বরিশালে সাংবাদিকতার সেকাল-একাল

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫:১৮

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে দুইজন সহযোগী অধ্যাপকের নেতৃত্ব ও অংশ গ্রহণে ২৬ আগস্ট সাত সাংবাদিকের উপর হামলা এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে নানাবিধ নগ্নচিত্র স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবাদের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এবং কতিপয় নেতার আপোষকামিতা সবাইকে ব্যথিত করেছে। অথচ বরিশালের অবস্থা এমনটা হবার কথা নয়। ইতিহাস-ঐতিহ্য এই দৈন্যতার ধারক নয় মোটেই। বরং ঐতিহ্যগতভাবে বরশাল অন্য এক উচ্চায় বলে বিবেচিত হতো।

শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য-সাংবাদিকতায় বরিশাল অঞ্চল, মানে আজকের ৬ জেলা, অনেক সমৃদ্ধ ছিলো। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, বরিশালের পত্রিকায় কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা লিখেছেন। গাফ্ফার চৌধুরী নিজেও লেখক-সাংবাদিক হওয়ার সূচনা বরিশাল থেকেই। বরিশালের পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে অনেকই সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, বরিশালে এবং ঢাকায়। এদিকে একাত্তরের রনাঙ্গন থেকে পত্রিকা প্রকাশের দৃষ্টান্ত আছে বরিশালের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন অনেকে। নেতৃত্বে ছিলেন নূরুল আলম ফরিদ। নেপথ্যে ছিলেন জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ঘরানার এক দল তরুন শিক্ষক। আর স্বাধীনতার পর বরিশাল থেকেই বাংলাদেশে প্রথম পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিক গণডাক নামের এই পত্রিকাটি সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত। মুক্তিযোদ্ধা মনসুরুল আলম মন্টুর “বরিশার মুক্তিযুদ্ধের সদরে অন্দরে” গ্রন্থর সূত্র মতে সাপ্তাহিক গণডাক পত্রিকার নেপথ্যে ছিলো আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর। আর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন তাঁর স্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহান আরা বেগম। পত্রিকাটিতে কাজ করতেন সে সময়ের মেধাবী একদল তরুণ। এদের মধ্যে আবু আল সাইদ নান্টু, মনসুরুল আলম মন্টু, গাজী সুলতান আহমেদ বাবুসহ অনেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এদের মধ্যে আবার সদরুল ও নজরুল রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এদিকে সাপ্তাহিক গণডাক কেবল পত্রিকা ছিলোনা, এটি ছিলো এক ধরনের মিলন কেন্দ্র। এই পত্রিকা অফিসে বসেই গঠিক হয়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠন খেয়ালী। যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মনসুরুল আলম মন্টু।

মুক্তিযুদ্ধ এবং শুদ্ধ রাজনীতির সুতিকাগার থেকে বরিশালে যে সাংবাদিকতার বিকাশ হয়েছে তার অধগতির সূচনা হয়েছে বছর পঁচিশ আগে। অধগতির এই বীজ রোপনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছেন বরিশাল রেইঞ্জের প্রথম ডিআইজি। সেই বীজ থেকেই জন্ম নিয়েছে বিষবৃক্ষ। যা বরিশালের সাংবাদিকতাকে দুর্গতির দিকে নিয়ে গেছে। যে দুর্গতির পালে জোর হাওয়া লাগে সংবাদপত্রের মালিকানা থেকে ক্লান্ত হয়ে সৈয়দ দুলালের স্বেচ্ছা বিদায়। আর সাংবাদিক নেতৃত্ব হীনবল হতে শুরু করে লিটন বাশারের অকাল মৃত্যুর পর থেকে। সেকাল-একালের ব্যবধান অনুধাবনের জন্য একটি ঘটনা উল্লেখ্য করা যায়। অনেকেরই জানা, বরিশাল মেট্রেপলিটন পুলিশের একজন ‘সেই রকম’ কমিশনার ছিলেন! যিনি এতোটাই দুর্নীতিবাজ ছিলেন যে, তার দাড়ি কামাবার ব্লেডও নাকী ওসিদেরকে কিনে দিতে হতো। এই পুলিশ কমিশনারকে বিদ্রুপ করা হতো ‘গরুর ডাক্তার’ বলে। যদিও তিনি গরুর ডাক্তার ছিলেন না। তাঁর কুকর্মের বিষয় দৈনিক আজকের পরিবর্তনে রিপোর্ট হলো। ব্যাস! পুলিশ কমিশনার হলেন মহা খাপ্পা। তখন পত্রিকাটির মালিক ও সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ দুলাল এবং প্রকাশিত রিপোর্টের রিপোর্টার ছিলেন লিটন বাশার। এ অবস্থায় মালিক-সম্পাদক শক্তভাবে রিপোর্টারের পক্ষে দাঁড়ালেন।

এদিকে পুলিশ কমিশনারও হাল ছাড়ার বস্তু নন। তার হাতে ডান্ডা আছে না! এক পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে রিপোর্টার লিটন বাশারকে দেখা করার জন্য হাইড্রোলিক প্রেসার দেয়া শুরু হয়। এই পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন লিটন বাশারের কাজিন। প্রথমে খালতো ভাই হিসেবে আবদার-অনুনয়-বিনয়, পরে পুলিশী হুমকি-ধামকি। কিন্তু কোন কিছুতেই পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ দুলাল অথবা রিপোর্টার লিটন বাশার একটুও টলেননি। এদিকে বরিশালে সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েগেলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে শেষতক পুলিশ কমিশনারকেই রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাকে আরো মূল্য দিতে হয়েছিলো। তাঁকে বরিশাল প্রেসক্লাবে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়। অথচ এই ঘটনার বছর কয়েক পরে বরিশালে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক পুলিশ কমিশনারের মত বিনিময় অনুষ্ঠানে একজন মাননীয় সম্পাদক বিনয়ের অবতার হয়ে বলেছিলেন, “স্যার আপনার রুমে একটি লাঠি রাখবেন, আমরা কোন অপরাধ করলে আপনি আমাদের বিচার করবেন।”

সম্পাদকের নমুনা যদি এমন হয় তাহলে আর কি কিছু বাকী থাকে! এ ব্যাপারে বরিশালের সাবেক ডিসি হাবিবুর রহমান একবার আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘এ কোন প্রাচ্যের ভেনিসে এলাম, মুরগীর ব্যাপারীও দেখি পত্রিকার মালিক হতে চায়!’ সকল মালিক অথবা সম্পাদক এমন, তা কিন্তু নয়। হয়তো গুটি কয়েক এ রকম। কিন্তু পারসেপশন ও পরিবেশ নষ্ট করতে বেশি লোকের প্রয়োজন হয় না। এ দুর্দশা কেবল বরিশালে নয়। ঢাকা বা অন্য জেলাগুলোর অবস্থাও প্রায় তথৈবচ। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কোথায় কতজন মালিক-সম্পাদক মানসম্পন্ন? কতজন সাংবাদিক নেতা সত্যের পক্ষে দাড়াবার সাহস রাখেন? কোথায় নিরাপদ সাংবাদিকরা! সর্বগ্রাসী এই দুর্দশা তো সাংবাদিকতায় ছিলো না। এতকিছুর মধ্যেও আশার কথা হচ্ছে, কয়েকটি টেলিভিশন, কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালে বরিশালে যারা কাজ করেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই সেরাদের সেরা হিসেবে পরিচত। বলা হয়, নিকস কালো আঁধারে এরাই হচ্ছেন আলোক বর্তিকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :