ইউনেস্কো যাই বলুক, আমরা আশ্বস্ত হব না

আরিফ রহমান
| আপডেট : ০৭ জুলাই ২০১৭, ১৪:৩৭ | প্রকাশিত : ০৭ জুলাই ২০১৭, ১৪:০৩

আমাদের বাসার সামনের যে রাস্তাটি দিয়ে গলি ঘুপচি পার হয়ে আমরা বড় রাস্তায় উঠি সেই রাস্তাটি আমারা এই জীবনে ১৭ বার খোঁড়াখুঁড়ি হতে দেখেছি। এর মধ্যে একাধিকবার প্রশাসনের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছি যে এবারের খোঁড়াই নাকি শেষ খোঁড়া, এরপর নাকি আর কোন খোঁড়াখুঁড়ি হবে না। তার কিছুদিন পরেই খোঁড়া হয়েছে।

আমাদের বাসায় ল্যান্ডফোনের লাইন বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে এসে নষ্ট হয়ে যায়, একটা বিশেষ পরিচিত অপারেটর একটা ভেরিয়েবল এমাউন্টের বিনিময়ে লাইন ঠিক করে দিয়ে যায়। বিদ্যুৎ-এর মিটারের চুরি আমরা প্রায়ই ধরতে পারি, কিছু করতে পারি না।

আমাদের ভোটার আইডি কার্ড তুলতে গিয়ে খুঁজে না পেলে সামনে বসা কর্মকর্তা হাসি মুখে মোবাইল নাম্বার ধরিয়ে দিয়ে বলেন, অফিসের পরে ফোন দিলে খুঁজে বের করার ব্যাবস্থা করে দেবেন।

আমরা পাসপোর্ট করতে গেলে ভ্যারিফিকেশনে আসা পুলিশ যখন দেখেন আমাদের পকেটে তার কাঙ্খিত এমাউন্টের পয়সা নেই তখন তিনি আমাদের মানিব্যাগটা নিজের হাতে খুঁজে খুচরো পয়সাগুলো নিয়ে ছেড়ে দেন। আমরা যখন পোস্ট অফিসে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে যাই তখন প্রতিটা মাসে একজন হাসিহাসি মানুষকে একটা নির্দিষ্ট এমাউন্টের টাকা দিয়ে দিতে হয় বখশিশ হিসেবে।

ট্রেনের টিকেট কাটার সময় কাউন্টারেই ছাপা অক্ষরে যত টাকা লেখা থাকে তার ওপর একটা এমাউন্ট বসিয়ে আমাদের টিকেট কাটতে হয়। ঈদের পর আমরা যখন বাড়ি ফিরি তখন নির্দিষ্ট কিছু রাস্তায় প্রবেশের জন্য কর্তব্যরত পুলিশের হাতে আমাদের ছোটখাটো একটা নোট গুঁজে দিতে হয়।

অথচ এই দেশের সংবিধান অনুসারে আমাদের তো আস্থা রাখার কথা...

তাহলে দেখা যাচ্ছে উপরের উল্লেখিত সবগুলো ক্ষেত্রে আমরা সরকারের মানুষ-জনের ওপর আস্থা রাখতে পারছি না। প্রতিটা ক্ষেত্রেই একটা অনাস্থা এসে যাচ্ছে। আর সহসাই এই অনাস্থা দূর হয়ে যাওয়ার কোন কারণ আমার অন্তত চোখে পড়ছে না।

রামপাল নিয়ে ইউনেসকোর আপত্তি প্রত্যাহার করেছে। আমি অতি সরলীকরণ করে বলবো না, টাকা দিয়ে ইউনেসকোকে সরকার কিনে ফেলেছে। আমি বরং বিবৃতিটা পড়লাম। পড়ে দেখলাম পরিবেশবাদীদের অভিযোগের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত শুনানিতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু আশ্বাস দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অধিবেশনে সুন্দরবনের ঐতিহ্য রক্ষায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কমিটিকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।

পাঠক উল্লেখ করবেন শব্দটি ‘আশ্বাস’। আমাকে একটু বলুন এই আশ্বাসের নিশ্চয়তা কে দেবে? সরকার দেবে? সরকার তো রাস্তা না কাটার আশ্বাসও দিয়েছিল, বলেছিল পাসপোর্ট করতে একটা পয়সাও অতিরিক্ত দিতে হবে না, সরকার তো বলেছিল ট্রেনের টিকেট মূল দামেই পাওয়া যাবে। একটা আশ্বাসও কি বাস্তবায়ন হয়েছিল?

এবছরের ১৪ জানুয়ারি সুন্দরবনের উপকূলে মংলা বন্দরের হিরন পয়েন্টে এক হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে ‘এমভি আইচগাতী’ নামের একটি কার্গো জাহাজ ডুবে যায়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে জাহাজ ডুবে সাড়ে তিন লাখ লিটারের বেশি ফার্নেস তেল সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়ে।

তাহলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র যদি চালু হয় এবং সেই কেন্দ্র যদি কয়লা দিয়েই চলে এবং চুক্তিমত সেই কয়লা যদি নদীপথেই আসে এবং যদি প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টন কয়লা স্পর্শকাতর নদীপথ দিয়ে আসে তাহলে আমাকে বলেন কোন অলৌকিক যাদু-মন্তরে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হবার পর আর কখনোই কোন জাহাজডুবি হবে না? কয়লা কি নদী পথে উড়ে উড়ে আসবে?

রামপাল নিয়ে বহুদিন ধরে বহু যুক্তি বহুভাবে আমরা দিয়েছি, আর নতুন করে কোন যুক্তি দেবো না, শুধু এটুকু বলতে পারি সরকারের কথায় ইউনেসকো আশ্বস্ত হলেই নাগরিক হিসেবে আমাদের আশ্বস্ত হবার কোন কারণ নাই। দিনের শেষে সরকার আশ্বস্ত করলেও সেই আশ্বাস শতভাগ বাস্তবায়ন না হবার শঙ্কা এই রাষ্ট্রে বসবাসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমরা করতেই পারি।

আর সুন্দরবন নিয়ে জুয়া খেলা-

এই গরিব দেশের সাজে না...

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :