শবে বরাত হোক বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়িমুক্ত
চন্দ্রবর্ষের অন্যতম ফজিলত ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস শাবান। এই মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত লাইলাতুল বরাত বা ভাগ্য রজনী হিসেবে আমরা জানি। রমজানের প্রস্তুতির মাস হিসেবে শাবান মাসের গুরুত্ব এমনিতেই বেশি। শাবান মাসের তাৎপর্য ও মহিমা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ লাইলাতুল বরাত। আমাদের সমাজে এ রাতটি শবেবরাত হিসেবে পরিচিত।
উপমহাদেশের সবখানেই এ রাতটি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়। মুমিন বান্দারা এ রাতটি ইবাদত বন্দেগিতে কাটান।
মধ্যপ্রাচ্যসহ কোনো কোনো দেশে এ রাতটিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। তারা মনে করেন, যেহেতু এ রাতের ফজিলতের ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসগুলোর সূত্র ততটা সবল নয়, এজন্য বিশেষ গুরুত্ব দিলে তা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। আমাদের দেশেও ইদানীং কেউ কেউ শবে বরাতের ভিত্তিকে অস্বীকার করেন। এ সংক্রান্ত হাদিসের সূত্রের দুর্বলতার দোহাই দিয়ে মুসলমানদের আবেগঘন এ রাতটিকে গতানুগতিকতায় পর্যবসিত করতে চান। অথচ হাদিসের মূলনীতি হলো, হাদিস দুর্বল হলেও তা ফজিলতসংক্রান্ত বিষয়ে গ্রহণযোগ্য।
দুর্বল হাদিস দ্বারা শুধু কোনো বিধান আরোপ করা যায় না। শবে বারতে যারা ইবাদত বন্দেগি করেন তারা তা ফরজ-ওয়াজিব হিসেবে করেন না, নফল হিসেবেই করেন। তিরমিজি শরিফ ও ইবনে মাজাহ শরিফসহ যেসব কিতাবে এ রাতের ফজিলতসংক্রান্ত হাদিস বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর সূত্র দুর্বল হতে পারে, তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ফজিলতের ক্ষেত্রে হাদিসের সূত্রটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। এজন্য শবে বরাতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হঠকারিতা ও ইসলাম সম্পর্কে অযাচিত বাড়াবাড়ি বৈ কিছু নয়। এ রাতের প্রতি মুসলমানদের যে আবেগ ও বিশ্বাস তার মূল্য দেয়া উচিত। তবে এ কথা সত্য, আমাদের সমাজে শবে বরাত উপলক্ষে অতিরিক্ত ও ইসলামবিবর্জিত যে মাতামাতি করা হয় তা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য না। মনগড়া বিষয় টেনে এনে এ রাতের পবিত্রতা নষ্ট করা কাম্য নয়।
কোরআনে বর্ণিত বরকতময় রাত দ্বারা মধ্য শাবানের রাতকে বোঝানো হয়েছে বলে তাফসিরকাররা মত দিয়েছেন। এ অভিমতের পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায় হাদিস শরিফেও। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহকে (সা.) শয্যাপাশে পেলাম না। তখন তালাশে বের হয়ে দেখি, তিনি ‘বাকি’ নামক (মদিনাবাসীদের) কবরস্থানে আছেন। তিনি আমাকে দেখে বললেন, আয়েশা! তুমি কি মনে করেছ, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সা.) তোমার প্রতি অবিচার করবেন? আয়েশা (রা.) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! সত্যিই আমি ধারণা করেছিলাম যে, হয়তো আপনি আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে চলে গেছেন। তখন হুজুর (সা.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা অর্ধশাবানের রাতে এই নিকটতম আসমানে অবতীর্ণ হন এবং ক্বালব গোত্রের মেষপালের পশম সংখ্যারও অধিক ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন (আজ সেই রজনী)। [তিরমিজি ও ইবনু মাজাহ]বরাত শব্দের অর্থ মুক্তি। অসংখ্য বনি আদমকে ক্ষমা করার ফলে তারা জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তি পায়। এমন সুসংবাদ বিজড়িত হওয়ায় এ রাতের নাম হয়েছে লাইলাতুল বরাত বা মুক্তি রজনী। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মধ্য শাবানের রাত এলে তোমরা সে রাতে ইবাদতের জন্য সজাগ থাকবে এবং পরদিন রোজা রাখবে। কেননা সে রাতের শুরুতেই বা সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর নিকটতম আসমানে নেমে আসেন এবং ঘোষণা করতে থাকেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে মুক্তি দেব। কোনো রিজিক প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিজিক দান করবো। কোনো বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করব। এভাবে প্রভাত পর্যন্ত তিনি আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ)
নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘শাবানের ১৪ তারিখের রাতে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষী ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন’(বায়হাকি)। এ রাতে ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে নিমগ্ন থাকাই প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের প্রধান কাজ। এ রাতে তওবা-ইস্তেগফার করা, আল্লাহর কাছে নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য আকুতি জানানো এবং জীবিত ও মৃতদের পাপরাশি ক্ষমা লাভের জন্য প্রার্থনার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এ রাতে নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, কবর জেয়ারত ও পরদিন নফল রোজা রাখার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সক্ষম হয় এবং ব্যক্তিজীবনে এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটে। নবী করিম (সা.) নিজেও এ রাতে কবর জিয়ারত করতেন এবং ইবাদতে নিমগ্ন হতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শাবান মাসের ১৫ তারিখে রোজা রাখবে, দোজখের আগুন তাকে স্পর্শ করবে না’ (আবু দাউদ)।
আরেক হাদিসে আছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন নবী করিম (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আয়েশা তুমি জানো কি এ রাতে অর্থাৎ শবে বরাতে কী কী আছে? তিনি বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তাতে কী আছে? হুজুর (সা.) বললেন, এই রাতে নির্ধারিত হয় এই বছর মানুষের মধ্যে কারা মারা যাবে। এই রাতে ওপরে নিয়ে যাওয়া হয় মানুষের কর্মসমূহ এবং অবতীর্ণ করা হয় তাদের রিজিকসমূহ। এরপর হজরত আয়েশা (রা.) হুজুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.), কোনো ব্যক্তি কি আল্লাহর রহমত ছাড়া (আমল দ্বারা) বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না? হুজুর তিনবার করে বললেন, কোনো ব্যক্তিই বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না, আল্লাহর রহমত ছাড়া। আয়েশা (রা.) বললেন, তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনিও কি পারবেন না, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! তখন তিনি আপন মাথার ওপর হাত রেখে বললেন, আমিও না। তবে যদি আল্লাহ তায়ালা আপন রহমত দ্বারা আমায় ঢেকে নেন। এভাবে তিনি তিনবার বললেন’ [বায়হাকির বরাতে মিশকাত]
শবে বরাতে করণীয় আমলের সঙ্গে কতগুলো বর্জনীয় বিষয়ও সম্পৃক্ত আছে। এ রাতকে কেন্দ্র করে অনেক অপব্যয় করা হয়। অপব্যয় কখনও ইসলাম সমর্থন করে না। আতশবাজিতে অনর্থক অপচয় না করে সে অর্থ মানবতার কল্যাণকর কাজে বা গরিব-মিসকিনের মধ্যে দান-সাদকা করা অনেক সওয়াব ও বরকতের কাজ। প্রকৃতপক্ষে শবে বরাতের বৈশিষ্ট্য অনুষ্ঠানের আড়ম্বরতার মধ্যে নয়, বরং চরিত্রবলের সাধনার মাধ্যমে দয়াময়ের করুণা লাভের আন্তরিক প্রয়াসই এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। এ রাতে অহেতুক আলোকসজ্জা করা, তারাবাতি জ্বালানো, আতশবাজি পোড়ানো, পটকা ফোটানো প্রভৃতি শরিয়তগর্হিত কাজ। এতে অপসংস্কৃতির সঙ্গে যেমন সাদৃশ্য তৈরি হয়, তেমনি ইবাদতেও যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটে। শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের এ বিষয়ে সতর্ক করা অবশ্য কর্তব্য। শবে বরাতের আতশবাজি ও অসংলগ্ন কর্মকাণ্ড কেন্দ্র করে বড় দুর্ঘটনাও ঘটে থাকে। রাজধানীর উপকণ্ঠে আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা এবং মিরপুরে বিহারী ক্যাম্পে আগুন দিয়ে দশজনকে পুড়ে মারার ঘটনা এর জ্বলন্ত উদাহরণ। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আতশবাজিসহ সব ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
যেসব রাতের উসিলায় আল্লাহ তাআলা মুমিন বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন শবে বরাত এর অন্যতম। আল্লাহর রহমতের বেষ্টনীতে কেউ একবার পড়ে গেলে তার জীবন সাফল্যের দোড়গোড়ায় পৌঁছবেই। বলা যায় না, আল্লাহর রহমত কখন বান্দার দিকে ধেয়ে আসে। স্রষ্টার রহমত অবতীর্ণ হওয়ার উপলক্ষগুলো হেলায় খেলায় কাটিয়ে দেয়া সমীচীন নয়। মুক্তির রাত শবে বরাতও গতানুগতিকতায় কিংবা অনুষ্ঠানসর্বস্বতায় উদযাপন করা বুদ্ধিমানের পরিচয় নয়। অন্তরকে পরিষ্কার করে, স্রষ্টার প্রতি একনিষ্ঠভাবে নিবেদিত হলেই কেবল মুক্তির আশা করা যায়। তবে এ মুক্তির রাতেও আল্লাহ তাআলা কয়েক ধরনের লোককে ক্ষমা করেন না। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী তারা হলো: মুশরিক, জাদুকর, গণক, সর্বদা মদপানকারী, মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, ব্যভিচারী ও সুদখোর। কারও মধ্যে এ ধরনের কোনো দোষ থাকলে শবে বরাতে স্বচ্ছ মনে, দৃঢ়তার সঙ্গে তওবা করলে আশা করা যায় আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। তাই শবে বরাতে আসুন আমরা পাপমুক্ত জীবন গড়ার শপথ নিই। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন