটা পড়ে। এবং অন্যান্য সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগুলো পড়ে। ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যা লুকিয়ে রাখা যায় না। গোপনে প্রেম রয় না ঘরে, আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে। আমিও দেবেশ রায়কে আগে থেকেই শ্রদ্ধা করতাম, পড়তাম, পরে ভালোবাসতাম।

এখন তিনিও চলে গেলেন। আনিসুজ্জামান স্যার চলে যাওয়ার কঘণ্টা পরেই দেবেশ রায়ের প্রয়াণ। ভালোবেসে যাকে জড়ায়ে ধরি, সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

ঢাকাটাইমস/১৫মে/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :