মানসিক অবসাদের সাতকাহন

ডা. অঞ্জন বিশ্বাস কাব্য
| আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০১৭, ১০:০০ | প্রকাশিত : ১১ জানুয়ারি ২০১৭, ০৯:৩৩

ডিপ্রেসন বা মানসিক অবসাদের কথা আমরা আজকাল প্রায়ই লোকের মুখে শুনে থাকি। অনেকেই হয়ত কম বেশি এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছেন। কেউ কেউ প্রায় সময়ই বলে থাকেন মন ভালো নেই, সেটা কি ডিপ্রেসন না অন্য কিছু, যেমন মনে আনন্দ নেই, সেটা যে কারণেই হোক না কেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে কেউ কোনো কাজে অসফল হয়েছে তার জন্য মন খারাপ, বা কেউ পরীক্ষায় ফেল করেছে তার জন্য মন খারাপ, বা কেউ ভালোবাসায় ব্যর্থ হয়েছে তার জন্য মনে আঘাত লেগেছে। এই অবস্থাগুলোকে কি ডিপ্রেসন বলা যাবে? হয়ত কিছু কিছু ক্ষেত্রে বলা যাবে যদি দৈনন্দিন কাজ কর্ম ব্যাহত হয়, আর মনে বিশেষ কষ্ট হয় তাহলে। এই বিষন্ন অবস্থা অনেক সময় ভুক্তভোগী নাও বুঝতে পারে, যদিও তার খুব অসুবিধা হয়।

বিষন্নতা বা মানসিক অবসাদের কী কী উপসর্গ?

ডিপ্রেসনের প্রধান উপসর্গ হলো, ভালো না লাগা, বা ইংরাজিতে যাকে বলে লো মুড (Low mood)। কিন্তু কারও কারও ডিপ্রেসন না হয়ে খিটখিটে বা রাগের ভাব বেশি হতে পারে। আরো উপসর্গগুলো নিচে দেয়া হলো:

১. বেশিরভাগ সময় মন ভালো না লাগা, বা কারও কারও সব সময় রাগ বা খিটখিটে মেজাজ।

২. ঘুমের অসুবিধা, যেমন, প্রথম রাত্রিতে ঘুম ঠিক এসে যায়, কিন্তু মাঝ রাত্রিতে বা খুব সকালে ঘুম ভেঙে যায়, তারপর যার ঘুম আসে না। আবার ঘুমটা ভাঙা ভাঙাও হতে পারে।

৩. খেতে ইচ্ছা না করা, তার জন্য দেহের ওজন কমে যেতে পারে। আবার কেউ কেউ মন খারাপের জন্য অনেক বেশি খেয়ে বেশ মোটা হয়ে যেতে পারে। তারা আবার বেশি ঘুমায়ও।

৪. আগে যা যা করতে ভালো লাগত তা আর ভালো লাগে না, যেমন গান শোনা, বই পড়া, বা সিনেমায় যাওয়া, বা বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদি। এমনকি যৌনকাঙ্ক্ষাও কমে যায়।

৫. নিজেকে গুটিয়ে ফেলে, বন্ধুবান্ধব, বা আত্মীয় স্বজন কারো সাথে মেলামেশা না করা।

৬. কাজে না যাওয়া, বা পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়।

৭. অনেকে বলেন স্মৃতি শক্তি কমে গেছে, কিছু মনে থাকে না, ঠিক মতো মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারেন না। তার জন্য কাজে ভুল হতে পারে। কাজ সম্পূর্ণ করতে অনেক বেশি সময় নিতে পারে।

৮. কেউ কেউ বলেন, যখন ডিপ্রেসনের মাত্রা বেশি হয়, যে বেঁচে থেকে লাভ নেই। মরে যাওয়াই ভাল। এই সময় অনেকে আত্মহত্যা করে ফেলতে পারেন।

৯. আমাদের দেশে ডিপ্রেসন হলে অনেকে বলেন, গা, হাত পা ব্যথা করছে, মাথা ব্যথা সব সময়। যাদের ডিপ্রেসনের সাথে টেনশন থাকে তারা বলেন, বুক ধড়ফড় করছে, গা, হাত পা ঝিন ঝিন করছে, যেন সাংঘাতিক কোনো দুরর্ঘটনা ঘটে যাবে। এক মুহূর্তের জন্য শান্ত থাকতে পারেন না। ভারতবর্ষে বা তার আশপাশের দেশ গুলোতে অবসাদের রোগীরা আরো নানা রকম শারীরিক উপসর্গ যেমন, হজমে গণ্ডগোল, মাসিকে গণ্ডগোল বা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্ন, ইত্যাদিও হয়। তার জন্য রোগী অনেক সময় চিকিৎসার জন্য জেনারেল ডাক্তারের কাছে যায়।

১০. এমনও দেখা গেছে অবসাদ অবস্থা যখন খুব বেশি হয় তখন রোগী কানে নানা কথা শুনতে পারে (হ্যালুসিনেসন,) যেমন কেউ যেন বলছে, ‘ তোমার বেঁচে থেকে লাভ নেই,এখনই মরে যাও, তুমি অনেক পাপকাজ করেছ, ইত্যাদি। এই সময় রোগী ওই কথাগুলোকে সত্যি মনে করে আর তাতে আত্মহত্যা করার প্রবণতা অনেক বেশি হয়।

ডিপ্রেসন কাদের হয়?

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে ডিপ্রেসন বা মানসিক অবসাদ ভোগেন এমন রোগীর সংখ্যা এমন কিছু কম নয়, এবং বেশির ভাগ রোগীরই চিকিৎসা করা হয় না কারণ তারা বুঝতে পারে না যে তাদের ডিপ্রেসন হয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে সারা বিশ্বে যেকোনো সময় প্রায় দশ কোটি মানুষের ডিপ্রেসন হয়, কিন্তু তার মধ্যে মাত্র এক কোটি রোগী ডাক্তারের কাছে যায় চিকিৎসা করাতে। মানসিক অবসাদের এই অবস্থা নারী পুরুষের মধ্যে প্রায় সমান সংখ্যায় হয়, যদিও পুরুষদের মধ্যে ডিপ্রেসন বেশি হয় বৃদ্ধ অবস্থায়। যেকোনো বয়সে এই মানসিক অবসাদ হতে পারে, এমনকি দশ বছরের কম শিশুদের মধ্যেও। শিশু বা বয়ঃসন্ধিক্ষনে ডিপ্রেসনের উপসর্গগুলো অনেকটা আলাদা হয়।

ডিপ্রেসন বা অবসাদ কিভাবে প্রভাব ফেলতে পারে?

কারও মানসিক অবসাদ হলে তার জীবনে বেশ গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, যেমন—

১. কাজকর্মে অসুবিধা, নানা ভুল করতে পারে, কাজে মন না লাগার জন্য কাজে দেরি হওয়া, কাজে না যাওয়া, ইত্যাদি। কাজ না করার জন্য পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।

২. পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে না। ছেলে মেয়েদের দেখাশোনা ইত্যাদি ঠিকমত করতে পারে না।

৩. বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয় স্বজনের থেকে দূরে সরে যায়।

৪. যদি উঠতি বয়সের সময় এই অবসাদ হয় তখন তারা পড়াশোনায় মন দিতে পারে না, প্রায় রাগ ভাব আব ছটফটে ভাব হয় বা একদম নিস্তেজ ভাব হয়ে যায়। এতে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তে পারে, সেটা আর কখনো মেকাপ করতে পারে না, যদি না সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করা হয়।

৫. কেউ কেউ আবার নানা ড্রাগ নেয়া শুরু করতে পারে, তখন ডিপ্রেসনের মাত্রা আরো বাড়তে পারে। অনেকে ভাবেন অ্যালকোহল খেলে হয়ত মনের অবসাদের ভাবটা কেটে যাবে। কিন্তু তাতে ডিপ্রেসনের মাত্রা আরো বেশি বেড়ে যায়। এমনকি আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেড়ে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে মানসিক অবসাদের জন্য রোগীর জীবনে সব ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলে।

ডিপ্রেসন বা অবসাদ কেন হয়?

দেহের কোনো কারণের জন্য বিষন্নতা হতে পারে কি?

অনেক পরীক্ষায় বা গবেষণায় পাওয়া গেছে যে শারীরিক কিছু পরিবর্তনের জন্য মনের বিষন্নতা আসতে পারে। যেমন—

১. ব্রেনের বা মস্তিষ্কের নানা নিউরোট্রান্সমিটারের পরিবর্তনের জন্য অবসাদ হতে পারে।

নানা নিউরোট্রান্সমিটারের মধ্যে দুটি বিশেষ উল্লেখ যোগ্য, যেমন নর এপিনেফ্রিন( norepinephrine) ও সেরোটোনিন (serotonin)। নিউরোট্রান্সমিটার হলো এক রকমের কেমিক্যাল যেটা সাধারণত নার্ভকোষে সব সময় তৈরি হয়ে চলেছে। যখন নার্ভ এর উত্তেজনা হয় তখন সেটা বাইরে বেরিয়ে এসে অন্য নার্ভকে উত্তেজিত করে, এই ভাবে এক নার্ভ থেকে অন্য নার্ভে যোগাযোগের জন্য আমরা সব অনুভূতি পাই। এই নর এপিনেফ্রিন ( norepinephrine) এর ওপর প্রভাব ফেলে ভেনলাফাক্সিন (Venlafaxine) নামক ঔষধ যেটা ডিপ্রেসনের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। সেই জন্য মনে করা হয় নর-এপিনেফ্রিন যে নার্ভকোষের উপর কাজ করে তার বেশি ক্রিয়ার জন্য ডিপ্রেসন হয়।

নার্ভে সেরোটোনিন(serotonin) এর কম হওয়ার জন্য হয়ত ডিপ্রেসন হয়।

কারণ দেখা গেছে ফ্লুওক্সেটিন (Fluoxetine) নামক ডিপ্রেসনের ঔষধ ব্রেনে সেরোটোনিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য মনের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তাই মনে করা হয়, সেরোটোনিন এর পরিমান কমে যাওয়ার জন্য হয়ত এই রোগটা হয়। শেষ কয়েক দশকে আরো কয়েক রকমের সেরোটোনিনের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো আরো নানা ভাবে মনের উপর প্রভাব ফেলে।

ডোপামিন (Dopamine) আরেক রকমের নিউরোট্রান্সমিটার যেটা কম হওয়ার জন্য হয়ত ডিপ্রেসন হয়। কারণ দেখা গেছে, টাইরোসিন (tyrosine) নামক অ্যামিনো অ্যাসিড, অ্যাম্ফিটামিন (amphetamine), বা বিউপ্রোপিওন (Bupropion) ইত্যাদি ব্রনের মধ্যে ডোপামিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, তার জন্য এই ঔষঢগুলোকে ডিপ্রাসনের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার আমরা জানি যে পারকিনসন স্নায়ু রোগের (Parkinson’s disease) কারণ হলো ব্রেনের কিছু স্থানে বা সেন্টারে ডোপামিন কম হওয়া। সেই জন্য অনেক পারকিনসন রোগীর ডিপ্রেসন হয়। উপরের যে নিউরোট্রান্সমিটার গুলো বলা হলো তাছাড়াও আরো নিউরোট্রান্সমিটার আছে যেমন, অ্যসিটাইলকোলিন (Acetylcholine) , গাবা (GABA, Gama Amino Butyric Acid), ইত্যাদি ডিপ্রেসনের কারণ হতে পারে।

২. হরমোনের কম বেশি হওয়ার জন্যও ডিপ্রেসন হতে পারে।

যেমন থাইরয়েড (thyroid hormone ) হরমোন ও গ্রোথ (Growth hormone ) হরমোন কম হলে ডিপ্রেসন হয়। এছাড়া আরো নানা হরমোন আছে যার পরিমাণের কম বেশি হওয়ার জন্য মনে ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, সেগুলো আর বলা হলো না। হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটার কিভাবে কাজ করে,এবং কি ভাবে ডিপ্রেসন হয় এটা খুব জটিল, আর উপরের কারন গুলো খুব সরলভাবে বর্ননা করা হলো।

৩) ব্রেনের আকৃতির পরিবর্তন

ক্যাট স্ক্যান (CAT Scan) বা এম আর আই(MRI) করে ব্রেনে নানা পরিবর্তন পাওয়া গেছে, যেমন ভেন্ট্রিকল বড় হয়েছে, ব্রেনের কিছু জায়গায় নার্ভ শুকিয়ে গেছে, ইত্যাদি সেগুলো আবার সব রোগির ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি। আবার পেট স্ক্যান (PET scan) করে পাওয়া গেছে যে যাদের ডিপ্রেসন হয়েছে তাদের ব্রেনের কিছু কিছু জায়গায় রক্তের চলাচল কমে গেছে। যখন ডিপ্রেসনের থেকে সেরে উঠেছে তখন আবার রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই সব পরিবর্তন কিছু কিছু ডিপ্রেসনের রোগীর ব্রেনে পাওয়া গেছে, সবার ডিপ্রেসন রোগীর মধ্যে পাওয়া যায়নি।

ডিপ্রেসন বা বিষন্নতা রোগ কি বংশগত?

ফ্যামিলি স্টাডি, যেসব শিশুদের দত্তক নেয়া হয়েছে তাদেরকে, এবং যমজ ছেলে মেয়েদের বেশ কয়েক বছর লক্ষ্য করার পর জানাগেছে যে, আমাদের এই মুডের (Mood) এর কারন অনেকটা বংশগত। যদি মা বা বাবার কোন একজনের ডিপ্রেসন বা ম্যানিয়া থাকে তাহলে তাদের সন্তানদেরও ওই ডিপ্রেসন বা ম্যানিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ১০ থেকে ২৫ শতাংশ। আর যদি পিতা মাতার দুজনেরই মুড প্রবলেম আছে তাহলে সন্তানদের হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুন হয়ে যায়।যমজ( যারা একদম একরকম) এক জনের যদি ডিপ্রেসন বা ম্যানিয়া থাকে তবে অন্য যমজ সন্তানের হওয়ার সম্ভাবনা ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ। যমজ (অথচ একদম একরকম নয়) তাদের একজনের যদি হয় তবে অন্য জনের হওয়ার সম্ভাবনা ১৬ থেকে ৩৫ শতাংশ। সুতরাং এর থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছে যে বংশগত কারণ একটা প্রধান কারণ।

ডিপ্রাসন কি সামাজিক কোনো কারণে হয়?

জীবনের ও পারিপার্শিক নানা কারনে মানসিক চাপের জন্য এই বিষন্নতা ভাব আসতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন জীবনের নানা ঘাতপ্রতিঘাত ও মানসিক চাপের জন্যই ডিপ্রেসন হয়। আর কেউ কেউ মনে করেন এই মানসিক চাপ ডিপ্রেসন করার জন্য এমনকিছু প্রভাব ফেলে না।

লক্ষ্য করা গেছে যে কোনো শিশু যদি এগারো বছর বয়সের আগে তার মা বাবার একজনকে হারায় তবে তাদের বড় হয়ে বিষন্নতা বা অবসাদ অবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। এটা প্রায়ই দেখা যায় বিশেষ কোনো ক্ষতি হলে বা বিশষ কিছু হারালে ডিপ্রেসনের আরম্ভ হয়। যেমন নিকট কোনো আত্মীয় স্বজন হারালে বা মৃত্যু হলে, হঠাৎ বেশি টাকার কোনো লোকসান বা হারালে, বা চাকরি হারালে বা অবসর নিলে(বিশেষ করে যদি পরিবার স্বচ্ছল অবস্থায় না হয়), বিবাহ বিচ্ছেদ বা ভালবাসায় বিচ্ছেদ হলে, এমনকি পরীক্ষায় অসফল হলে, ইত্যাদি। কোন কারনে ডিপ্রেসন হবে তা অনেকটা নির্ভর করে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন কারণের ওপর বিশেষ গুরুত্ত দেয়ার জন্য।

বিশেষ চিন্তার পরিবর্তনে কি ডিপ্রেসনের কারণ হতে পারে?

বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট অ্যারন বেক(Aaron Beck)এর মতে, ডিপ্রেসনে ভোগেন সেই সব রোগীদের চিন্তার কিছু পরিবর্তন হয় যেমন:

তারা নিজেদের সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারনা থাকে যেমন ভাবে তাদের দ্বারা কিছু হবে না,তারা অপদার্থ ইত্যাদি,

পারিপার্শিক অবস্থা সম্বন্ধে ভাবে যে সেটা ভীষণ এবং অনেককিছু আশা করে তার কাছ থেকে।

ভবিষ্যত সম্বন্ধে ভাবে সব সময় তাদের হার হবে আর তাদের ভুগতে হবে। সেই মনে করা হয় যদি এই ভুল ধারনা গুলো থেরাপি করে ঠিক করা যায় তবে ডিপ্রেসনেরও উপশম হবে।

ডিপ্রেসন কি একটা অসহায় অবস্থা যেটা মানুষ জীবন ধারনের মধ্যে শেখে?

মনে করা হয় যদি কেউ পরের পর খারাপ অবস্থার বা মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে থাকে তবে তাদের মধ্যে এই অবস্থার সৃস্টি হতে পারে। তখন সে ভাবে তার আর এই খারাপ অবস্থার মধ্যেদিয়ে বেরোনোর উপায় নেই, হতাশ হয়ে যায়, সব আত্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেলে।সেই অবস্থাকে ডিপ্রেসন বলা হয়। সুতরাং একে বলা যেতে পারে বার বার আঘাতের জন্য এক অসহায় অবস্থা।

মনে রাখা দরকার কোনো একটা বিশেষ কারনে ডিপ্রেসন হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনেকগুলো কারন এক সঙ্গে কাজ করে। আবার আর এক রকমের বিষন্নতা আছে যেটার কোন কারন নেই, সেটাকে বলা হয় মেলানকোলিক ডিপ্রেসন (Melancholic depression). এতে রোগীর মনের মধ্যে একদম আনন্দ থাকে না,অনেক সকালে ঘুম ভেঙ্গে যায়, খাওয়া দাওয়া কম করার জন্য বেশ রোগা হয়ে যায়, আর মনের মধ্যে খুব অনুশোচনা ভাব থাকে(এমনকি খুব ছোট কিছুর জন্যও)। এদের কেউ কেউ আত্মহত্যার করার কথাও বলেন।এদের কোনো কোনো সময় নানা হরমোনের গণ্ডগোল থাকতে পারে।

ডিপ্রেসনের সাথে আর কি কোনো উপসর্গ থাকতে পারে?

ডিপ্রেসনের সঙ্গে বেশির ভাগ সময়েই আরো নানা উপসর্গ থাকে, যেমন—

কারো কারো উদ্বিগ্ন ভাব থাকে, যেমন বলে এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারে না। নানা শারীরিক উপসর্গ থাকে যেমন, বুক ধড় ফড় করা, মাথা ঝিম ঝিম করা, অনেকটা প্যানিক অ্যাটাকের মত।

কারো কারো নানা রকম বাতিক থাকে যেমন, ধোয়া ধুয়ি বাতিক, গোনা বাতিক, রোগের বাতিক, নিয়মের বাতিক ইত্যাদি।

এর সঙ্গে কেউ কেউ কানে নানা কথা শুনতে (হ্যালুসিনেসন) পান, যেন কেঊ তাদের নানা দোষারোপ করছে, বা তাদের সমালোচনা করছে ইত্যাদি হতে পারে।

কেউ কেউ নানা ড্রাগ ব্যাবহার করতে পারে, তার জন্য এই ডিপ্রেসন হতে পারে।

কারো যদি কোনো ক্রনিক কোনো রোগ অনেকদিন ধরে থাকে, তবে তাদেরও ডিপ্রেসন বা বিষন্নতা হতে পারে।

সন্তানপ্রসবের পর ডিপ্রেসন বা বিষন্নতা ভাব

সন্তানপ্রসবের পর কম বেশি মন থারাপ হওয়া প্রায়ই হয়ে থাকে। সেই অবস্থাটা সাধারনতঃ কয়েক সপ্তাহ থেকে মাস দুয়েকের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। যদি এই বিষন্নতা ভাব খুব বেশি হয়, তখন নিম্নলিখিত উপসর্গগুলো থাকেঃ

মনে ডিপ্রেসনের ভাব, আনন্দফুর্তি লাগে না। সন্তানকে দেখা শোনা পর্য্যন্ত করে না, খাওয়া দাওয়া কম করে বা বন্ধ করে দিতে পারে। ঘুমের অসুবিধা হয়।

মনে করতে পারে বাচ্চার বা সন্তানের কোনো দারুণ অসুখ করেছে

এমনকি কোনো কোনো মা আত্মহত্যা পর্য্যন্ত করে ফেলে, বাচ্চাকেও মেরে ফেলতে পারে।এই রকম অবস্থা হলে বাচ্চাকে মায়ের কাছথেকে আলাদা রাখা দরকার ও মায়ের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করা দরকার। কোনো মায়ের সন্তান সম্ভবা হওয়ার আগেই তাদের যদি ডিপ্রেসন থাকে, তাদের ডিপ্রেসনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। যাদের আগের ডিপ্রেসন অবস্থা ছিল, কিন্তু সেরে গেছিল, তাদের সেই বিষন্নতা অবস্থা আবার সন্তান হওয়ার পরে হতে পারে।

ডিপ্রেসন আত্মহত্যা

আত্মহত্যার একটা বিশেষ কারন হল ডিপ্রেসন বা বিষন্নতা অবস্থা। সেই জন্য ডিপ্রেসন হলেই বিশেষ করে খেয়াল রাখতে হবে এই আত্মহত্যার কথা। প্রচলিত ধারনা আছে যে আত্মহত্যার কথা জিজ্ঞাসা করলে নাকি আত্মহত্যার প্রবনতা বেড়ে যায়। এর কোনো সঠিক প্রমান পাওয়া যায় নি।

কোনো ডিপ্রেসনের রোগীর আত্মহত্যার করার প্রবণতা বাড়ে যদি:

সে পুরুষ হয়, অবিবাহিত বা একা থাকেন বা পত্নিবিয়োগ হয়েছে

ডিপ্রেসনের মাত্রা বেশি হয়, যেমন কানে নানা কথা শুনছেন যে ‘বেচে থেক কি লাভ, মরে যাওয়াই ভাল ইত্যাদি’। বা বলছেন যে ‘আগে অনেক পাপ করেছেন, বা দুর্নিতি করেছেন তার জন্য ভুগতে হচ্ছে, বা পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে, ইত্যাদি।

বলেন ভবিষ্যতে আর আশা নেই, অসহায় অবস্থা প্রকাশ করছেন সব সময়। বলছেন কেউ তাকে আর ঠিক করতে বা সাহায্য করতে পারবে না।

আত্মহত্যা করার আগে তাঁরা বেশ প্ল্যান করেই করেন। অনেকেই মরার আগে সুইসাইড নোট লিখে রেখে যান।

যারা আগে আত্মহত্যা করতে গিয়ে অসফল হয়েছেন, তারা পরের বার আরও সাংঘাতিক রকমের আত্মহত্যার চেস্টা করেন। সুতরাং এটাও ভুল ধারনা যে যারা একবার আত্মহত্যায় অসফল হয় তারা আর আত্মহত্যার চেষ্টা করে না।

কোনো না কোনো ভাবে আগে কাউকে আত্মহত্যার কথা বলে থাকেন এই সব ডিপ্রেসনের রোগিরা।তাই সব সময় সতর্ক থাকা দরকার।

ডিপ্রেসনের রোগীর অ্যালকোহলের নেশা থাকলে, আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়।

লেখক: সিইও অব ডিএমসি, শাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, গুলশান, ঢাকা

সংবাদটি শেয়ার করুন

স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

স্বাস্থ্য এর সর্বশেষ

ক্যানসারের ঝুঁকি ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমায় তালের শাঁস! ডায়াবেটিসও রাখে নিয়ন্ত্রণে

পরিচিত যেসব খাবার ফুসফুসের সুস্থতার জন্য মহৌষধ

দেশে প্রয়োজনের তুলনায় নার্সের ঘাটতি ৩ লাখ ১২ হাজারের অধিক

‘বাত ব্যথার উপযুক্ত চিকিৎসা না করলে ঝুঁকিতে পড়বে জীবন’

২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আরও ৬ জন

কিডনি নষ্ট হচ্ছে গোপনেই! যেসব লক্ষণ দেখলে মোটেই অবহেলা নয়

দেশে ‘লং কোভিড’ নিয়ে বড় পর্যায়ের গবেষণার তাগিদ

দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জানতে জরিপ চলছে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস আজ: প্রতিরোধে প্রয়োজন দুই বাহকের বিয়ে বর্জন

শিবনারায়ণ দাশের চোখে আলো দেখছেন মশিউর-আবুল কালাম

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :