ডিবি হারুন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকলো?

২০১১ সালে জাতীয় সংসদের সামনে এক মিছিলে তৎকালীন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুককে মারধরের ঘটনায় প্রথম আলোচনায় আসেন পুলিশ কর্মকর্তা হারুন-অর রশীদ। তখন তিনি ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ছিলেন। ঘটনার সময় জয়নাল আবেদন ফারুককে ধাওয়া করে জামা খুলে নেওয়ার ছবি এবং ভিডিও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ছাপা হলে তা ভাইরাল হয়। এরপর থেকে হারুনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে পুলিশ বিভাগে।
নেতিবাচক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তার নাম আসতেই থাকে। বিশেষ করে—ডিবিতে মানুষকে তুলে নেওয়া, বিরোধী দলের আন্দোলনে ‘বোমা উদ্ধারের’ প্রহসন, হেফাজতে নির্যাতন, আপত্তিকর ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়—ইত্যাদি অভিযোগে তিনি ব্যাপক সমালোচিত হন। তবে সব সময় থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ হারুনকে সবসময় প্রশ্রয় দিয়ে আসছিলেন। যোগ্যতা না থাকলেও তৎকালীন রাষ্ট্রপতির ইশারায় হারুনকে ডিআইজি করে ডিবি-প্রধান হিসেবে পদায়ন করা হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্ব পাওয়ার পর ডিবি অফিস পরিচিতি পায় ‘হারুনের ভাতের হোটেল’ হিসেবে। এর কারণ, হারুন তার কার্যালয়ে অভিযোগ নিয়ে আসা বিভিন্নজনকে দুপুরে খাওয়াতেন। সেসব ছবি নিজের ফেসবুকে শেয়ার করে তিনি আলোচনার জন্ম দেন।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার থাকাকালে পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেমের ছেলে ও আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেলের স্ত্রী-সন্তানকে ধরে নিয়ে যায় হারুন। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় এই কাণ্ড ঘটানো হয়। যা নিয়ে তখন দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।
সর্বশেষ ৩১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মিন্টো রোডে ধরে আনার ঘটনায় ডিবি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় হারুনকে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান। বর্তমানে তিনি সস্ত্রীক লন্ডনে অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এদিকে পতিত সরকার পতনের পর হারুনের বিরুদ্ধে সব থেকে বেশি মামলা হয়েছে। হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে হওয়া মামলার সংখ্যা প্রায় ১৮৫টির বেশি। হারুনের বিরুদ্ধে এতো মামলা থাকলেও এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সাময়িক বরখাস্ত কিংবা বিভাগীয় তদন্তের কোনো তথ্য জানাতে পারেন পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এআইজি ইনামুল হক সাগর ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘হারুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যেকোনো সময় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরইমধ্যে হারুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি গেছে।’ যারা পলাতক বা কর্মে যোগ দেননি তারা কেউই শাস্তি থেকে রেহাই পাবেন না বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
পুলিশ সদরদপ্তরের একটি সূত্র ঢাকাটাইমসকে জানিয়েছে— হারুনসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে হারুন আটক বা কোনো মামলায় সাজা না হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা যাচ্ছে না। আবার চাকরি বয়স ২৫ বছরও হয়নি। কোন আইনে তাকে বরখাস্ত করা যায় সেই বিষয়টি দেখা হচ্ছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘আইন সবার জন্য সমান। দোষী হোক কিংবা নির্দোষ তাদেরকে চিহ্নিত করে বিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে বাহিনীর সদস্যদের মনোবল ঠিক থাকবে।’
হারুন অর রশীদের জন্ম কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার হোসেনপুর গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স ও এমএসএস করেন তিনি। বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ২০তম ব্যাচে কর্মকর্তা হারুন। ২০২২ সালের ১৩ জুলাই তাকে ডিবি-প্রধান করা হয়। এর আগে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে এসপি ছিলেন তিনি।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নেওয়াসহ অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ উঠেছে। এদিকে ডিবির সাবেক প্রধান হারুনের ৩৩ একর জমি, পাঁচটি ভবন ও দুইটি ফ্ল্যাট জব্দ করার আদেশ দেন আদালত। এছাড়া তার নামে বিভিন্ন ব্যাংকের দশটি হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়। এসব হিসাবে জমা রয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ ৯০ হাজার ৪৬৮ টাকা। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত এ আদেশ দেন।
দুদকের আবেদনে বলা হয়, হারুনের নামে ঢাকার উত্তরায় ৭.৪৫ কাঠা জমিতে ৩ কোটি টাকার মূল্যের একটি ইমারত রয়েছে। এছাড়া গুলশানে ১০.৩৬ শতক জমিতে ৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকার আরেকটি ইমারত রয়েছে। এছাড়া কুড়িলে সেমিপাকা একটি টিনশেড বাড়ি, খিলক্ষেতে ১ তালা একটি দালান ও সেমিপাকা আরেকটি টিনের বাড়ি রয়েছে হারুনের নামে। এসব ভবন জব্দ করার আবেদন করা হয়েছে। এছাড়া হারুনের নামে উত্তরায় ১০ নম্বর সেক্টরে ৭ তালা ভবনে ২য় তালায় একটি ফ্ল্যাট ও জোয়ার সাহারায় ৬ তলা ভবনের ৬ তলায় আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এই দুই ফ্ল্যাটসহ আশিয়ান সিটিতে হারুনের নামে ৫ কাঠার একটি প্লট জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। অন্যদিকে সাবেক ডিবি কর্মকর্তা হারুনের নামে কিশোরগঞ্জ, কক্সবাজার ও নারায়ণগঞ্জে ৯৯ দশমিক ১৮ বিঘা জমি জব্দ করা হয়েছে। এর ভেতর শুধু কিশোরগঞ্জেই হারুনের নামে ৯১.৩২ বিঘা জমি রয়েছে।
জানা গেছে, হারুন অর রশীদ কিশোরগঞ্জ মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে শত কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলেছেন ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’ নামে অত্যাধুনিক ও বিলাসবহুল একটি প্রমোদাগার। হেলিপ্যাড ও অত্যাধুনিক সুইমিং পুলসহ কী নেই সেই রিসোর্টে। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও বিত্তশালীদের আনন্দ-ফুর্তির জন্য অত্যন্ত নিরাপদ স্থান হয়ে উঠেছিল হারুনের এই রিসোর্ট।
হারুনের নিজ গ্রামের ৪০ একরের বেশি আয়তনের প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের প্রিমিয়াম স্যুটের প্রতিদিনের ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন ডিলাক্স রুমের ভাড়া প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা। রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন তার ছোট ভাই ডা. শাহরিয়ার। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রিসোর্টটি উদ্বোধন করা হয়।
প্রেসিডেন্ট রিসোর্টে হারুনের পরিবারের মাত্র ৫ থেকে ৭ একর জমি থাকলে বাকি জমি নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে দখল করেছেন তিনি। এছাড়া যেসব মালিক জমি বিক্রি করেছেন তারা প্রকৃত মূল্য পাননি। প্রকৃত মালিকদের কেউ ১০ লাখের মধ্যে ১ লাখ, কেউ ২০ লাখের মধ্যে ২ লাখ এই হারে টাকা পেয়েছেন। এখনো অন্তত ১০ থেকে ১২ জন দাম না পাওয়ায় তাদের জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি।
হারুনের প্রতরণার শিকার হওয়া তাদের মধ্যে একজন মিঠামইন সদর ইউনিয়নের গিরীশপুর গ্রামের দিলীপ কুমার বণিক। তিনি বলেন, ‘হারুন রিসোর্টের কথা বলে তার এক একর ১০ শতাংশ জায়গা নিয়েছেন। জমির কোনো দরদামও নির্ধারণ করা হয়নি। আমাকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। অথচ জমির দাম হবে অন্তত ২০ লাখ টাকা। আমার মতো এমন অন্তত আরও ১২ জন রয়েছেন, যাদের নামমাত্র টাকা দিয়ে জমি নিয়ে গেছে হারুন।’
দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান হারুন ২০তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০০০ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশে চাকরি পান। অথচ তার বাবা মো. হাসিদ ভূঁইয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় হারুন। দ্বিতীয় জিয়াউর রহমান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিদর্শক। তৃতীয় জিল্লুর রহমান পুলিশে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া হারুনের প্রতিষ্ঠিত বিলাসবহুল ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’-এর এমডি হিসাবে আছেন সবার ছোট শাহরিয়ার।
হারুন ১৯৯৮ সালে ছাত্রলীগের বাহাদুর-অজয় কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে একসময় চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন সময়ে নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে এলেও বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছেন।
নারী ঘটিত ইস্যুতেও সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন হারুন। মিডিয়াপাড়ার এক শ্রেণির নায়িকার সঙ্গে হারুনের ছিল ব্যাপক সখ্যতা। সম্প্রতি টিকটকার মামুন দাবি করেছেন— হারুনকে মেয়ে সাপ্লাই দিত আরেক টিকটকার লায়লা। তারা একসঙ্গে মদপানও করতেন। হারুনের যে মেয়েই ভালো লাগত, লায়লা সেটা ম্যানেজ করে দিত।’
(ঢাকা টাইমস/১১মে/এসএস/এসএ)

মন্তব্য করুন