একুশ শতকের ঈদের পোশাক
গত কয়েক বছর ধরে ঈদ পড়ছে গরমের সময়। সামনের আরো কয়েক বছর এমন প্রকৃতির মধ্যেই করতে হবে ঈদ। এবারের ঈদ কিন্তু বর্ষায়। তার মানে ঈদের দিনেও আসতে পারে বৃষ্টিভেজা সকাল। দিনভর হতে পারে ভারী বর্ষণ। গরম চিন্তা করে, বৃষ্টি মাথায় রেখে এখন তাই ঈদের পোশাক নির্বাচন করতে হয়। তবে তাতে উৎসবের আমেজ এতটুকু কমে না। কারণ পোশাকে ঈদের উদযাপনের জমকালো ভাব ঠিকই ধরে রাখা হয়। এটাই একজন ফ্যাশন-সচেতন মানুষের মুনশিয়ানা।
পোশাক এবং সাজসজ্জা সবটাই হতে হবে সময়ের ভাবভঙ্গি বুঝে। আবার ফ্যাশনের সঙ্গে আবহাওয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেখান থেকে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার কিংবা হাউসগুলোর দায়িত্ব হলো ফ্যাশনের ধারা বজায় রেখে পোশাক তৈরি করা। যাতে পোশাকের বৈচিত্র্য কমে না যায়। আবার স্বস্তিও মেলে পোশাকে। এখনকার ঈদের ফ্যাশনে সেটাই দেখা যাচ্ছে।
ফ্যাশন হাউসগুলোর কাজে ফেব্রিক্স ও কাটে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বস্ত্রের দিক দিয়ে থাকছে আরামদায়ক সুতির প্রাধান্য, আর কাটে ঢিলেঢালাভাব। অন্যদিকে চোখের জন্য স্বস্তিদায়ক রঙের ব্যবহার বেশি দেখা যাচ্ছে। উজ্জ্বল রং থাকলে চোখে আরাম পাওয়া যাবে। কাপড় ভেদে পাতলা সুতি, খাদি, লিলেন, ভিসকস ও মসলিনের ব্যবহার বেশি। আবার সিল্ক কিংবা আর্টিফিশিয়াল উপাদানে তৈরি পোশাকের আবেদন নেই বললেই চলে। রঙের ক্ষেত্রে সাদা বরাবরের মতো আবেদনময়ী। এছাড়া সবকটি রঙের হালকা শেড, যেমনÑ হালকা গোলাপি, হালকা নীল, হালকা হলুদ, ধূসর। ঈদের পোশাকগুলোর মধ্যে কামিজের সঙ্গে ঢিলেঢালা পালাজ্জো, কুর্তি, ফ্রক কাটের কামিজ লক্ষণীয়। স্কার্ফ কিংবা হিজাবের চলটাও চোখে পড়ার মতো। শাড়ির মধ্যে তাঁতের কদর আরো বেড়েছে।
বৈশ্বিক প্রভাবে ফ্যাশনে নানা পরিবর্তন আসছে। ফলে প্রতিনিয়তই আমরা প্রভাবিত হচ্ছি। আজ আমরা যেটাকে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বলছি সেটা আগামী ৫০ বছর পর নাও থাকতে পারে। আমরা রূপান্তরিত হয়ে অন্য কিছুকে আমাদের সংস্কৃতি বলে স্বীকৃতি দিব। যেমনÑ এখন মেয়েদের জনপ্রিয় পোশাক হলো সালোয়ার-কামিজ এবং দোপাট্টা মিলেই পুরো সেট, কিন্তু এখন দোপাট্টা বাদ দিয়ে কেপ, পঞ্চ, স্কার্ফ কিংবা হিজাবের প্রচলন শুরু হয়েছে, কটিও দোপাট্টার জায়গা দখল করে নিয়েছে। ফ্যাশনেবলরা স্কার্ট, প্যান্ট, শার্ট পরলেও এর মানে এই নয় যে, আমরা আমাদের সংস্কৃতিটাকে হারাচ্ছি।
এই পরিবর্তন আসবেই। ১৯৯৯ থেকে ২০৯৯ সাল পর্যন্ত এই একশ বছরে এমন অনেক রূপান্তর আমাদের মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মাথায় রাখতে হবে যাতে আমাদের স্বকীয়তাটুকো যেন নষ্ট না হয়। আবার একটা ভালো দিক হলো আমরা অনেক ফ্যাশন সচেতন হয়েছি। ছোট থেকে বড় সবার ভেতর পরিবর্তন আসছে প্রতি বছর । ফ্যাশন হাউসগুলো ঈদ বলে জমকালো কিছু একটা বানিয়ে রাখল কাস্টমার তাই কিনে ফেলবে এটা শেষ। এজন্য এটাই হলো একুশ শতকে ফ্যাশন হাউসগুলোর বড় চ্যালেঞ্জ।
ফলে কাস্টমারদের আলাদা আলাদা সেগমেন্ট করে পোশাক তৈরি করতে হচ্ছে। এবারে ঈদে কাটিং এবং প্যাটার্নে অনেক ভেরিয়েশন দেখা যাবে। নেকলাইন, বটমলাইন কিংবা স্লিভ সবটাতেই এই বৈচিত্র্য চোখে পড়বে। মেয়েদের ফ্যাশনে গত দুই-তিন বছরের মতো সত্তর দশকের জনপ্রিয় লম্বা কামিজের প্রভাব নতুন আঙ্গিকে এবারও থাকবে। কামিজে ঝুল কোনোটার পেছনে বেশি থাকছে সামনে কম। কিংবা সামনে-পেছনে ঠিক রেখে দুই সাইডে ঝুল নেমে যাবে। এ রকম অসম কাটের প্রাধান্য থাকছে। হাই নেক খুব একটা দেখা যাবে না। বটমলাইন এ পালাজ্জো, ডিভাইডার টাইপ প্যান্ট, স্কার্ট থাকছে। তবে কটির ব্যবহার থাকবে অনেকটাই।
আমাদের দেশে ছেলেদের ফ্যাশন বাজার অনেক বড়। মেয়েদের মতো ছেলেরাও সবকিছুতেই বৈচিত্র্য খুঁজে। ছেলেদের শার্ট কাটিংয়ে বৈচিত্র্য থাকবে। ছোট ছোট মিনিমাল ডিটেইলিং দিয়ে ছেলেদের পোশাকে বৈচিত্র্য আনা হবে। নকশার ক্ষেত্রে ফ্লোরাল প্রিন্টের প্রভাব আছে ছেলে কিংবা মেয়েদের পোশাকে। এবারের ঈদে নকশায় প্রাধান্য পেয়েছে মুঘলীয় আবহ। আর উৎসব বলে কথা। উজ্জ্বল রঙের প্রভাব তো থাকবেই। এ ক্ষেত্রে ক্রেতাদের দুই ভাগে কালার নির্বাচন করে পোশাক কিনতে হবে।
দিনের বেলা গোলাপি, আকাশি, অ্যাশ এবং রাতের কালো, নীল, মেরুন, মেজেন্ডা নিতে পারে। যদি কোড করে কি-কালার বলা হয় তাহলে এবার মেরুন, ব্লু এবং রাস্ট ইয়োলোর প্রাধান্য বেশি। মুঘলীয় বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সবকটি উপাদান সংযুক্ত করা হয়েছে। খুব কম করে চুমকি, পুঁতির ব্যবহার থাকবে বেশি ভাগ পোশাকে। টাই-ডায়িংয়ের ব্যবহার থাকছে ভালো মাত্রায়।
আমাদের উৎসবগুলোর ভেতর ঈদ হলো সব থেকে বড় আয়োজন। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে গুরুত্বের সঙ্গে এর প্রস্তুতি চলে বছরজুড়ে। ঈদের আমেজ এখন খুব একটা আলাদা করা যায় না। রোজার শেষ দিকে একটু চোখে পড়ার মতো। এর কারণ হতে পারে ফ্যাশন সচেতনতায় এখন বছরজুড়েই ক্রেতাদের আগ্রহ থাকে নতুন নতুন পোশাকের। হাত বাড়ালেই পছন্দের ড্রেসটা নিজের মতো করে দ্রুত সময়ের মধ্যে কিনতে পারে। আরো যোগ হয়েছে অন-লাইন শপিং। ঘরে বসেই দেখতে পাচ্ছেন কোন ফ্যাশন হাউসে এবারের নতুনত্ব কি আছে।
পোশাকে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব থাকবেই। তবে দেশীয় ঐতিহ্যগত উপাদানগুলো যেন কাপড়ে ফুটে উঠে সেদিকে নজড় দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশীয় উপাদান যেমন হাতে সেলাই করা কাঁথাকে বিভিন্ন মাধ্যমে নান্দনিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। এটা একান্ত আমাদের পরিচিতির কারণ। অনেক বেশি সম্ভাবনাময় আমাদের ফ্যাশন জগৎ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পোশাক নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে। ডিজাইনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এখন অনেক তরুণ ডিজাইনিংয়ে আগ্রহী।
তবে ফ্যাশন জগতের অনুসরণীয়দের উচিত তাদের সঙ্গে কাজের সুযোগ প্রসারিত করা। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের তরুণরা জানতে পারবে না কাজ কিভাবে করতে হয়। কারণ অনলাইনের যুগে ডিজাইন করা অনেক সহজ হয়ে গেছে। খুব সহজেই বিদেশি সংস্কৃতির নকশা আমাদের দেশে প্রবেশ করবে এবং আগামী প্রজন্মের তরুণরা এর প্রতি আগ্রহবোধ করবে। ফলে দেশীয় সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়বে। - অনুলিখন: তানিয়া আক্তার
ফয়েজ হাসান: এক্সিকিউটিভ ডিজাইনার, আড়ং
মন্তব্য করুন