উচ্ছৃঙ্খল হিজড়াদের দমাতে ডিএমপির অল-আউট অ্যাকশন

রাজধানীতে হিজড়াদের উৎপাত, দৌরাত্ম্য নতুন নয়। রাস্তার সিগনাল, যানবাহন, বাসাবাড়ি, দোকানপাটসহ আবাসিক এলাকায় হিজড়াদের চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রায় শোনা যায়। বিশেষ করে হিজড়াদের চাহিদামাফিক টাকা না দিলে নানা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে তারা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে।
সম্প্রতি রাজধানীর পরিবাগে দলবদ্ধ হিজড়াদের হামলায় এক পুলিশ সদস্যের চোখ নষ্ট হওয়ার ঘটনা এই গৌষ্ঠীকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। এমন উচ্ছৃঙ্খল হিজড়াদের দমনে অল-আউট অ্যাকশনে নেমেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ—ডিএমপি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হিজড়ার ছদ্মবেশ নেওয়া অনেক স্বাভাবিক পুরুষও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি আগের অপরাধ ঢাকতেও হিজড়ার ছদ্মবেশ নেয় কোনো কোনো পুরুষ ব্যক্তি। পরে তারা বিভিন্নভাবে চাঁদাবাজিতে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন। ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীতে অর্ধশতাধিক হিজড়ার আস্তানা আছে। এসব আস্তানায় ‘গুরু মা’র অধীনে ১৫ থেকে ২০ হাজার হিজড়া আছে। এরা দৈনিক লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে।
রাজধানীর বাড্ডা, গুলশান, বনানী, উত্তরা, পরিবাগ ফুটওভারব্রিজ, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, সংসদ ভবন এলাকা, চন্দ্রিমা উদ্যান, ধানমন্ডি লেক, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে রাতের আঁধার নামলেই এদের অনেকে দেহবৃত্তিতে নামে।
এছাড়া অনেক হিজড়া ছিনতাই ও মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। রাতে পথচারীরা রেহাই পায় না তাদের হাত থেকে। রাতে নগরীর কিছু কিছু ফুটওভারব্রিজ হিজড়াদের দখলে চলে যায়। পথচারীরা ব্রিজে উঠলে হিজড়াদের ডাকে সাড়া না দিলে টানাহ্যাঁচড়া শুরু করে দেয়।
সম্প্রতি রাজধানীর পরিবাগ এলাকায় একদল হিজড়াকে ছিনতাই কাজে বাধা দেওয়ায় তাদের হামলায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মোজাহিদুল ইসলামের একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে।
এ ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযান চালিয়ে পুলিশের ওপর হামলায় জড়িত চার হিজড়াকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া হিজড়ারা হলেন তানিয়া (১৯), তন্বী ওরফে তিথি (২১), কেয়া (২০) এবং সাথী ওরফে পাভেল (২০)।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) লিটন কুমার সাহা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অতীতে রাজধানীতে হিজড়াদের যে উৎপাত ছিল তা অনেকাংশে কমেছে। আগে তারা যেভাবে মোড়ে মোড়ে মানুষকে উত্ত্যক্ত করতো পুলিশের বাধার মুখে তা এখন অনেকটাই কম। কিন্তু বর্তমানে হিজড়ারা তাদের কৌশল বদলে দিনের পরিবর্তে রাতে বের হচ্ছে।’
পুলিশের অভিযানের সময় হামলার বিষয়ে ডিএমপির এ যুগ্ম কমিশনার বলেন, ‘হামলার ঘটনাটি তারা রাতে ঘটিয়েছে। উচ্ছৃঙ্খল এই হিজড়াদের বিরুদ্ধে অল-আউট অ্যাকশন শুরু করেছে ডিএমপি। আমাদের টার্গেট হিজড়াদের উৎপাত পুরোপুরি বন্ধ করা।’
ডিএমপির রমনা জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, ‘হিজড়ারা আমাদের সমাজের একটি অংশ। কিন্তু কিছু হিজড়া দুষ্টু, তারা কমিউনিটি নিয়ে চলে। তাদের সঙ্গে আবার কিছু সুস্থ মানুষও হিজড়ার বেশ ধরে চলে। তথাকথিত এসব হিজড়াকে আর ছাড় দেওয়া হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে যেসব হিজড়া চাঁদাবাজিতে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে বিগত ছয় মাস ধরে ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে আমরা খুব কঠোর অবস্থানে আছি। ডিএমপির আট বিভাগেই এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টিকারী হিজড়াদের আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। পরিবাগের ঘটনার পরে হিজড়াদের বিষয়টি আমাদের অবাক করে দিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, সকল লিঙ্গ এবং শারীরিক অবয়বের মানুষের জন্য পরিপূর্ণ সহ-অবস্থান অথবা সংস্কৃতি আমরা এখনো সমাজে চালু করতে পারিনি। এই না পারাটাই আমাদেরকে বিভিন্ন ভোগান্তির মধ্যে ফেলছে। সেইসঙ্গে এই না পারার আশ্রয় বা সুযোগ নিয়ে স্বাভাবিক মানুষও হিজড়া বেশ ধারণ করে মানুষকে হয়রানি করছে, পথে-ঘাটে টাকা তুলছে বা সরকারি সহায়তা গ্রহণ করছে।’
হিজড়াদের জন্য স্থায়ী এবং টেকসই জীবন প্রক্রিয়া তেরি করার গুরুত্ব তুলে ধরে ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘সমাজের কাউকে আমরা দূরে ঠেলে দিলে সে দূরে যাবে ঠিকই কিন্তু নানাভাবে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করবে। বেঁচে থাকা ও জীবিকার জন্য বিভিন্ন ধরনের অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে, মানুষকে হয়রানি করবে।’
‘এই সম্প্রদায়কে উন্নয়ন ও যুগের সাথে সম্পৃক্ত করার পরিবেশ এবং একইসঙ্গে তাদেরকে সামাজিকভাবে গ্রহণ করার প্রেক্ষাপট তৈরি করতে হবে। তবেই পরস্পর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে জীবন ধারণ করার প্রক্রিয়া তেরি হবে।’
ঢাবি শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘প্রশাসনকে এই অবস্থা বন্ধ করতে চাইলে হিজড়া সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়েই বন্ধ করতে হবে। তবে এটা শুধু প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার দায়িত্ব না, যেকোনো সচেতন বা সক্রিয় নাগরিকের এখানে দায় রয়েছে। এই শ্রেণির মানুষকে সমাজে সাদরে গ্রহণ করা এবং তাকে সমাজের সকলের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দিয়ে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্কের ভিত্তিতে সমাজে বেড়ে ওঠার বা বসবাসের পূর্বপ্রস্তুতি এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো তৈরি করা সম্ভব হলে আমরা সহজেই এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারব।’
(ঢাকাটাইমস/০৫জুন/ডিএম)

মন্তব্য করুন