সিনহাকে হত্যার পর প্রদীপের ফোন, কেন? জানালেন আল্লাহ বকশ

‘হ্যালো। স্যার আদাব স্যার, আমি ওসি প্রদীপ। স্যার আমি ওসি টেকনাফ প্রদীপ, স্যার।’
‘হ্যা কী খবর প্রদীপ, কোরবানির মধ্যে কি?’
‘স্যার, একটা মহাবিপদে পড়ছি, আপনার সাহায্য দরকার।’
‘বলো বলো।’
‘স্যার, একটা ১৫৩, ১৮৬ ও ৩০৭ এ মামলা নিছি স্যার।’
‘… এ কি আর্মির নাকি?’
‘স্যার অবসরপ্রাপ্ত।’
‘ও তাইলে এতো ডরের কি আছে?’
‘স্যার, ও মারা গেছে, ইনজিওরড অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছে।’২০২০ সালের ১ আগস্ট। কোরবানির ঈদের দিন সকালে পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এসপি আল্লাহ বকশের সাথে টেলিফোনে এভাবে কথা হয় কক্সবাজারের টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপের।
ঠিক আগের দিন রাতে (৩১ জুলাই) পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ওসি প্রদীপের নির্দেশে টেকনাফের বাহারছড়া চেকপোস্টে তল্লাশির সময় সিনহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ড ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে তিনটি মিথ্যা মামলা করে পুলিশ। আর এসব মামলায় পরামর্শ নিতে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আল্লাহ বকশকে ফোন করেন ওসি প্রদীপ। হত্যার পর মামলা সাজাতে টেলিফোনে ওসি প্রদীপকে আইনি পরামর্শ দেন ওই এসপি। পরবর্তীতে পুলিশের করা তিনটি মামলাই মিথ্যা ছিল বলে প্রমাণিত হয়।
দেড় বছর পর আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয় গত ৩১ জানুয়ারি। মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীকে (বরখাস্ত) মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
রায়ে এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত ও পুলিশের তিন সোর্সসহ ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর সাত পুলিশ সদস্যকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।
যা বলছেন আল্লাহ বকশ:
ওসি প্রদীপকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে বিতর্কিত হন অবসরপ্রাপ্ত এসপি আল্লাহ বকশ। অনুতপ্ত হয়ে দুঃখপ্রকাশ করেন তিনি। পরবর্তীতে আলোচিত মামলাটির রায়ের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা।
আল্লাহ বকশ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘রায় সঠিক হয়েছে।… সঠিক রায় হয়েছে। তৎকালীন ওসি তো আমাকে ‘মিস গাইড’ করেছে। প্রদীপ আমাকে বলেছিল তার অফিসারকে বন্দুক ধরেছে, সেই অনুযায়ী সে (প্রদীপ) তাকে গুলি করতে বলেছে। এই অনুপাতে আমি তাকে সাজেশন দিছি।’ বলেন, ‘কর্মজীবনে এমন ধাক্কা খাইনি, অবসরে আসার পর যা খেয়েছি।’
২০০৬ সালে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার হিসেবে অবসরে যান আল্লাহ বকশ। তিনি ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি ইস্ট-পাকিস্তান পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতি, চট্টগ্রাম শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা লালানগর ইউনিয়নে।
সিনহা হত্যা মামলায় যারা খালাস পেয়েছেন তাদের বিষয়ে কী বলবেন- এ প্রশ্নে আল্লাহ বকশ বলেন, ‘আমি তো মামলার বিস্তারিত জানি না। এসব মামলায় কেস বা রায় না দেখে কিছু বলা মুশকিল। তবে বলব রায়টা যথাযথ হয়েছে।’
প্রদীপকে উপদেশ দেওয়ায় তো আপনি বিতর্কিত হয়েছেন- এমন প্রশ্নে সাবেক এই পুলিশ সুপার বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় দেখে যখন বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছিল তখন আমি দুঃখ প্রকাশ করেছিলাম। আর বর্তমান কর্মকর্তাদের সঙ্গে রিটায়ার্ড অফিসার হিসেবে কথা বলার এখতিয়ার ফৌজদারি কার্যবিধি আইন (সিআরপিসি) ৩০-এ স্পষ্টভাবে মেনশন করা আছে। এই আলোকে তারাও (বর্তমান কর্মকর্তারা) উপদেশ চাইতে পারে, আবার আমাকেও দিতে হয়। প্রদীপ যেভাবে বলেছিল, সেই অনুযায়ী আমার বক্তব্য সঠিক ছিল। কিন্তু সে যেই কাজটা করেছে সেটা তো আর আমাকে বলেনি। পরবর্তীতে পত্রিকায় দেখে বুঝেছি প্রদীপ আমাকে সম্পূর্ণভাবে ভূল বুঝিয়েছে।’
সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে 'অবজ্ঞাসূচক' মন্তব্য প্রসঙ্গে প্রায় ১৬ বছর ধরে অবসরে থাকা সাবেক এই পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমার বাচনভঙ্গি বিকৃত হয়, যা আমার অনিচ্ছাকৃত স্লিপ অব টাং। এতে আমি অনুতপ্ত, মর্মাহত। তাদের অবজ্ঞা করার প্রশ্নই আসে না।’
সিনহা হত্যার আগেও প্রদীপ কোনো ঘটনায় উপদেশ নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে সাবেক পুলিশ সুপার আল্লাহ বকশ বলেন, ‘হ্যাঁ এর আগেও নিয়েছে। একাধিকবার নিয়েছে। আমি তো অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কল্যাণ সমিতির চট্টগ্রাম শাখার সভাপতির দায়িত্বে আছি। এ হিসেবে তো অনেকেই উপদেশ নেয়। প্রতিনিয়ত অনেক অফিসার অফিসে আসে। আর একটা কথা কী- এখনকার অফিসারেরা আইনকানুনের দিক থেকে যা-ই জানুক বা না জানুন, প্রসিডিউরের ব্যাপারে খুব ঘাপলা আছে। এটাতে তারা অনেক কাঁচা থাকে। সে হিসেবে ওসি প্রদীপও দুই একবার উপদেশ নিয়েছে।’
প্রদীপের সঙ্গে যেভাবে পরিচয় আল্লাহ বকশের
প্রদীপের সঙ্গে পরিচয় কীভাবে জানতে চাইলে আল্লাহ বকশ বলেন, ‘আসলে তার (প্রদীপ) ভাই হলো দিলীপ। আমাদের চট্টগ্রাম ডিআইজি অফিসের হেড এসিসট্যান্ট ছিল দীর্ঘদিন। দিলীপই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল প্রদীপের সঙ্গে। হয় তো প্রদীপ তখন পুলিশে কেবল ঢুকেছিল। সাল ’৯৫ হবে। আমার সঙ্গে সে সরাসরি চাকরি করেনি। তবে আমি পুলিশে ট্রেনিং বা ক্লাস যখন নিতাম তখন হয়ত আমার ক্লাস করেছিল। এছাড়া দিলীপের ভাই … তারা দুই ভাই এ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।’
২০২০ সালের আলোচিত সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর ৫ আগস্ট তার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব। চার মাসের বেশি সময় তদন্ত করে প্রদীপসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দেয় তদন্তকারী সংস্থা। এতে টেকনাফ থানা পুলিশের নয়জন সদস্য, এপিবিএননের তিনজন এবং পুলিশ সোর্স তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়।
(ঢাকাটাইমস/০৯ জানুয়ারি/এফএ)

মন্তব্য করুন