মামলা বাণিজ্য করেই শত কোটি টাকা বানিয়েছেন সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:৫৪| আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২০:৩৯
অ- অ+

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ— সিআইডিতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আদালতের আদেশে সিআইডিতে আসা চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন মামলা তদন্তে ঘুষ আদায়ে ‘বিশেষ সিন্ডিকেট’ গড়ে তোলেন তিনি।

গত দু’বছরে তার নির্দেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় মূল আসামিদের নাম বাদ দিয়ে চার্জশিট দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলাটি অন্যতম।

তাছাড়া অনেক মামলায় তদন্তে নাম আসা আসামিদের বাদ দিয়ে চার্জশিট দেওয়া, সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও মামলায় আসামি করা— এমন অনেক অভিযোগ আছে মোহাম্মদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে। তার অনৈতিক নির্দেশনা মেনে যেসব কর্মকর্তা কাজ করতে রাজী হননি তাদেরকে হয় বদলি অথবা ডেকে নিয়ে হেনস্তা করতেন।

অভিযোগ রয়েছে, অনুসন্ধান, তদন্ত, আসামি গ্রেপ্তার সবই মোহাম্মদ আলীর পছন্দ অনুযায়ী করতে হতো। ডিআইজি থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত কারও কথা বলার ক্ষমতা ছিল না। সিআইডিতে নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। এই সিন্ডিকেট দিয়ে শতাধিক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করার উদ্যোগ নেন। ওই ব্যবসায়ীদের সিআইডিতে তলব করে চিঠি পাঠানো হয়। তাদেরকে মামলার ভয় দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করার উদ্যোগ নিলেও সরকার পতনের পর বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়ায় তার সেই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ১৩ আগস্ট মোহাম্মদ আলীকে সিআইডি থেকে সরিয়ে পুলিশ সদরদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। এরপর গত ২২ আগস্ট তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এরপর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় যাত্রাবাড়ী থানায় দুই আন্দোলনকারীর মৃত্যুর ঘটনায় হওয়া হত্যা মামলায় তাকে আসামি করা হয়। এরপর থেকে মোহাম্মদ আলীর খোঁজ নেই।

অভিযোগ রয়েছে, অভ্যুত্থানে গণহত্যায় পুলিশের অতি উৎসাহী কর্মকাণ্ডে নেপথ্যে থেকে নানা ধরনের ভূমিকা পালন করেছেন সাবেক এই অতিরিক্ত আইজিপি। সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে তিনি অতিরিক্ত আইজিপির পদ পাওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কাজ করেছেন পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে। সিআইডি থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র সরিয়েছেন।

সিআইডির একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন, সিআইডি প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে মোহাম্মদ আলী সিআইডির ওয়ান ম্যান পুলিশ হয়ে উঠেন। বিভিন্ন ইউনিটের ডিআইজি, বিশেষ পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের তিনি এড়িয়ে সরাসরি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শকদের ডেকে তার কথা মতো কাজ করতে হুকুম দিতেন। কেউ কথা না শুনলে তাকে বদলি করে দিতেন অথবা সিআইডি থেকে সরিয়ে দিতেন। ২ বছরের বেশি সময় ধরে সিআইডির সব কর্মকাণ্ড তার একক নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। সিআইডির ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসপি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, মোহাম্মদ আলী মিয়া দেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ার পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। দুবাইয়ে ব্যবসায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগও করেছেন তিনি। গুলশান ডিসিসি মার্কেটের এক ব্যবসায়ী নেতা মোহাম্মদ আলীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওই ব্যবসায়ীর মাধ্যমে গত ২ বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে থেকে পাচার করেছেন; যা দুবাইয়ে তার ব্যবসার বিনিয়োগ করেছেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামিদের কাছ থেকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ নিয়েছেন। কোন মামলা চার্জশিট দেওয়া হবে, কোন মামলা চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হবে, চার্জশিট থেকে কার নাম বাদ যাবে, কার নাম যুক্ত হবে সব একাই সিদ্ধান্ত দিতেন মোহাম্মদ আলী। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ঘুষ নিতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেন তিনি।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গত বছরের শেষে দিকে মোহাম্মদ আলী ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে যান। এরপর নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে অতিরিক্ত আরও এক সপ্তাহ ছিলেন দেশের বাইরে। দুবাই, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশে অবস্থান করার জন্য সরকারের কোন অনুমতিও নিতে হয়নি তাকে। সেখান থেকে দেশে ফিরে একদিন রাতে সিআইডিতে তার দপ্তরে বিশেষ সভা করেন। ওই সভায় বিভিন্ন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের রুমে ডেকে টাকা চান তিনি। প্রত্যেক মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের যেকোনোভাবে টাকা আদায় করে তাকে দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন।’ সংশ্লিষ্ট ইউনিটের ডিআইডি অতিরিক্ত ডিআইজি এবং পুলিশ সুপারদের না জানিয়ে তিনি সরাসরি পরিদর্শক ও এসআইদের নিয়ে মিটিং করায় তা নিয়ে সিআইডিতে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল।

সিআইডির প্রধান হওয়ার পর ওয়ানম্যান হয়ে উঠেন মোহাম্মদ আলী

বিসিএস ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান করা হয়। এর আগে তিনি টুরিস্ট পুলিশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া মোহাম্মদ আলী পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মেট্রো (সিটি এসবি) ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আগে ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি, নরসিংদী, হবিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের জেলা পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বে ছিলেন।

সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ছিল সিআইডি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সিআইডি হয়ে উঠেছিল ডাম্পিং পোস্টিংয়ের জায়গা। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সিআইডি বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যায়। প্রতারণা, অর্থপাচার, মানব পাচারের মতো ঘটনা অনুসন্ধান ও তদন্তের পাশাপাশি আদালত থেকে অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত আসত সংস্থাটিতে। মোহাম্মদ আলী সিআইডি প্রধান দায়িত্ব পাওয়ার পর পেশাদার ও সৎ কর্মকর্তাদের সিআইডি থেকে সরাতে থাকেন। নিজের পছন্দের লোকজনকে সিআইডিতে পোস্টিং ও গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে পদায়ন করেন। সাইবার পুলিশ সেন্টার, অর্গানাইজড ক্রাইম, ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটসহ সব ইউনিটে মোহাম্মদ আলীর সময়ে মামলার সংখ্যা যেমন কমতে থাকে। পাশাপাশি কমে অনুসন্ধান ও তদন্ত। আসামি গ্রেপ্তারসহ বিভিন্ন অভিযোগের ঘটনায় অপারেশনের সিদ্ধান্ত মোহাম্মদ আলী একা দিতেন।

এছাড়াও তিনি সরাসরি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের রুমে ডেকে নিয়ে মিটিং করতেন। অথচ মামলার তদন্ত তদারকি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপার ও সংশ্লিষ্ট ইউনিটের ডিআইজিরা কিছুই জানতেন না। তাদের না জানিয়ে সরাসরি তদন্ত কর্মকর্তাদের কোন মামলায় কত টাকা দিতে পারবে তার জন্য চাপ প্রয়োগ করতেন। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন তার নির্দেশনা অনুযায়ী দিতে হতো।

সিআইডির জন্য যে টাকা সরকারিভাবে বরাদ্দ ছিল সেই টাকায় সিআইডির জন্য কেনাকাটাও ছিল মোহাম্মদ আলীর একক নিয়ন্ত্রণে। সংশ্লিষ্ট ডিআইজি, পুলিশ সুপারদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলায় আসামিদের বাদ দিতে চাপ

২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় জড়িত হিসেবে মামলার তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভাবশালী ১৪ কর্মকর্তার নাম উঠে আসে সিআইডির তদন্তে। তদন্ত থেকে ওই ১৪ কর্মকর্তার নাম বাদ দিয়ে চার্জশিট দিতে ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করা হয় তদন্ত তদারকি কর্মকর্তাকে। সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া মামলার আসামিদের ঘনিষ্ঠ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সামনেই তদন্ত তদারকি কর্মকর্তাকে এ চাপ প্রয়োগ করেন। এছাড়াও মোহাম্মদ আলী মিয়ার সামনেই আসামিদের ঘনিষ্ঠ বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউর সাবেক প্রধান কর্মকর্তা মাসুদ বিশ্বাস এবং সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তাকে দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন।

মামলা তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলায় নয়, সিআইডিতে হওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় অর্থের বিনিময়ে আসামি করা, প্রকৃত অপরাধীদের মামলার চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশনা থাকতো মোহাম্মদ আলীর। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে তার পছন্দ অনুযায়ী তদন্ত এবং চার্জশিট দেওয়ার নির্দেশনা দিতেন।

আগামীকাল পড়ুন সিন্ডিকেট গড়ে যেভাবে মামলা ও অর্থ আদায় করতেন মোহাম্মদ আলী মিয়া

(ঢাকাটাইমস/০৮এপ্রিল/এসএস/এমআর)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
কলকাতায় হোটেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ১৪ জনের মরদেহ উদ্ধার
তিন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতিতে সরকারের সংশ্লিষ্টতা? যা বললেন উপদেষ্টা ফারুকী
ভেষজ ঔষধি ঢেঁড়স ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়
গরমে স্বাস্থ্য রক্ষায় কোন পাত্রে কতটুকু পানি পান করা নিরাপদ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা