মহান মে দিবস: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

অনলাইন ডেস্ক
 | প্রকাশিত : ০১ মে ২০১৭, ০৯:২৯

১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য বিজয়ের দিবস হিসেবে দিনটি উদযাপিত হয়। আমাদের দেশেও কখনো আন্দোলন, কখনো উৎসবের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। কিন্তু মে দিবস চলে যাওয়ার পরেই শ্রমিকরা তাদের আগের অবস্থায় চলে যায়। প্রতি বছর দিবসটি উদযাপিত হলেও শ্রমিকরা থেকে যায় তাদের প্রবঞ্চনাময় অতীতের ইতিহাসে।

শ্রমিকদের প্রতিবাদী সমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষণে ছয় শ্রমিকের জীবনদান মে দিবসের ইতিহাস। দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমসময়ের দাবিতে এবং নূন্যতম মজুরি বৃদ্ধি ও কাজের উন্নত পরিবেশ,শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নসহ বিভিন্ন দাবিতে আমেরিকার শিকাগোতে শ্রমিকরা অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেয়। মালিকপক্ষের ভাড়াটে লোকজন সেখানে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে উভয়পক্ষের বেশ কয়েকজন হতাহত হন। আগস্ট মাসে স্পাইস নামক এক শ্রমিক নেতাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হলেও থেমে থাকেনি শ্রমিকদের আন্দোলন। শ্রমিকরা আন্দোলনে বিজয়ী হয় এবং শহীদের রক্তের বিনিময়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে পৃথিবীতে মে দিবস আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

সোভিয়েত ব¬কভুক্ত সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত ব্যাপকভাবে পালিত হয়। ঠিক একইভাবে পুঁজিবাদী দেশসমূহেও পালিত হয় অধিকার আদায়ের আন্দোলনের শপথে।

আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে শ্রমিক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে মূলত বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফার প্রেক্ষিতে। দেশের মানুষের শোষণ মুক্তির আন্দোলন, শ্রমিকের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও স্বাধিকারের আন্দোলন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জের আদমজীতে ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে এই আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। ৬ জুন ১৯৬৬ সালে শহীম মনু মিয়ার আত্মদানের মধ্য দিয়ে তৎকালীন শ্রমিক আন্দোলন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মূল ধারার সূচনা করে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন ছিল। মূলত ট্রেড ইউনিয়ন ভিত্তিক দাবি দাওয়া নিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলি আন্দোলন করলেও পরবর্তীতে সকল আন্দোলন মূল রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা পর সামরিক শাসন জারি হলে শ্রমিকরাই প্রাথমিকভাবে প্রথম সংগঠিত হয়। এরপর আসে এরশাদের সামরিক শাসন। শ্রমিক সংগঠনগুলি শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে যৌথ মোর্চা গড়ে তুলে। ছাত্র আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলন পাশাপাশি এগিয়ে চলে। রাজনৈতিক দলসমূহের আন্দোলন যখনেই মুখ থুবড়ে পরেছে তখনেই হয় শ্রমিক আন্দোলন, না হয় ছাত্র আন্দোলন রাজপথের শূন্যতা পূরণ করেছে। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে শ্রমিক নেতা তাজুল ইসলামসহ অনেক শ্রমিক আত্মহূতি দিয়েছেন।

স্বৈরাচারের পতনের পর তেমন কোনো শ্রমিক আন্দোলন আর দানা বেঁধে উঠেনি। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আই এম এফ-এর সুপারিশে বেগম খালেদা জিয়া সরকার আদমজিসহ অন্যান্য শিল্প-প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণের নামে বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশে এখন আর শ্রমিকদের সংগঠিত শিল্পাঞ্চল বাস্তবে অবস্থান করে না। একমাত্র গার্মেন্টস সেক্টরের শ্রমিকরা তাদের অধিকারের দাবিতে মাঝে মাঝে স্বোচ্চার হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকরা যে কতটুকু অসহায় তা বোঝার জন্য খুব বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন পরে না।

স্পেকটার্ম ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় সহস্রাধিক শ্রমিক প্রাণ হারায়। আহত হয় আড়াই হাজারের মতো শ্রমিক। শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয় কিন্তু মূল্যস্ফীতি ও দ্রুব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্ধিত বেতন কোনো সুফল বয়ে আনে না। শ্রমিকদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ৮ ঘণ্টার কর্মসময় কখনোই মানা হয় না। ওভারটাইম সব সময়েই কার্যকরী থাকে। এছাড়াও অন্যান্য শ্রমিক যেমন-আবাসন খাত, পরিবহন খাত ও নৌযান শ্রমিকদের বেলায় কোনো নিয়মেই কার্যকরী নয়। বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা বেশি অবহেলার শিকার হয়। আইনত নারী শ্রমিকরা মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য কিছু সুযোগ সুবিধার অংশিদার হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয় না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বর্তমানে যে অবস্থানে আছে তাতে সহসা কোনো শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সামরিক শাসকদের আমলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে দালাল বেনিয়াদের দিয়ে কুলশিত করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য অফিস আদালতে ট্রেড ইউনিয়নের নামে এক ধরনের নৈরাজ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়েছিলো এখন আর সে অবস্থা বিরাজ করে না। কিন্তু তবুও কোনো কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা কর্তৃপক্ষকে বেআইনি চাপ প্রয়োগে নানা কাজ করিয়ে নেয়ায় বাধ্য করে।

এবারের মে দিবসে আমাদের দাবি, শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী স্বীকৃত অধিকারসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হোক। শুধু কথার ফুলঝুড়ি নয়, বাস্তবে উন্নত বিশ্বের মতো শ্রমিকরা যেন তাদের শ্রম ও আত্মমর্যাদার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর যেন রানা প্লাজা বা স্পেকটার্ম-এর মতো লোভী মানবসৃষ্ট দানবের দ্বারা শ্রমিকদের জীবন বিপন্ন না হয়। শ্রমিকরা যেন তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের লাল ঝাণ্ডা উর্ধ্বে তুলে ধরতে পারে। শ্রমিকরাও যেন মনে করতে পারে ‘আমিই এদেশের উন্নয়নের কারিগর, আমার শ্রম-ঘামেই দেশ এগিয়ে চলেছে’।

এবারের মে দিবসে বিশেষ একটি দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাই, আমাদের হাওর অঞ্চলে যারা ক্ষেতে দিন মজুরের কাজ করে যাদেরকে আমরা কৃষি শ্রমিক বলি তারা অকাল বন্যায় বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। অন্যান্য সেক্টরের পাশাপাশি কৃষি শ্রমিকদের পাশে যেন সরকার ও শ্রমিক সংগঠনগুলি যথাযথ দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসে। আমাদের মনে রাখতে হবে কৃষি শ্রমিকরা সংগঠিত না হলেও তাদের কষ্ঠার্জিত, উৎপাদিত ফসলেই আমরা ভোগ করি। মে দিবস অমর হোক। দাস যুগ থেকে শুরু করে সভ্যতার বর্তমান পর্যায়ে যত শ্রমিক আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের জানাই লাল সালাম।

লেখক: শফী আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :