নয়নে আলো নেই, তবু এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়

ফয়সাল আহমেদ, শ্রীপুর (গাজীপুর)
| আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৭, ১২:০৯ | প্রকাশিত : ১৭ অক্টোবর ২০১৭, ০৯:৫৫

২৫ বছর বয়সী টগবগে যুবক নয়ন। আড়াই বছর বয়সে হয়েছিল টাইফয়েড জ্বর। হতদরিদ্র পরিবারের ছেলেটা ঠিকঠাক চিকিৎসা পায়নি। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই হারিয়েছেন দুই চোখের আলো। নিজের অন্ধকার পৃথিবীতে বড় হয়ে উঠবার আগেই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি তাদের ছেড়ে চলে যান। নয়নের বাবা মারা যান হুট করেই। পাঁচ ভাই বোনের সংসারে ভাইয়েরা যে যার মত আলাদা হয়ে চলে যায়। যেখানে তার দায়িত্ব নেয়ার কথা ছিলো পরিবারের অন্যদের, সেখানে তিনিই মা ও একমাত্র বোনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। ভিটেমাটি নেই বলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নয়ন মিয়া বৃদ্ধ মা ও বোনকে নিয়ে চলে আসেন গাজীপুরের শ্রীপুরে।

সেই ১০ বছর আগের কথা। শ্রীপুরে এসে কোনো কাজ খুঁজে না পেয়ে আশপাশের লোকজনের পরামর্শে শুরু করেছিলেন ভিক্ষা। দিনে যা আয় হয় তা দিয়ে কোনমতে সংসার চলে। এরমধ্যে তার মা তাকে বিয়ে করান। একটি সন্তানও হয় নয়নের। কিন্তু সন্তানের জন্মের পরপরই তার মাথায় নতুন চিন্তা ভর করেন। ছেলে বাপের কী পরিচয় দেবে? তার বাপ ভিক্ষা করে এটাই হবে পরিচয়? সেই প্রশ্নের উত্তরটা তার মনে ধরেনি বলেই একদিন ভিক্ষা করা ছেড়ে দিলেন নয়ন। তারপর আড়াই বছর কেটে গেছে। ভিক্ষা করে জমিয়ে ছিলেন পাঁচ হাজার টাকা। সেই পুঁজি নিয়েই শুরু করেন ব্যবসা। এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শ্রীপুরের আনাচে কানাচে বিভিন্ন বাজারে এক হাতে সাদা ছড়ি অন্য হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে ঘুরে ঘুরে এলইডি বাতি, দাঁতের ব্রাশ, কলম বিক্রি করেন নয়ন। এসব মালামাল পাইকারি দরে দোকানে দোকানে পৌঁছে দেয়াই নয়নের কাজ। দিন শেষে যা লাভ হয়, তাই দিয়েই চলে নয়নের পাঁচ সদস্যের পরিবারের খরচ।

একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও ভিক্ষা বৃত্তিতে নিজেকে আটকে রাখেননি নয়ন। অন্যের দয়া নিয়ে একজন মানুষ সম্মানের সাথে বাচঁতে পারে না, এটাই বিশ্বাস করেন নয়ন। নয়ন বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর মা আর বোনকে নিয়ে বিপদে পড়ছিলাম। দিনের পর দিন আমরা না খেয়েও থাকছি। অন্যের বাড়িতে কাজের জন্য শ্রীপুরে আসছিলাম, কিন্তু আমি অন্ধ বলে কেউ কাজ দেয়নি। ক্ষুধার জ্বালায় আমি ভিক্ষা করতে নামি, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ভিক্ষা করি। হাতে সামান্য টাকা জমলে আমি ভিক্ষা ছেড়ে দিই। দোকানে ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেই।’

নয়ন আরও বলেন, ‘এখন শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকা আমার পরিচিত হয়েছে, অন্যের সাহায্য ছাড়াই চলতে পারি। তবে ব্যবসার আয় কম, কিন্তু তারপরও আমার ভালো লাগে, অন্যের দয়ায় না নিজের কষ্টের কামাই দিয়ে সংসার চালাই আমি। রোজগার কম কিন্তু সেই টাকাতেই পুরো পরিবার নিয়ে আমি সুখে আছি।’

নয়নের স্ত্রী দুলেনা খাতুন জানান, ‘আমার স্বামী আর আমি একই এলাকায় থাকতাম। তার মতন ভালো মানুষ হয় না। উনার এই গুণ দেখেই আমি বিয়ে করি। আমাদের সন্তান জন্ম নেয়ার পর তার কথা ভেবে সে ভিক্ষা করা ছেড়ে দেয়। এখন ব্যবসা করেন। তার স্বপ্ন একটা দোকান দেওয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আমি মাওনার ক্রাউন উল কারখানায় কাজ নিয়েছি। আমরা দুজনে মিলে তার দোকানের জন্য পুঁজি গোছাইতেছি।’

শ্রীপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মন্জুরুল হক বলেন, ‘সরকার ভিক্ষাবৃত্তি নিরুৎসাহিত করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। নয়ন একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং হতদরিদ্র হওয়া সত্বেও ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, চাইলে তাঁরাও পারে। তার এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি এবং কথা দিচ্ছি সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করা হবে।’

ঢাকাটাইমস/১৭অক্টোবর/কেএস/এমআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :